জুলাই গণঅভ্যুত্থানে কবি নজরুল কলেজের ছাত্ররাজনৈতিক সংগঠনের ভূমিকা
- বিপ্লব শেখ, কবি নজরুল কলেজ প্রতিনিধি
- প্রকাশ: ০২ আগস্ট ২০২৫, ০৯:২৯ AM , আপডেট: ০৩ আগস্ট ২০২৫, ০৫:৫০ PM
২৪-এর জুলাই গণঅভ্যুত্থানে দেশের বিভিন্ন কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররাজনৈতিক সংগঠনগুলোর ভূমিকা ছিল অনন্য। রাজধানীর ঐতিহ্যবাহী কবি নজরুল সরকারি কলেজের ছাত্ররাজনৈতিক সংগঠনগুলোও এ আন্দোলনে রেখেছে গৌরবময় ভূমিকা। বৈষম্যহীন ও স্বৈরাচারমুক্ত বাংলাদেশ গড়ার লক্ষ্যে প্রতিষ্ঠানটির নেতাকর্মীরা রাজধানীর বিভিন্ন এলাকা থেকে সক্রিয়ভাবে আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেছিল।
ইট, লাঠি, যা পেয়েছি তা দিয়েই প্রতিহত করার চেষ্টা করেছি
কবি নজরুল সরকারি কলেজ শাখা ছাত্রদলের সদস্য সচিব মোঃ নাজমুল হাসান বলেন, জুলাই বিপ্লব নামে পরিচিত এই ছাত্র-জনতার আন্দোলন ছিল বাংলাদেশের ঐতিহাসিক গণতান্ত্রিক গণঅভ্যুত্থান, যা ২০২৪ সালের ৫ জুন থেকে ৫ আগস্ট পর্যন্ত চলে। বিপ্লবের সূচনা হয় কোটা সংস্কার আন্দোলনের মাধ্যমে। পর্যায়ক্রমে এটি রূপ লাভ করে এক দফা দাবিতে। অসংখ্য শহীদের আত্মত্যাগ ও রক্তের বিনিময়ে এই আন্দোলনের মধ্য দিয়ে ১৫ বছরের স্বৈরাচারী শাসনের অবসান ঘটে এবং শেখ হাসিনা পালিয়ে যেতে বাধ্য হন।
তিনি বলেন , ১৯ জুলাই, ২০২৪ সারা দেশে শেখ হাসিনা সরকার কারফিউ জারি করে। আমাদের নির্ধারিত কর্মসূচি ছিল প্রেসক্লাবে। আমি বাসা থেকে বের হয়ে জুমার নামাজ আদায় করে প্রেসক্লাবের উদ্দেশ্যে রওনা দিই। রিকশায় করে লক্ষীবাজার পৌঁছে দেখি, এখানে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে ছাত্রলীগ ও পুলিশের সংঘর্ষ চলছে। তাই সেদিন প্রেসক্লাবে না গিয়ে আমিও লক্ষীবাজার শিক্ষার্থীদের সঙ্গে আন্দোলনে যোগ দিই। আমরা সব মিলিয়ে ৩০/৪০ জন আন্দোলনকারী এখানে ছিলাম।পথের দুপাশে দাঁড়িয়ে ছিল শত শত উৎসুক জনতা। পুলিশ ও ছাত্রলীগ আমাদের কবি নজরুল সরকারি কলেজের সামনে থেকে ধাওয়া দিয়ে সোহরাওয়ার্দী কলেজ পর্যন্ত নিয়ে যায়। আমরা আবার পাল্টা ধাওয়া দিয়ে তাদের ভিক্টোরিয়া পার্ক পর্যন্ত নিয়ে যায়। এভাবেই ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়ার মধ্য সংঘর্ষ চলতে থাকে। এরপর পুলিশ ও ছাত্রলীগ একযোগে আমাদের ওপর টিয়ারশেল, রাবার বুলেট এবং গুলি চালায়।
তিনি আরও বলেন, সেদিন বিকেলের দিকে পাতলাখান লেনের সামনে রাস্তায় পুলিশের ছোড়া গুলিতে কবি নজরুল সরকারি কলেজের ছাত্র ইকরাম হোসেন কাউসার শহীদ হন। গুলিটি তার মাথায় লাগতেই মগজ বের হয়ে রাস্তায় পড়ে যায়। সেদিন কলেজের একে একে ৪ জন গুলিবিদ্ধ হয়ে শহীদ হন। সেদিন জীবনের ঝুঁকি নিয়ে দুপুর থেকে শেষ পর্যন্ত লড়াই করে গেছি। সেদিন আমার সঙ্গে ছিলেন কলেজ ছাত্রদলের যুগ্ম-আহ্বায়ক আহমদ উল্লাহ, রুহুল আমিন, নোমান, স্বপনীল, আবির, শাওন বিশ্বাস রিপনসহ আরও অনেক সাহসী সহযোদ্ধা। আবির সেদিন গুলিবিদ্ধ হয়, বহু আন্দোলনকারী আহত হন। আমরা ইট, লাঠি, যা কিছু পেয়েছি তা দিয়েই প্রতিহত করার চেষ্টা করি। সেদিন মৃত্যুর মুখ থেকে একটুর জন্য বেঁচে ফিরি। সকলের সম্মিলিত লড়াই,সংগ্রাম আর হাজারো বীর শহীদের রক্তের বিনিময়ে দেশ স্বৈরাচার মুক্ত হয়েছে। সকল বীর সন্তানদের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা।
কোর্টের ভিতর থেকে সাধারণ শিক্ষার্থীদের ওপর গুলি চালায় আওয়ামী সন্ত্রাসীরা
কবি নজরুল সরকারি কলেজ শাখা ছাত্রশিবিরের সেক্রেটারি হাসিব বিন হাসান বলেন, আমাদের ছাত্রশিবির কেন্দ্রীয় ভাবেই আমাদের নির্দেশনা দিয়ে দেয় এই আন্দোলনে সাধারণ শিক্ষার্থীদের ব্যানারে স্বতঃস্ফূর্তভাবে অংশগ্রহণ করতে হবে। ১৪ জুলাই কবি নজরুল কলেজ, সোহরাওয়ার্দী কলেজ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের দুজন করে প্রতিনিধি আলোচনায় বসি যেখানে কেন্দ্রীয় মেহমান ছিল। এখান থেকে সিদ্ধান্ত হয় আমাদেরকে সমস্ত আন্দোলনে বিশেষ করে কোটা আন্দোলনকে বাস্তবায়ন করতেই হবে। ১৫ তারিখ হঠাৎ করে সিদ্ধান্ত আসলো আমাদের শহীদুল্লাহ হলে যেতেই হবে । তখন আমাদের কবি নজরুল কলেজের যে জনশক্তি আছে তাদের নিয়ে তাৎক্ষণিক চলে যায়। আমাদের তৎকালীন সভাপতি বায়জিদ মাহমুদ ভাই স্ট্যাম্প নিয়ে পরে চলে আসে এবং ওখানে কিছু সময় দাওয়া পাল্টা ধাওয়া হয়।
তিনি বলেন, ২০২৪ সালের ১৬ জুলাই ছিল বাংলাদেশের সমস্ত পেশাজীবী, শ্রমজীবী বিশেষ করে ছাত্রজনতাকে আন্দোলনে স্পিড জাগানোর একটা অন্যতম দিন। সেদিন সাধারণ শিক্ষার্থীদের ওপর ছাত্রলীগের হামলার প্রতিবাদে শাপলা চত্বরে বিক্ষোভ মিছিল শেষে আমরা ভিক্টোরিয়া পার্কে যাই। সেখানে ছাত্রলীগ আমাদের বর্তমান সাংগঠনিক সম্পাদক হাসানুল বান্না জিসানকে ধরে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে। তখন তৎকালীন জগন্নাথ ছাত্রশিবিরের সভাপতি ধাওয়া দিয়ে তাকে উদ্ধার করে।
তিনি আরও বলেন, এরপর আমরা মিছিল নিয়ে শহীদ মিনারের দিকে রওনা দিই। তখন হঠাৎ কোর্টের ভিতর থেকে আওয়ামী সন্ত্রাসীরা এলোপাতাড়ি গুলি চালাতে শুরু করে। আমার সামনে দুজন ভাই গুলিবিদ্ধ হয়ে পড়ে যান। এর কিছুক্ষণ পর আমার বাম হাতে গুলি লাগে। তৎকালীন সভাপতি বায়জিদ মাহমুদ ভাই ও বন্ধু নাঈম আমাকে দয়াগঞ্জে নিয়ে যান, সেখানে অপারেশনের পর উন্নত চিকিৎসার জন্য অন্যত্র নেওয়া হয়। ঢাকায় কিছুদিন চিকিৎসা নেওয়ার পর পরিস্থিতি আরও খারাপ হয়ে যায়, বাধ্য হয়ে আমাকে গ্রামের বাড়ি যেতে হয়। কিন্তু সেখানেও বাড়িতে থাকতে পারিনি থাকতে হয়েছে পাশের বাড়ি এবং পাশের এলাকায়। শেষ পর্যন্ত ওই এলাকাও ছাড়তে হয়েছে, আশ্রয় নিতে হয়েছে এক আত্মীয়র বাসায়।
বন্ধুর মৃতদেহ পরিবারের কাছে পৌঁছাতে পুলিশের গুলির মুখে জীবনবাজি রাখে ইসলামী ছাত্র আন্দোলন নেতা
ইসলামী ছাত্র আন্দোলন কবি নজরুল সরকারি কলেজ শাখার সভাপতি দেওয়ান মুহাম্মদ তাজিম বলেন, কবি নজরুল কলেজের শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে উদ্বুদ্ধ করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে কলেজস্থ ইসলামী ছাত্র আন্দোলনের নেতাকর্মীরা। পুলিশ ও ছাত্রলীগের ভয় উপেক্ষা করে তারা ঝুঁকি নিয়ে মিছিলের আয়োজন করে এবং সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়ে বীরদর্পে রাজপথে অবস্থান নেয়। ইসলামী ছাত্র আন্দোলন, কবি নজরুল কলেজ শাখার নেতাকর্মীদের এই সাহসী ভূমিকার মূল প্রেরণা ছিলেন দেশের আধ্যাত্মিক ও রাজনৈতিক রাহাবার পীর সাহেব চরমোনাই এবং ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের নায়েবে আমীর মুফতি সৈয়দ ফয়জুল করীম। তার নির্দেশেই শুরু থেকে ইসলামী ছাত্র আন্দোলনের নেতাকর্মীরা শাহবাগে কোটা আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করে। পরবর্তীতে কেন্দ্রীয় কমিটির পক্ষ থেকে পুরো আন্দোলনের রূপরেখা নির্ধারণ করা হয়।
তিনি বলেন, তখন আমি কলেজ শাখার সাধারণ সম্পাদক হিসেবে দায়িত্বে ছিলাম। ক্যাম্পাস থেকে বাসা দূরে হওয়ায় নিজ এলাকা সাইনবোর্ড-যাত্রাবাড়ি থেকে কবি নজরুল কলেজের প্রতিনিধি হিসেবে আন্দোলনে অংশ নিই। কোটা সংস্কার ইস্যু থেকে জুলাই আন্দোলনের সূচনা হয়। শুরু থেকেই পীর সাহেব চরমোনাই ছাত্রদের পাশে ছিলেন। পরে আন্দোলন যখন পুলিশি দমন-পীড়নের কারণে সরকার পতনের দাবিতে রূপ নেয়, তখনও তার নির্দেশে আমরা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে মাঠে নামি এবং সমন্বয়কদের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে আন্দোলন চালিয়ে যাই। ১৫ জুলাই কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দের সাথে একত্রিত হয়ে আমি ঢাবির মলচত্বরে ছাত্রলীগের সন্ত্রাসীদের সাথে মুখোমুখি লড়াই করেছি। সেদিন মলচত্বরে ছাত্রলীগ সন্ত্রাসীদের হামলায় অনেক শিক্ষার্থী রক্তাক্ত হয়। শিক্ষার্থীদের রক্তের প্রয়োজন পড়লে দ্রুত কেন্দ্রীয় নেতা আল আমিন বাবুল ভাইয়ের সাথে ছুটে যাই ঢাকা মেডিকেলে রক্ত দিতে।
তিনি আরও বলেন, কলেজ শাখার তৎকালীন সাংগঠনিক সম্পাদক, মোস্তফা কামাল এই আন্দোলনে পুলিশের হেনেস্তার শিকার হয়। তিনি তার বিভাগের বন্ধুদের নেতৃত্ব দিয়ে একত্রে আন্দোলনে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছেন। রাজপথে থাকাকালেই তার ঘনিষ্ঠ বন্ধু ওমর ফারুক পুলিশের গুলিতে মারা যায়। বন্ধুর মৃতদেহ পরিবারের নিকট পৌঁছে দিতে গিয়ে পুলিশের গুলির মুখে জীবনবাজি রেখেছে তিনি।
আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগের সন্ত্রাসীরা আন্দোলনে যাওয়ার পথে তুলে নেয় ছাত্র অধিকারের নেতাকে
কবি নজরুল সরকারি কলেজ শাখা ছাত্র অধিকার পরিষদের সভাপতি নাহিদ হাসান বলেন, স্বাধীনতার পরও এ দেশের মানুষ বৈষম্য থেকে মুক্তি পায়নি। কোটা প্রথা নামক বৈষম্য ছাত্রসমাজের বুকের উপর চেপে বসে ছিল। এই অভিশাপ থেকে মুক্তি পেতে নুর, রাশেদ, হাসান আল মামুন ও ফারুকের নেতৃত্বে ছাত্ররা রাজপথে নেমে কোটা প্রথা বিলুপ্ত করে। কিন্তু ২০২৪ সালে এসে আবার কোটা পুনরায় চালুর ঘোষণা দিলে শিক্ষার্থীরা আবারও রাস্তায় নামে আসে। ৩৬ দিনের এ আন্দোলনে আমিও ধারাবাহিকভাবে মিছিল-মিটিংয়ে অংশ নিই। আমি নারায়ণগঞ্জে থাকি তাই সেখানে আন্দোলনকে কিভাবে বেগবান করা যায় তা নিয়ে চিন্তা করি। এরপর বিভিন্ন মাধ্যমে স্থানীয় বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করি।
তিনি বলেন, ১২ জুলাই শাহবাগে আন্দোলনে যাওয়ার পথে আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগের সন্ত্রাসীরা আমাকে উঠিয়ে নিয়ে যায় অচেনা অজানা জায়গায়। সেখানে ১২ ঘণ্টা ধরে শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন চালায়, লাঠি ও লাথি গুরি দিয়ে মারধর করে এবং গালিগালাজ করে। একপর্যায়ে নানা অঙ্গীকার নিয়ে ফেলে রেখে যায়। পরে কয়েকজনের সহায়তায় হাসপাতালে ভর্তি হই। ১৪ জুলাই অসুস্থ শরীর নিয়েই নারায়ণগঞ্জে প্রথম মিছিল করি এবং শহীদ মিনারে দাঁড়িয়ে কোটার বিরুদ্ধে আওয়াজ তুলি। সেদিন রাতেই সবাই রাজপথে নেমে স্লোগান দেয় তুমি কে, আমি কে, রাজাকার রাজাকার, কে বলেছে কে বলেছে, স্বৈরাচার।
তিনি আরও বলেন , দেশের এরকম পরিস্থিতির মধ্যে আমার ছোট বোনকে হল থেকে একটি মেসে উঠাইতে যাই জীবন মৃত্যু হাতে নিয়ে। সে সময়ের কথা মনে হলে এখনো গা শিউরে উঠে। ৩ তারিখের মহাসমাবেশ থেকে বলা হয় পরশু নয় আগামীকালই লংমাস টু ঢাকা। এই গণঅভ্যুত্থান সফল করার লক্ষ্যে আমরা যাত্রাবাড়ীতে অবস্থান করি। ৫ তারিখের গণঅভ্যুত্থানের মধ্যেই সরকারের পতন ঘটে।