ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কালো দিবস: বিস্মৃত যে উপাখ্যান

লেখক
লেখক  © টিডিসি ফটো

এক.
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বাংলাদেশের সর্বপ্রাচীন ও সর্ববৃহৎ বিশ্ববিদ্যালয়। নানান সীমাবদ্ধতা ও উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে প্রতিযোগিতামূলক বিশ্বে যথোপযুক্ত বা প্রত্যাশিত মানে উন্নীত হতে না পারলেও বলার অবকাশ নেই যে, এখনো এটিই দেশের সর্বশ্রেষ্ঠ বিশ্ববিদ্যালয়। দেশের শাসনব্যবস্থা, বিচারব্যবস্থা ও প্রশাসনিক বিন্যাসে এ বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃতী প্রাক্তনীরাই সিংহভাগ ক্ষেত্রে দায়িত্বশীল পদসমূহে নেতৃত্ব দিয়ে দেশ ও জাতির সামগ্রিক উন্নয়ন ও সমৃদ্ধিতে অগ্রণী ভূমিকা পালন করে চলেছেন। বৃটিশ শাসনামলে প্রতিষ্ঠার পর থেকে বর্তমান অবধি এ বিশ্ববিদ্যালয় যে সব সময় শিক্ষা ও গবেষণার অনুকূল পরিবেশ পেয়েছে, সে কথা বলা যাবে না। বরং ইতিহাসের বাঁকে বাঁকে এ বিশ্ববিদ্যালয় স্বৈরশাসকদের ক্ষোভ, আক্রোশ ও আক্রমণের লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হয়েছে। বিশেষ করে ভাষা আন্দোলন ও একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধে পাক হানাদার বাহিনী ও তাদের দোসরদের কর্তৃক এ বিশ্ববিদ্যালয়ের পবিত্র অঙ্গন রক্তে রঞ্জিত হয়েছে; বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা মায়ের ভাষা ও মাতৃভূমির স্বাধীনতার জন্য তাঁদের জীবন বিলিয়ে দিয়েছেন, শাহাদত বরণ করেছেন। শুধু কি পাকিস্তান আমলেই এ বিশ্ববিদ্যালয় ক্ষমতাসীনদের রোষানলে পড়েছে? না, স্বাধীন বাংলাদেশেও স্বৈরাচারী শাসকদের রক্তচক্ষু থেকে প্রাণের এ বিশ্ববিদ্যালয় রক্ষা পায়নি। নব্বইয়ের স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন ও ওয়ান ইলেভেনের সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক আমলেও এক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য দৃষ্টান্ত হয়ে আছে।

আজকের আলোচনার বিষয় সর্বশেষ ‘তিন উদ্দিন’-এর শাসনামলে বাংলাদেশের ইতিহাসে যে জঘন্য ওয়ান ইলেভেন স্থান করে নিয়েছে তা নিয়ে। আজকে আমরা ২৩ আগস্টকে যে কালো দিবস বলছি তা সেই মঈনুদ্দিন-ফখরুদ্দিন-ইয়াজউদ্দিন আমলে সৃষ্ট আইন, সংবিধান, গণতন্ত্র ও দেশবিরোধী ঘটনাক্রমেরই অবিচ্ছেদ্য অংশ- যা ২০০৮ সালের ২৩ আগস্ট থেকে পালিত হচ্ছে। দেশের মানুষকে ভয়ের মধ্যে রেখে, নিপীড়নের তিমিরাচ্ছন্নতায় শঙ্কাগ্রস্ত করে নিজেদের উচ্চাভিলাষকে পাকাপোক্ত ও অবৈধ ক্ষমতাকে দীর্ঘস্থায়ী রূপদানের লক্ষ্যে সেই অন্ধকারের সরকার সব ধরনের কুমতলব চরিতার্থকরণে ছিল বদ্ধপরিকর। তাদের সেই পরিকল্পনায় বাঁধ সাধে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়; জাতির সকল দুর্দিনে, দুঃসময়ের আলোকবর্তিকা আর প্রেরণার বাতিঘর হিসেবে আবির্ভূত হয় এ বিশ্ববিদ্যালয়। ইতিহাসের ক্রমধারায় গৌরবময় ঐতিহ্যের অধিকারী এ বিশ্ববিদ্যালয় সেদিন দেশ ও জাতির ভয়াবহ সঙ্কট ও গভীর ক্রান্তিলগ্নে অমিত বিক্রম আর অসম সাহসিকতায় দেশমাতৃকার গণতন্ত্রের পুনরুদ্ধারে ঐতিহাসিক ভূমিকা পালন করেছিল।

২০০৭ সালের ২০-২৩ আগস্ট-এর ঘটনা পরম্পরায় অন্ধকারের সেই স্বৈরাচারী ও উচ্চাভিলাষী সরকারের ভিত কেঁপে উঠেছিল; যার ফলশ্রুতিতে অন্য সব মানবতাবিরোধী স্বৈরাচারের পদাঙ্ক অনুসরণ করে তারাও চড়াও হয়েছিল এই বিশ্ববিদ্যালয়ের উপর। তারা ভেবেছিল, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে শায়েস্তা ও পদানত করতে পারলে অথবা নিদেনপক্ষে নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারলেই তাদের পরিকল্পনা বাস্তবায়নে আর কোনো চ্যালেঞ্জ থাকবে না। কিন্তু তাদের এ ধারণা যে শুধু ভুল ছিল তাই নয়, বরং বিশ্ববিদ্যালয়কে নিয়ন্ত্রণ করতে গিয়ে ক্যাম্পাসে সৃষ্ট অহিংস অথচ তীব্র সেই আন্দোলন ক্রমান্বয়ে সারাদেশে ছড়িয়ে পড়েছিল আর এর মধ্য দিয়ে তাদের চরম অজ্ঞতা, অদূরদর্শিতা ও অপরিণামদর্শিতার অসহায় চিত্রই তখন ফুটে উঠেছিল।

২০ আগস্ট ২০০৭ সালে বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রিয় খেলার মাঠের ঘটনার রেশ ধরে পরবর্তী দু’দিন ক্যাম্পাসে ছাত্র-শিক্ষকদের বিক্ষোভ, সেনা ছাউনি প্রত্যাহার দাবি, ছাত্র-শিক্ষক নির্যাতনের প্রতিবাদ ও বিচার দাবি এসবের ক্রমধারায় ২৩ আগস্ট দিবাগত রাতে নিজ বাসভবন থেকে গ্রেফতার হন তৎকালীন শিক্ষক সমিতির দুই নেতা, যথাক্রমে অধ্যাপক ড. আনোয়ার হোসেন ও অধ্যাপক ড. হারুন-অর-রশিদ; আত্মগোপনে থাকা অপর দুই শিক্ষক যথাক্রমে অধ্যাপক ড. সদরুল আমিন ও অধ্যাপক ড. নিম চন্দ্র ভৌমিক পরবর্তীতে ১৬ সেপ্টেম্বর ২০০৭ সালে আদালতে আত্মসমর্পণ করেন।

দুই.
আমি তখন নবীন শিক্ষক। কিন্তু যাঁদের সান্নিধ্যে কাজ করে চলেছি সেই সংখ্যাটি সীমিত হলেও তাঁদের প্রায় সকলেই বিচক্ষণ ও প্রবীণ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, প্রগতিশীলতা আর অসাম্প্রদায়িকতার পতাকাবাহী শিক্ষকদের ফোরাম হিসেবে স্বীকৃত নীল দল। নীল দলের সমর্থক শিক্ষক অন্য অনেকের সাথে আমার পার্থক্যটা হলো, তাঁরা হয়ত শিক্ষক হিসেবে জয়েন করার পরে নীল দলের সমর্থক হয়ে থাকেন আর আমি নীল দলের পর পর কয়েকবারের নেতৃস্থানীয় শিক্ষকদের পরিচিত ও ঘনিষ্ঠ হবার কারণে ছাত্রজীবন থেকেই এ দলের নানাবিধ কার্য-সম্পন্ন করার ক্ষেত্রে জড়িত থাকার বা সহযোগিতা করার সুযোগ পেয়েছি। তখন ভাবিনি যে চারদলীয় জোট ক্ষমতায়, মাথায়ও আসেনি বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন পরিচালনায় বিএনপি-জামাত সমর্থিত শিক্ষকবৃন্দ আর কল্পনা করেও কখনো আশ্বস্ত হইনি যে, আবার আওয়ামীলীগ ক্ষমতায় আসবে। শিক্ষক হিসেবে যোগদানের পর নীল দলের প্রথম সভায় অন্যান্য নবীন শিক্ষকের ন্যায় প্রথা অনুযায়ী আমার কোনো পরিচিতির প্রয়োজন হয়নি, কেননা ৭ থেকে ১৭ গোটা বিশ্ববিদ্যালয়ে এই ছিলো নীল দলের সভায় আসা কিংবা নীল দলে সক্রিয় থাকা শিক্ষক সংখ্যা; যাঁদের সবাই আমাকে আগে থেকেই ঘনিষ্ঠভাবে চিনতেন ও জানতেন। পরিচিতজনের মাঝে আনুষ্ঠানিক পরিচিতি নিষ্প্রয়োজন। সে সময় মুক্তিযুদ্ধের পক্ষ-শক্তি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় নীল দলের কনভেনর ছিলেন অধ্যাপক ড. হোসেন মনসুর; ওয়ান ইলেভেন-এর কঠিন সময়টাতে তিনি ব্যক্তিগত কারণে নীল দলের আহবায়ক হিসেবে দায়িত্ব পালন অব্যাহত রাখতে পারেননি। তখন যুগ্ম-আহবায়ক ছিলেন অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ সামাদ (বর্তমানে উপ-উপাচার্য, প্রশাসন) এবং অধ্যাপক ড. কে এম সাইফুল ইসলাম খান (বর্তমানে স্যার এ এফ রহমান হলের প্রভোস্ট); আহবায়কের অনুপস্থিতিতে সিনিয়র যুগ্ম-আহবায়ক হিসেবে সামাদ স্যার তখন আহবায়কের দলীয় সকল দায়িত্ব পালন করেন এবং যুগ্ম-আহবায়ক হিসেবে সাইফুল স্যার তাঁকে সর্বান্তকরণে সহযোগিতা করেন।

ওয়ান ইলেভেনের সেই টালমাটাল সময়টাতে নীল দলের অধিকাংশ কর্মসূচি প্রণীত হতো কলাভবনের তৃতীয় তলায় ফারসি ভাষা ও সাহিত্য বিভাগ থেকে। নানান লেখালেখি, লিফলেট, দলীয় সভার দাওয়াতপত্রাদি, সংবাদ বিজ্ঞপ্তি, দলীয় কার্যক্রমের কৌশল ও কর্মপন্থা নির্ধারণ- এসব কাজ এ বিভাগ থেকে উপরিউক্ত দু’নেতার নির্দেশ মোতাবেক আমার মাধ্যমেই প্রস্তুত ও বিতরণ হতো। এর আগে-পরে বহু সময় নীল দলের সংশ্লিষ্ট লেখাটা শেষ করে নীলক্ষেত থেকে নীল কাগজে ফটোকপি করে পুরো বিশ্ববিদ্যালয়ের সকল অনুষদ ও ইনস্টিটিউটসমূহে দলের আঞ্চলিক দায়িত্বশীলদের হাতে পৌঁছে দেয়ার কাজটি আমি এককভাবেই সম্পন্ন করেছি। সেই অভিজ্ঞতার আলোকে বলি, অনেক জায়গায় তখন নীল কাগজটা গ্রহণ করার মতো লোক পাইনি, অনেকে এটি ধরবার সাহস টুকুও দেখাতে পারেননি; অনেকেই সতর্কতার সাথে নীল কাগজ আর নীল দলের সাথে কৌশলগত দূরত্ব বজায় রেখে চলেছেন এবং অধিকাংশই তৎকালীন ক্ষমতাসীনদের চাদরের নিচে আবৃত ছিলেন। যদিও তারা পরবর্তীতে আবারো সাদা ত্যাগ করে বা সাদা-ঘনিষ্ঠতা ছেড়ে নীলে ভিড়েছেন, সুযোগ-সুবিধা নিয়েছেন এমনকি নানান পদেও বসেছেন! সেই ২০০৯ থেকে ২০২১; খুবই লম্বা সময় এবং এখন আর কাউকেই তেমন নীলের বাইরে মনে হয় না! অথচ বিরোধী দলে আমরা নীল দলের সভায় ৭ থেকে সর্বোচ্চ ১৭ জনের উপস্থিতি দেখেছি; ২০০৮-এর ২৯ ডিসেম্বর জাতীয় নির্বাচনের পর নীল দলের প্রথম সভাতেই দেড় শতাধিক বিবেকবান শিক্ষকের উপস্থিতি দেখে হঠাৎ-ই চমকে উঠেছিলাম! আমার সেই চমকে উঠা এবং বিরোধী দলে থাকাকালীন নীল দলের স্বল্প-সংখ্যক আত্মপ্রত্যয়ী, ব্যক্তিত্ববান ও আত্মমর্যাদাসম্পন্ন নেতৃত্বের সাথে ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করার অভিজ্ঞতা থেকে ওয়ান ইলেভেন-এর সময়ে দেশ ও বিশ্ববিদ্যালয় বিষয়ে ইতোমধ্যেই বিস্মৃতির তলদেশে হারিয়ে যাওয়া কিছু কথা বলতে চাই।

তিন.
ততদিনে দেশে সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার চলে এসেছে। গণতন্ত্রের মানসকন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনাকে গ্রেফতার ও কারাগারে বন্দি করা হয়েছে। দেশ থেকে নির্বাচন, গণতন্ত্র ও আইনের শাসনকে দীর্ঘ-মেয়াদী নির্বাসনে পাঠানোর সকল বন্দোবস্ত করা হয়েছে। দেশের রাজনৈতিক নেতৃত্বকে অকার্যকর করে দেয়ার হীন অপপ্রয়াসে নানাবিধ মামলা, হামলা, হয়রানি ও গ্রেফতারের মাধ্যমে শাসকবর্গের ক্ষমতাকে প্রলম্বিত করে দীর্ঘস্থায়ী রূপদানের লক্ষ্যে সকল আয়োজন সম্পন্ন হয়েছে। ব্যবসায়ী, আমলা ও ধনাঢ্য ব্যক্তিবর্গকে নানা অপকৌশলে রাজনৈতিক শক্তির পেছনে লেলিয়ে দেয়া হয়েছে। এদের কাউকে কাউকে দিয়ে রাজনৈতিক নেতৃত্বের বিরুদ্ধে সাজানো মামলা রুজু করা হয়েছে; সর্বোপরি গোটা দেশে এক ত্রাসের রাজত্ব কায়েম হয়ে গিয়েছিল। সবাই নিজেকে নিয়ে, নিজেকে বাঁচাবার তাগিদেই যেন ব্যতিব্যস্ত ছিল; বিশেষ করে দীর্ঘদিনের পরীক্ষিত দেশপ্রেমিক রাজনৈতিক নেতৃবর্গেরও কেউ কেউ তাদের টোপ গিলেছিল।

আত্মরক্ষার স্বার্থে রাজনৈতিক নেতৃত্বসহ কেউই তখন ভয়ে মুখ খুলতে সাহস পাচ্ছিল না। জাতীয় জীবনে যখন এমনই এক বিপর্যয় নেমে এসেছিল তখনো কিন্তু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে চারদলীয় জোট সমর্থিত শিক্ষকেরাই প্রশাসনিক ক্ষমতায় বহাল তবিয়তেই ছিলেন। উপাচার্য, উপ-উপাচার্য, কোষাধ্যক্ষসহ সবই ছিল তাঁদের; বহু দেনদরবারের পরে শুধুমাত্র ৩টি হলে আমরা নীল দলের প্রভোস্ট দিতে পেরেছিলাম। সেই তিন হলের একটি ছিলো কবি জসীম উদ্দীন হল; আর তখন এ হলের প্রভোস্ট হিসেবে ছিলেন আজকের মাননীয় উপাচার্য অধ্যাপক ড. মো. আখতারুজ্জামান।

শুরু হলো দেশে তত্ত্বাবধায়ক নামের অন্ধকারের এক সরকারের সীমাহীন জুলুম-নিপীড়ন। জননেত্রী শেখ হাসিনা অমানবিক আচরণের শিকার হলেন। সারাদেশ যখন ভীত-সন্ত্রস্ত আর অজানা আতঙ্কে স্তব্ধ। রাজনীতিবিদগণ নিজেদের আমলনামার কারণে যখন যে যার মতো প্রাণ বাঁচাতে ব্যস্ত, আমরা কিছু সংখ্যক শিক্ষক তখন এসবের প্রতিবাদে কালো ব্যাজ ধারণ করে ক্লাসে যাই, অবস্থান ধর্মঘট করি এবং তীব্র প্রতিবাদ জানাই। দেশে মাইনাস টু ফর্মুলার আবির্ভাব ঘটলো এবং সেনা সমর্থনে দীর্ঘস্থায়ী এক ভূতুরে সরকার জগদ্দল পাথরের মতো চেপে বসার সকল আয়োজন অত্যন্ত চাতুর্যের সাথে সম্পন্ন করতে লাগলো। আক্রমণের শিকার হলো মহান মুক্তিযুদ্ধের সূতিকাগার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। গ্রেফতার হয়ে কারাবরণ করলেন আমার শিক্ষকেরা, নির্মম-পাশবিক নির্যাতনের শিকার হলো আমার প্রাণপ্রিয় শিক্ষার্থীরা। এরই ক্রমধারায় বাঙালির সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠ থেকেই ডাক এলো প্রতিরোধের।

আমরা সেদিন সংখ্যায় স্বল্প হলেও শীষাঢালা প্রাচীরের ন্যায় ঐক্যবদ্ধ ছিলাম। গণতন্ত্রের মুক্তি আর জাতীয় নির্বাচনের দাবিতে সমগ্র দেশে ছড়িয়ে পড়া আন্দোলনে অকুতোভয় নেতৃত্ব দিয়েছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। সেই আন্দোলনে নেতৃত্বদান ও অংশগ্রহণকারী শিক্ষকের সংখ্যা সামান্য ক’জন হলেও আমাদের মধ্যে ছিল সুদৃঢ় ঐক্য। পরবর্তী জাতীয় নির্বাচন পর্যন্ত বিভিন্ন ধাপে সুসম্পন্ন হয়েছিল আমাদের সিদ্ধান্তকৃত নানাবিধ কার্যসূচি। শিক্ষক সমিতির তলবি সভা, দেশরত্ন শেখ হাসিনাসহ কারাগারে আবদ্ধ শিক্ষকবৃন্দের মুক্তির দাবিতে ১৬৭ জন শিক্ষকের স্বাক্ষর সম্বলিত বিবৃতি, সমগ্র দেশব্যাপী অমানবিক নিষ্ঠুরতা আর পাশবিক নির্যাতনের প্রতিবাদে কলাভবনের শীর্ষ চূড়ায় প্রতিবাদের কালো পতাকা উত্তোলন, ক্যাম্পাস থেকে সেনা ছাউনি প্রত্যাহার- এগুলো সবই ছিলো সেই অহিংস অথচ ছাত্র-শিক্ষক সম্মিলনে প্রচণ্ড বেগবান ও আপোসহীন আন্দোলনের এক একটি বিজয়গাঁথা। মাত্র ৭ থেকে ১৭জনের সুদৃঢ় ঐক্য সেদিন আমাদের জাতীয় জীবনে বিশাল অর্জন এনে দিয়েছিলো।

চার.
আজ আমরা সংখ্যায় অনেক কিন্তু নিজেদের সেই ঐক্য সুদূরপরাহত। আমাদের সংখ্যা বাড়ার সাথে সাথে বেড়েছে বিভেদ, নিজেদের ক্ষুদ্র স্বার্থ চরিতার্থ করার জন্য বৃহত্তর স্বার্থ-সুরক্ষার বদলে আমরা বিসর্জন দিচ্ছি নীতি-নৈতিকতা আর মহান মূল্যবোধকে। মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ আর প্রাতিষ্ঠানিক স্বার্থকে সমুন্নত রাখার বদলে শুধুমাত্র নিজের প্রাপ্তি নিশ্চিতকরণ আর পার্শ্ববহর সম্প্রসারণে ঠাঁই দিচ্ছি অনুপ্রবেশকারীকে। ত্যাগী, পরীক্ষিত ও নৈতিকতার প্রশ্নে আপোসহীন মানুষজনকে দূরে ঠেলে অনৈক্যের আঁধার-ক্ষেত্রকেই আমরা ক্রমাগত পরিচর্যা করে চলেছি! এমতাবস্থায় আবারো ২৩ আগস্ট ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কালো দিবস আমাদের মাঝে সমুপস্থিত; এ দিবস স্মরণ করিয়ে দেয় আমাদের গৌরবজনক ঐতিহ্যকে, আমাদের আদর্শিক দৃঢ়তা আর বিজয়ের ঐকতানকে। স্বাধীন বাংলাদেশের ইতিহাসে সম্পূর্ণ অপ্রত্যাশিত সেনা-সমর্থিত তথাকথিত তত্ত্বাবধায়ক আমলের ভয়াবহ দুঃসময়ের যে কিঞ্চিৎ বিবরণ উপরে প্রদত্ত হলো- তার ভূক্তভোগী এক প্রত্যক্ষ সাক্ষী হিসেবে সংশ্লিষ্ট সকল মহলকে অনুরোধ করবো, আসুন, ব্যক্তিস্বার্থ আর পারস্পরিক বিভেদের দেয়াল ভেঙ্গে ভালোবাসা ও সম্প্রীতির সৌধমালা হতে নির্গত বারিধারায় সকলে অবগাহন করি।

সেই দুঃসময়ের ঐক্য-প্রক্রিয়ার অন্যতম কারিগর এবং দীর্ঘদিনের পরীক্ষিত শিক্ষক নেতৃবৃন্দই বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনায় নিয়োজিত রয়েছেন। অন্যদিকে এখন দেশ পরিচালনায় আছেন ওয়ান ইলেভেনে সবচাইতে বেশি নিগৃহীত ও নিপীড়িত মানুষটি; জাতির পিতার সুযোগ্য কন্যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে একুশ শতকের উপযোগী উন্নত, সমৃদ্ধ ও বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলা বিনির্মাণে আমরা যেন অকৃত্রিমভাবে নিজেদের সর্বোচ্চ অবদানটুকু রাখতে পারি। একইসাথে বাঙালির জ্ঞান ও প্রজ্ঞার শতবর্ষী বাতিঘর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে আমাদের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় শিক্ষা, গবেষণাসহ অন্যান্য বিষয়ে সমৃদ্ধ মানের দিক থেকে ইপ্সিত পর্যায়ে উপনীত করার ক্ষেত্রে সকলেই যেন সময়োপযোগী ও কার্যকর ভূমিকা পালন করি।

লেখক: সভাপতি, ফারসি ভাষা ও সাহিত্য বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়


সর্বশেষ সংবাদ