মাদকতার দেয়াল ভাঙো
- সজীব ওয়াফি
- প্রকাশ: ০৬ জুন ২০২১, ০৮:৪৬ PM , আপডেট: ০৬ জুন ২০২১, ০৮:৪৬ PM
এলএসডি। করোনা মহামারিকালেই দ্রব্যটি আতঙ্কের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। পুরো নাম লাইসার্জিক এসিড ডাইইথ্যালামাইড। দ্রব্যটি বিদেশে গবেষণাগারে ব্যবহৃত হলেও আমাদের দেশের বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া তরুণেরা মাদক হিসেবে গ্রহণ করে আত্মধ্বংস ডেকে এনেছেন। মাদকের বিরুদ্ধে অভিযানের পরেও এরূপ অবস্থা উদ্বেগের, উৎকণ্ঠার।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষার্থী নিজের গলায় ধারালো দা চালিয়ে আত্মহত্যার কথা পুলিশ বলার পর সামনে আসে এলএসডি। ঈদ পরবর্তী আট দিন নিখোঁজের পরে ঢাকা মেডিকেলের মর্গে মেলে তার লাশ। আত্মহত্যার কারণ তদন্ত শুরু করলে পুলিশ জানতে পারে এলএসডি ছড়িয়েছে মহামারির মতো। গণমাধ্যমে প্রচারিত ছবিতে দেখা গেল পুলিশ ভ্যানে এলএসডি সম্পৃক্ততার দায়ে গ্রেফতারকৃত তরুণদের হাস্যোজ্জ্বল চেহারা। অপরাধবোধের কোনো ছাপ নেই। অর্থাৎ তারা বোধশক্তি হারিয়ে মনে করেছেন তারা কোনো অপরাধ করেননি অথবা কোনো বিচার হবে না। দুঃখজনক, স্মার্ট চেহারাসুরতের হওয়ায় অনেকে আবার তাদের দেখে আকর্ষিতও হয়েছেন। আমাদের রুচি কোথায় গিয়ে ঠেকেছে! এর ফলে কি তরুণেরা আরো বেশি পরিমাণে মাদকতার দিকে ঝোঁকার সম্ভাবনা থাকে না?
এলএসডি সবাইকে সেবন করতে হবে এমনটাও না। নকশা জাতীয় কাগজের আড়ালের এলএসডি কারো সামনে ধরলেও নাকে মুখে যাবে। যে কেউ নেশাগ্রস্ত হবে। বলতে গেলে হতাশাগ্রস্ত হয়েই উচ্চশিক্ষিত তরুণেরা ঝুঁকেছে এরকম আত্মঘাতী মরণ নেশায়। সেবনের পরে হিতাহিত বোধশক্তি হারিয়ে ফেলে। কোনো নিয়ন্ত্রণ থাকে না। যা চিন্তা করবেন সেটাই করবে। অর্থাৎ ভালো মন্দ দুটোই কল্পনা করতে পারে এবং চোখের সামনে দেখতে পায়।
বেকারত্ব তরুণ সমাজকে হতাশাগ্রস্ত করছে দিনে দিনে। মাদক বিক্রি করে আয়ের একটা পথও চালু হয়। দীর্ঘদিন ধরে স্কুল-কলেজ বন্ধ। শিক্ষা কার্যক্রম অনুপস্থিত। এ কারণেও শিক্ষার্থীরা হতাশ হয়ে থাকতে পারে। নাহলে একজন আশাবাদী সুস্থ শিক্ষার্থী কেন আত্মহত্যা চক্রে যুক্ত হবে! তারা কেন সামাজিক বিশৃঙ্খলার পথে গিয়ে তাদের উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ দেখতে পেল না!
ক্রমে মাদকের বিস্তার এমন পর্যায়ে ছড়িয়েছে যে খুব সহজেই কিশোর গ্যাংগুলোর হাতে পৌছাচ্ছে। সহজলভ্য এবং দাম কমের উপর এটা নির্ভর করে। সীমান্ত এলাকা হয়ে, এমনকি দেশের অভ্যন্তরে মাদক প্রবেশে ব্যবহার হয় আন্তর্জাতিক যোগাযোগের রুট। এলএসডির একটা বড় অংশ প্রবেশ করে বিদেশ ফেরত শিক্ষার্থীর মাধ্যমে। পরে অনলাইন অফলাইনের নানান রকমের সিন্ডিকেটের মাধ্যমে সেবনকারীর হাতে পৌছায়। অন্যদিকে হেরোইনের দাম বেশি হওয়ায় প্রচলিত হয় গাঁজা ইয়াবার। বিশ্ববিদ্যালয়ে একজন জুনিয়র শিক্ষার্থী সিনিয়রদের সঙ্গ নিয়ে সেলিব্রেটি হওয়ায় নেশায় আসক্তের দিকে পা বাড়ায়। ছাত্র রাজনীতিরও প্রভাব ফেলে অনেকটা। এতে জড়িত হচ্ছে উচ্চবিত্ত, মধ্যবিত্ত এবং নিম্নবিত্ত পরিবারের ছেলে মেয়েরাও। নেশাগ্রস্ত হয়ে তেজস্ক্রিয়ায় মারা গেলে পত্রিকার পাতায় ভেসে আসে ফুড পয়জনিংয়ের খবর।
মাদক জাতীয় দ্রব্য বিক্রি করে বিপুল অঙ্কের টাকা আয় করা যায় রাতারাতি। অল্প সময়েই অর্থবিত্তে ফুলে ফেঁপে আঙ্গুল ফুলে কলাগাছ হওয়া যায়। ঢাকা ঘনবসতিপূর্ণ এলাকা হওয়ায় মাদকের বাজারও বড় এবং জটিলতাপূর্ণ। এলাকার প্রভাবশালী মহল জড়িত থাকায় অনুপস্থিত থাকে গুরুতর ব্যবস্থা বাস্তবায়ন করতে। এভাবেই গ্রাম পর্যায়েও ছড়িয়েছে মাদকের বিস্তার।
মাদক নির্মূলে প্রধানমন্ত্রীর জিরো টলারেন্স ঘোষণার পরে ২০১৮ সালের ৪ মে মাদক বিরোধী অভিযান শুরু হয়। ক্রসফায়ারে বেশকিছু সংখ্যক বিচারবহির্ভূত হত্যাকান্ড ঘটে। মাদক সেবনকারী এবং চুনোপুঁটি ব্যবসায়ী ধরপাকড় করলেও মাদক কারবারি গডফাদারেরা থেকে যায় ধরাছোঁয়ার বাইরে। এতে অভিযানের উদ্দেশ্য বা অর্জন কি হল? বরং সাময়িক সময়ে কিছুটা হ্রাস পেলেও হয়নি টেকসই কোনো ব্যবস্থা। ফলে কিছুদিনের ভেতরই আবার যোগান ফিরে এসেছে।
ঘটনাক্রমে মাদকের কুশীলবেরা ধরা পড়লেও জামিনে বেরিয়ে আসে। প্রভাবশালী মহল বেরিয়ে আসতে পারলেও কিছুদিনের জন্য বন্দি হয় চুনোপুঁটিরা। দ্বিতীয়ত, কারাগারগুলোতেও সংশোধনের কোনো ব্যবস্থা নেই। এমতাবস্থায় অভিযান চালিয়ে, শাস্তি দিয়ে বা মারধর করে কি মাদক নির্মূল সম্ভব? সংশোধনের ব্যবস্থা না থাকায় বরঞ্চ কারাগারে গিয়ে অপরাধীদের সাথে তৈরি হয় নতুন নতুন যোগাযোগ। বেরিয়ে এসে নতুন উপায়ে আবার তৈরি হয় বিষাক্ত ছোবল।
গণমাধ্যমগুলোতে বারবার প্রভাবশালীদের জড়িত থাকার অভিযোগ উঠলেও তাদের বিরুদ্ধে কেন ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি? দেশে মাদক আসল কিভাবে তার তদন্ত হয়নি কেন? চুনোপুঁটিদের পেছনে কে আছে সেটাও বিশ্লেষণ না হওয়ার কারণ কি? এলএসডি সারাদেশে মহামারি রূপে ছড়াল, গোয়েন্দা সংস্থাগুলো শুরুর পর্যায়ে সেটা জানতেই পারল না কেন? এসব প্রশ্নের সমাধান যতদিনে না হবে ততদিনে গাছের গোড়া কেটে আগায় পানি ঢালার মত পরিস্থিতি হবে। মোটকথা মাদকের জিরো টলারেন্স দেখাতে হলে মাদকের প্রতিটি স্তরে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করা বাধ্যতামূলক।
প্রকৃতপক্ষে মাদক নিরাময় এবং পুনর্বাসনে সরকারকে মনোযোগী হতে হবে। মনোযোগী হতে হবে পরিবারগুলোকে তাদের ছেলেমেয়েদের প্রতি সজাগ থাকতে। মাদকের সিন্ডিকেট ভেঙে দিতে সামাজিক সংহতি জরুরি হয়ে পড়েছে। নতুবা তরুণদের সাথে সাথে মাদকতায় বুঁদ হয়ে থাকবে বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ। মাদকাসক্তদের দিয়ে কোনো কিছুরই নেতৃত্ব দেওয়া যায় না, তরুণদের বোধোদয় হোক।
.
লেখক: রাজনৈতিক কর্মী ও বিশ্লেষক