করোনা সঙ্কট ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

  © টিডিসি ফটো

ইতিহাসের এক কঠিন বাস্তবতার মুখোমুখী আজ বিশ্ব মানব সমাজ। করোনা (কোভিড-১৯) নামের এক অতিক্ষুদ্রকায় অদৃশ্য ভাইরাসের সংক্রমনের ফলে সৃষ্ট ভয়ঙ্করতম মহামারীতে বিশ্বের দুই শতাধিক দেশ আজ চরম বিপর্যয়ের মুখে। করোনা এক ভয়াবহ সংক্রামক ভাইরাস। গত বছর ডিসেম্বর মাসে চীনের উহান শহরে করোনা ভাইরাস প্রথম শনাক্ত হলেও আধুনিক যোগাযোগ এবং বৈশ্বিক সামগ্রকিতার প্রভাবে দ্রুতই বিশ্বের প্রায় সর্বত্র এর দ্রুত বিস্তার ঘটে।

এর মধ্যেই বিশ্বব্যাপী এ ভাইরাসে আক্রান্তের সংখ্যা প্রায় ৬৯ লাখ এবং এবং মৃত্যুবরণকারীর সংখ্যা প্রায় চার লক্ষ। করোনার ভয়াল থাবায় আক্রান্ত বাংলাদেশে ৬ জুন পর্যন্ত আক্রান্তের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৬৩  হাজার ২৬ জনে এবং এর মধ্যে মৃত্যুবরণ করেছেন ৮৪৬ জন। প্রতিদিনই বাড়ছে আক্রান্তের সংখ্যা এবং দীর্ঘ হচ্ছে মৃত্যুর মিছিল।

চলমান করোনাভাইরাস মহামারী বিশ্ব সভ্যতাকে এক অভূতপূর্ব বাস্তবতার মুখোমুখি দাঁড় করিয়েছে। করোনার কোনো প্রতিষেধক বা কার্যকর চিকিৎসা ও ঔষধ না থাকায় ভয়াবহ সংক্রামক ব্যাধি থেকে বাঁচার জন্য মানুষকে সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখাসহ নানা সতর্কতা-বিধি মেনে চলতে হচ্ছে। আর এটি করতে গিয়ে মানুষের কর্মচঞ্চল যাপিত জীবন স্থবির হয়ে পড়েছে। চলমান সমাজ তার স্বাভাবিক গতি হারিয়ে ফেলেছে।

করোনা সংক্রমণ প্রতিরোধের জন্য অন্যান্য দেশের মতো বংলাদেশেও গত ২৫ মার্চ ২০০২ থেকে সাধারণ ছুটিসহ লকডাউন কার্যকর করা হয় এবং কয়েক দফায় তা ২৮ মে পর্যন্ত বৃদ্ধি করা হয়। এসময় দেশের সরকারি-বেসরকারি অফিস-আদালত, কলকারখানা ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের পাশাপাশি বন্ধ হয়ে গেছে সব ধরনের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। করোনা কেবল শ্বাসতন্ত্রকেই ছিন্নভিন্ন করছে না, অর্থনীতির চাকাকেও মন্থর করে দিয়েছে। মানুষ ঘরবন্দী হওয়া এবং শিল্প-কারখানা বন্ধ হওয়ার ফলে মানুষের জীবন ও জীবিকা আজ বড় চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন।

উন্নয়নশীল দেশে দুর্যোগ ও মহামারীর প্রভাবে প্রথমেই ভুক্তভোগী হয় শ্রমজীবী মানুষ। বাংলাদেশে অনানুষ্ঠানিক খাতের শ্রমজীবী মানুষের সংখ্যা ৫ কোটিরও বেশি। করোনার কারণে তাদের জীবন-জীবিকা থমকে যাওয়ায় মানবিক সঙ্কট ক্রমশ প্রকট আকার ধারণ করছে। করোনায় আক্রান্ত মানুষকে চিকিৎসা সেবা দেয়ার জন্য আমাদের দেশের চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীরা প্রথমসারীর সম্মুখ যোদ্ধা হিসেবে কাজ করছেন। মানুষের জীবন রক্ষায় সমানতালে ভূমিকা রাখছে প্রশাসন ও পুলিশ বাহিনীসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। অসহায় দরিদ্র ও কর্মহীন বিপন্ন মানুষকে রক্ষায় সরকারের নানামুখী তৎপরতার পাশাপাশি বেসরকারি সংগঠন, রাজনৈতিক দল ও সামাজিক সংগঠনসহ ব্যক্তি উদ্যোগেও চলছে মানবিক সহায়তা কার্যক্রম। যার যার অবস্থানে থেকে এ বৈশ্বিক মহাদুর্যোগ মোকাবিলায় প্রচেষ্টা চালানো হচ্ছে। এ ক্ষেত্রে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ও পিছিয়ে নেই।

বাংলাদেশের প্রাচীনতম, সর্ববৃহৎ এবং উপমহাদেশের অন্যতম প্রাচীন ঐতিহ্যবাহী উচ্চশিক্ষা ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। শুধু জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চা নয়, বরং বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জন থেকে শুরু করে স্বাধীন বাংলাদেশের প্রতিটি ইতিবাচক অর্জনে নেতৃত্বদানের গৌরবময় কৃতিত্বের অধিকারী বিদ্যাপীঠ আমাদের প্রিয় এ বিশ্ববিদ্যালয়। ইতিহাস বলে যে, বাংলাদেশের যেকোনো দুর্যোগ, বিপর্যয় ও সংকট মোকাবিলায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, শিক্ষার্থী, কর্মকর্তা, কর্মচারীগণ সবসময় নিজ নিজ অবস্থানে থেকে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন। এবারের করোনা সংকটকালেও এর ব্যতিক্রম হয়নি। করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ ও বিস্তাররোধে ১৮ মার্চ থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লাস ও অফিস বন্ধ করে দেয়া হয়। অবশ্য সরকারের ঘোষিত সিদ্ধান্ত অনুসারের ৩১ মে থেকে সীমিত পরিসরে অফিস খোলা হয়েছে।

করোনা সংক্রমণের কবল থেকে বিশ্ববিদ্যালয় পরিবারকে রক্ষার উদ্দেশ্যে শুরু থেকেই বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় কঠোরভাবে লকডাউন কার্যকর করা হয়েছে। আবাসিক এলাকাগুলোতে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের নির্বীজন (disinfection) কার্যক্রম পরিচালনা ও বহিরাগত প্রবেশ নিয়ন্ত্রণ ইত্যাদি সময়োচিত ও যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণের ফলে একজন শিক্ষককের দুঃখজনক মৃত্যু হলেও পরম করুণাময়ের কৃপায় বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস এলাকা এখন পর্যন্ত করোনা সংক্রমণের ভয়াবহতা থেকে অনেকটাই মুক্ত আছে।

করোনাভাইরাস বিপর্যয়-উত্তরণে মানবিক সহায়তা কার্যক্রমে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক, শিক্ষার্থী ও কর্মকর্তা-কর্মচারীগণ শুরু থেকে নানাভাবে অংশ নিচ্ছেন। এজন্য শিক্ষক ও কর্মকর্তাগণ তাঁদের দুদিনের বেতনের টাকা অনুদান হিসেবে প্রদান করেছেন। প্রদত্ত দুদিনের বেতনের টাকার সাথে পহেলা বৈশাখে আবাসিক হলসমূহে শিক্ষার্থীদের উন্নত খাবার সরবরাহের জন্য বরাদ্দকৃত অর্থ যুক্ত করে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর ত্রাণ তহবিলে ১ কোটি ৩৬ লাখ ৯৩ হাজার ৩শ ৮০ টাকা অনুদান প্রদান করা হয়েছে। উপাচার্য অধ্যাপক ড. মো. আখতারুজ্জামান গত ১৫ এপ্রিল বিশ্ববিদ্যালয় পরিবারের পক্ষ থেকে প্রধানমন্ত্রীর ত্রাণ ও কল্যাণ তহবিলে এ টাকার চেক হস্তান্তর করেছেন।

করোনা সংক্রমণ মোকাবিলায় করণীয় নির্ধারণ ও বাস্তবায়নের জন্য জিন প্রকৌশল ও জীবপ্রযুক্তি বিভাগ, প্রাণরসায়ন ও অণুপ্রাণ বিজ্ঞান বিভাগ এবং অণুজীব বিজ্ঞান বিভাগ-এর সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞ শিক্ষক ও গবেষকদের নিয়ে “করোনাভাইরাস (কোভিড-১৯ মহামারী) রেসপন্স কো-অর্ডিনেশন” কমিটি এবং একটি “টেকনিক্যাল কমিটি” গঠন করা হয়েছে। করোনা সনাক্তকরণে জাতির চাহিদা মোতাবেক প্রয়োজনীয় বিশেষজ্ঞ, দক্ষ জনবল, প্রশিক্ষণ ও ল্যাব সুবিধা দিয়ে সরকারকে সহায়তাদানের জন্য বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রস্তাব দেয়া হয়।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বায়োমেডিক্যাল রিসার্চ সেন্টার, ফার্মেসী অনুষদ, ফলিত রসায়ন ও কেমিকৌশল বিভাগ ও রসায়ন বিভাগ নিজস্ব অর্থায়নে “হ্যান্ড স্যানিটাইজার” প্রস্তুত করে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের মাঝে বিনামূল্যে বিতরণ করে। নববর্ষে মঙ্গল শোভাযাত্রার জন্য বরাদ্দকৃত অর্থে চারুকলা অনুষদ করোনাভাইরাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী চিকিৎসক এবং স্বাস্থ্যকর্মীদের সুরক্ষা নিশ্চিত করতে ফেস-শিল্ড তৈরি করে তা বিনামূল্যে বঙ্গবন্ধু মেডিকেল ইউনিভার্সিটিসহ বিভিন্ন মেডিকেল কলেজ, হাসপাতাল, ক্লিনিক এবং স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্রে বিতরণ করে। ফেস-শিল্ড প্রস্তুত ও ব্যবহার বিষয়ে চিকিৎসাকর্মীদের জন্য এ অনুষদ থেকে একটি প্রশিক্ষণ কর্মশালারও আয়োজন করা হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বায়োমেডিকেল ফিজিক্স এন্ড টেকনোলজি বিভাগ তার উদ্ভাবিত প্রযুক্তি দিয়ে পরিচালিত “টেলিমেডিসিন কার্যক্রম”-এর মাধ্যমে জনসাধারণকে চিকিৎসা-পরামর্শ সেবা প্রদানের ব্যবস্থা করে। এ কাজে বেসরকারি আইপি টেলিফোন কোম্পানি বিডিকম অটো-হান্টিং টেলিফোন সুবিধা প্রদান করে।

আমাদের বেশিরভাগের মানুষের কাছেই করোনা ও তৎজ্জনিত পরিস্থিতি এক ভয়ঙ্কর নতুন অভিজ্ঞতা। লকডাউন ও সাধারণ ছুটিজনিত কারণে ঘরবন্দী জীবন, নিজের ও পরিবারের সদস্যদের নিরাপত্তা, অনাগত ভবিষ্যৎ এবং উদ্ভূত পরিস্থিতিতে করণীয়-এসব নিয়ে সাধারণ মানুষ এমনকি বিশেষজ্ঞরাও অনিশ্চয়তায় ভুগছেন। এ পরিস্থিতিতে কেবল শারিরীকভাবে সুস্থ থাকা নয়, তেমনি মানসিক স্বাস্থ্য সুরক্ষা করাও অতীব জরুরি ও গুরুত্বপূর্ণ। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ইতোমধ্যেই সদস্য রাষ্ট্রগুলোকে মানসিক স্বাস্থ্য ও মনো-সামাজিক সহায়তার বিষয়টি করোনা মোকাবিলার পরিকল্পনায় অন্তর্ভুক্ত করতে তাগিদ দিয়েছে। ভালো মানসিক স্বাস্থ্য কার্যকারী সমাজের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। মানসিক স্বাস্থ্য ভালো রাখার জন্য যদি পদক্ষেপ না নেওয়া হয় তাহলে বিশ্বকে শারিরীক স্বাস্থ্য সংকটের পাশাপাশি মানসিক স্বাস্থ্য সংকটেরও মোকাবিলা করতে হবে বলে জাতিসংঘের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে। মানসিক স্বাস্থ্য সুরক্ষার এ প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ও এগিয়ে এসেছে। মানসিক স্বাস্থ্যের যত্নে বাংলাদেশ ক্লিনিক্যাল সাইকোলজি সোসাইটি (বিসিপিএস), ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লিনিক্যাল সাইকোলজি বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং টেলিসাইকিয়াট্রি রিসার্চ অ্যান্ড ইনোভেশন নেটওয়ার্ক (টিআরআইএন)-এর যৌথ উদ্যোগে সবার জন্য বিনামূল্যে মানসিক স্বাস্থ্য সহায়তা প্রদানের ব্যবস্থা করা হয়েছে। ফোন ও ইমেইলের মাধ্যমে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থী ছাড়াও যেকোনো মানুষ এ সেবা নিতে পারবেন। এই সেবা নিশ্চিত করতে বাংলাদেশ ক্লিনিক্যাল সাইকোলজি সোসাইটি এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লিনিক্যাল সাইকোলজি বিভাগের ৭২ জন ক্লিনিক্যাল সাইকোলজিস্ট স্বেচ্ছায় সেবা দিতে এগিয়ে এসেছেন।

করোনা সনাক্তকরণ পরীক্ষা বাংলাদেশে বেশ কঠিন। এখন পর্যন্ত এ বিষয়ে আমাদের দেশে দৈনিক সক্ষমতা কাঙ্খিত মাত্রা অর্জন করতে পারেনি। এক্ষেত্রেও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় তার সামর্থ্য নিয়ে সরকারকে সহায়তা দিয়েছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সেন্টার ফর অ্যাডভান্সড রিসার্চ ইন সায়েন্সেস (কারাস) ভবনে স্থাপন করা হয়েছে একটি অত্যাধুনিক পিসিআর ল্যাব। উপাচার্য অধ্যাপক ড. মো. আখতারুজ্জামান গত ৫ মে করোনার নমুনা পরীক্ষার মধ্যদিয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে ল্যাবটি উদ্বোধন করেন। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের দেওয়া কিট, পার্সোনাল প্রটেক্টিভ ইকুইপমেন্ট এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের আর্থিক খরচ ও সেচ্ছাসেবীদের দিয়ে ৩১ মে পর্যন্ত এ ল্যাবে প্রতিদিন প্রায় চার’শ করে করোনাভাইরাস নমুনা (Sample) পরীক্ষা করা হয়েছে।

মহামারী করোনার জিন রহস্য উন্মোচনে বিশ্বব্যাপী গবেষকগণ নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছেন। বাংলাদেশেও এ প্রচেষ্টা শুরু হয়েছে। এক্ষেত্রেও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ইতোমধ্যে সাফল্যের স্বাক্ষর রেখেছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের করোনাভাইরাস রেসপন্স টেকনিক্যাল কমিটির আহবায়ক ড. শরীফ আখতারুজ্জামানের নেতৃত্বে প্রাণরসায়ন ও অনুপ্রাণ বিজ্ঞান বিভাগ, জীন প্রকৌশল ও জীব প্রযুক্তি বিভাগ, অণুজীব বিজ্ঞান বিভাগ এবং সেন্টার ফর অ্যাডভান্সড রিসার্চ ইন সায়েন্সেস-এর বিশেষজ্ঞ শিক্ষক ও বিজ্ঞানীগণ বিশ্ববিদ্যালয়ে স্থাপিত কোভিড-১৯ ল্যাবে সংগৃহীত নমুনা থেকে পাঁচটি ভাইরাসের জেনোম সিকোয়েন্সিং সম্পন্ন করেছেন। এই সিকোয়েন্স ডাটা ইনফ্লুয়েঞ্জা ভাইরাসের আন্তর্জাতিক তথ্য ভান্ডার Global Initiative on Sharing All Influenza Data (GISAID) কর্তৃক গৃহীত হয়েছে। এই জেনোম সিকোয়েন্সিং বাংলাদেশে চলমান করোনাভাইরাস মহামারীর গতিপ্রকৃতি, উৎস, জিনগত বৈশিষ্ট্যের পরিবর্তন এবং এই ভাইরাসের বিরুদ্ধে কার্যকর ঔষধ ও ভ্যাকসিন তৈরিতে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখবে। উল্লেখ্য যে, প্রয়োজনীয় অর্থসংস্থান সাপেক্ষে ধাপে ধাপে আরো ১০০টি ভাইরাসের জেনোম সিকোয়েন্সিং এর লক্ষ্য নিয়ে কাজ করে যাচ্ছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিশেষজ্ঞ বিজ্ঞানীগণ।

করোনা পরিস্থিতিতে ঘর বন্দী জীবনে বিশেষ চাহিদা সম্পন্ন শিশুরা (Special Child)। বিশেষ করে যাদের Speech Therapy-এর প্রয়োজন হয় তারা থেরাপিস্টের পরামর্শ বা সেবা নিতে পারছেন না। করোনা মহামারীর সময়ে বিশেষ শিশুদের জন্য Speech ও Language ভাষা Therapy বিষয়ক টেলিথেরাপি সেবা দেবে “কথাবন্ধু”। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের যোগাযোগ বৈকল্য বিভাগের যোগাযোগ বৈকল্য বিভাগের Speech and Language Therapist-দের সমন্বয়ে চালু করা হয়েছে এ বিশেষ সেবা। এর মাধ্যমে অভিভাবকরা ফোন করে পরামর্শ নিতে পারবেন এবং বিশেষ চাহিদা সম্পন্ন শিশুদের দৈনন্দিন রুটিনের সামষ্টিক সমস্যাসমূহ উল্লেখপূর্বক সমাধান পেতে পারেন। এর পাশাপাশি ভাষিক যোগাযোগের ক্ষেত্রে সীমাবদ্ধতা রয়েছে এমন সব বয়সী মানুষের Speech Therapy সংক্রান্ত সেবা দেবে কথাবন্ধুর Speech and Language  Pathologist-গণ।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বর্তমানে দক্ষিণ এশিয়ার অন্যতম বৃহৎ বিশ্ববিদ্যালয়। এতে এখন শিক্ষার্থী সংখ্যা ৩৭ হাজারেরও বেশি। এ শিক্ষার্থীদের মধ্যে শতকরা ৬৫ শতাংশই গ্রাম ও মফস্বল থেকে আসা। শিক্ষার্থীদের মধ্যে আর্থিকভাবে অসচ্ছল শিক্ষার্থীর সংখ্যাও প্রচুর। এরা মূলত টিউশনি বা পার্টটাইম জব করে জীবন নির্বাহ এবং লেখাপড়া চালান। এমনকি অনেক শিক্ষার্থী নিজের ব্যয় বহনের পর পরিবারের আংশিক খরচ জোগান। বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ হয়ে যাওয়ায় এসব শিক্ষার্থীর টিউশনি ও পার্টটাইম চাকরি বন্ধ হয়ে গেছে। তাদের সকলেই এখন গ্রামে নিজ পরিবারের সাথে বসবাস করছেন। গ্রামে তাদের কোনো কাজ ও আয়-রোজগার নেই। এ অবস্থায় জীবন সংগ্রামের নানা চড়াই-উৎরাই পার করে চলা এসব শিক্ষার্থী ও তাদের পরিবারের জীবন কঠিন সংকটে পড়েছে। শিক্ষক, শিক্ষার্থী, কর্মকর্তা-কর্মচারীদের নিয়েই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি পরিবার। এ পরিবারের সদস্যদের দুঃখ-কষ্টে সমব্যথী হয়ে তাদের পাশে দাঁড়ানো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি সুমহান ঐতিহ্য।

এবারের করোনা দুর্যোগেও এর ব্যত্যয় হয়নি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় অ্যালমানাই এসোসিয়েশনের সহযোগিতায় ইতোমধ্যেই এক হাজার শিক্ষার্থীকে নগদ এককালীন অর্থ সহায়তা প্রদান করা হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রায় প্রতিটি বিভাগ ও ইনস্টিটিউটের শিক্ষকগণের ব্যক্তিগত অনুদান ও সংশ্লিষ্ট বিভাগের প্রাক্তন শিক্ষার্থীদের সহায়তায় কয়েক হাজার অস্বচ্ছল শিক্ষার্থীর পরিবারকে আর্থিক অনুদান প্রদান করা হয়েছে এবং এ কার্যক্রম অব্যাহত আছে। ডাকসু, বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্রিয়াশীল বিভিন্ন ছাত্র সংগঠন, ডিবেটিং সোসাইটি, ঢাবি রোভার গ্রুপ (ডুপসেফ) ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় মাইম অ্যাকশন (ডুমা) সহ বিভিন্ন শিক্ষার্থীদের বিভিন্ন সংগঠন অসহায়, নিরন্ন মানুষকে খাদ্যসহায়তা প্রদানসহ নানাভাবে সহায়তা দিয়ে আসছে। ডাকসু সদস্য তানভীর হাসান সৈকতের ব্যক্তিগত প্রয়াস ইতোমধ্যে সকলের প্রশংসা কুড়িয়েছে। টিএসসি এলাকায় ঈদের দিন দুহাজার মানুষের খাবার প্রদানসহ গত দুই মাস ধরে তিনি অভাবী মানুষকে দুই বেলা খাবার দিয়ে যাচ্ছেন। এরূপ আরো অনেক শিক্ষার্থী ব্যক্তিগত উদ্যোগে এমনকি তাদের টিউশন থেকে জামানো টাকা দিয়েও অসহায় মানুষদের সহায়তা দিয়ে মানবিকতার অনন্য নজির স্থাপন করেছেন।

একদিন করোনা দুর্যোগ শেষ হবে, বিশ্ববিদ্যালয় আবার খুলবে, শিক্ষার্থীদের পদচারণায় মুখরিত হবে প্রিয় ক্যাম্পাস। তবে করোনা পরবর্তী সময়ে শিক্ষার্থীদের স্বাস্থ্য ঝুঁকির কথাও বিবেচনায় রাখতে হবে। এ লক্ষ্যে হলগুলোতে গণরুম বন্ধসহ সকল মিক্ষার্থীর জন্য স্বাস্থ্য বীমা প্রবল্প চালুর সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। ন্যূনতম প্রিমিয়ামে শিক্ষার্থীদের বিভিন্ন হাসপাতালে চিকিৎসা সেবা প্রাপ্তির লক্ষ্যে নীতিমালা প্রণয়নের জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের কোষাধ্যক্ষকে সভাপতি করে ৬ সদস্য বিশিষ্ট একটি কমিটি গঠন করা হয়।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আমাদের আলোর বাতিঘর। সম্প্রতি বৈশ্বিক র‌্যাংকিং-এ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অবস্থান এবং এর শিক্ষা ও গবেষণার মান নিয়ে সমালোচনা রয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ে মুক্তবুদ্ধি চর্চা ও ভিন্ন মত দলনের বিষয়েও বিতর্ক আছে। এসব সমালোচনা যে অমূলক এমনটা বলার কোনো অবকাশ নেই। বাংলাদেশের বর্তমান রাজনীতি ও আর্থ-সামাজিক অবস্থার প্রতিফলন বিশ্ববিদ্যালয়ের অঙ্গনে বিরাজিত আছে, তা অস্বীকার করার উপায় নেই। এসব সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও আমাদের জাতীয় জীবনের প্রায় সকল দুর্যোগ-দুর্বিপাকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ঐতিহাসিক ভূমিকা পালনের যে ইতিহাস ও ঐতিহ্য রয়েছে এবারের নভেল করোনাভাইরাসের মহামারী দুর্যোগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় তা আরেকবার প্রমাণ করেছে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে কেন এখনো অনলাইন শিক্ষা কার্যক্রম শুরু হয়নি- এ নিয়েও কোনো কোনো মহল থেকে সমালোচনা করা হচ্ছে। অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে এ ব্যাপারে হয়তো সিদ্ধান্ত নিতে হবে। এ জাতীয় দুর্যোগ মোকাবিলায় বিশ্ববিদ্যালয় এ যাবৎ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় পরিবার যেটুকু কাজ করেছে অনলাইন ক্লাস চালু করার থেকে এর গুরুত্ব কম নয়। অতীতেও রাজনৈতিক বা প্রাকৃতিক দুর্যোগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা কার্যক্রম ব্যহত হওয়ার নজির রয়েছে। আর সেগুলো কীভাবে পুষিয়ে নিতে হয় তাও এ বিশ্ববিদ্যালয়ের জানা আছে। জীবনের জন্যই শিক্ষা, শিক্ষার জন্য জীবন নয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় তার শিক্ষার্থী ও তাদের পরিবার এবং দেশের অসহায় সাধারণ মানুষের জীবন রক্ষায় তার সীমিত শক্তি নিয়ে কাজ করে যাচ্ছে। আমাদের শিক্ষার্থীরা সুস্থ্য থেকে আমাদের মাঝে ফিরে এলে তাদের শিক্ষা জীবনের এ ক্ষতি পুষিয়ে নিতে সর্বাত্মকভাবে চেষ্টা করবে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও প্রশাসন। প্রয়োজনে ঐচ্ছিক ছুটি বাতিল করে এবং সাপ্তাহিক ছুটির দিনে ক্লাস ও পরীক্ষা গ্রহণ করে সেশনজট ডিনরসনে কাজ করতে অনাগ্রহী হবেন শিক্ষকগণ- এটি আমার বিশ্বাস। “Together we fight, Together we live” এ ব্রত নিয়েই এগিয়ে যাবে আমাদের প্রিয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

লেখক: অধ্যাপক, ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়


সর্বশেষ সংবাদ