পে-কমিশনের কাছে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের প্রাজ্ঞ আহবান
- ড. মোর্ত্তুজা আহমেদ
- প্রকাশ: ১৮ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ০২:০৫ PM , আপডেট: ১৮ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ০২:০৮ PM
বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা দেশের উচ্চশিক্ষার মূল চালিকাশক্তি। তারা শুধু পাঠদানই করেন না, বরং গবেষণা পরিচালনা, শিক্ষার্থী মেন্টরিং, নতুন জ্ঞান সৃষ্টি এবং আন্তর্জাতিক অঙ্গনে দেশের ভাবমূর্তি উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য, বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের বেতন ও সুবিধা এখনো আন্তর্জাতিক মানের তুলনায় অনেক পিছিয়ে। এই ব্যবধান শুধু শিক্ষকের জীবনে অনিশ্চয়তা তৈরি করে না, বরং প্রতিভাবানদের শিক্ষকতা পেশায় আসতেও নিরুৎসাহিত করে।
সম্প্রতি সরকারের উদ্যোগে পে-কমিশন গঠনের খবর শিক্ষাক্ষেত্রে নতুন আশার সঞ্চার করেছে। এটি বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের জন্য একটি যুগোপযোগী, স্বচ্ছ এবং মর্যাদাপূর্ণ বেতন কাঠামো প্রণয়নের সুযোগ। শিক্ষক সমাজের প্রত্যাশা হলো—এই পে-কমিশন যেন এমন একটি কাঠামো তৈরি করে, যা শিক্ষকদের আর্থিক নিরাপত্তা দেবে, গবেষণায় উৎসাহিত করবে এবং আন্তর্জাতিক মানের শিক্ষা পরিবেশ গড়ে তুলতে সহায়ক হবে।
প্রথমত, বেসিক বেতন ও প্রমোশনের কাঠামোতে বড় ধরনের সংস্কার আনা জরুরি। শিক্ষকের অভিজ্ঞতা, গবেষণা কার্যক্রম এবং একাডেমিক অর্জনের ভিত্তিতে ধাপে ধাপে বেতন বৃদ্ধি হওয়া উচিত। বিশেষ করে, অনার্স ও মাস্টার্স পর্যায়ে প্রথম শ্রেণী অর্জনকারী শিক্ষকদের চাকরির শুরুতেই চারটি ইনক্রিমেন্ট প্রদান করা হলে, এটি শিক্ষার্থীদের উৎকর্ষ সাধনে উৎসাহিত করবে। একইভাবে, পিএইচডি ডিগ্রিধারীদের জন্য তিনটি এবং পোস্ট-ডক সম্পন্নকারীদের জন্য অতিরিক্ত আরও তিনটি ইনক্রিমেন্ট দেওয়া হলে শিক্ষকদের উচ্চতর ডিগ্রি অর্জনে প্রেরণা বাড়বে। এর ফলে শুধু শিক্ষকরা নয়, পুরো শিক্ষা ব্যবস্থাই সমৃদ্ধ হবে। এ পদক্ষেপ মেধাবীদের শিক্ষকতা পেশায় আকৃষ্ট করতেও সহায়ক হবে।
একটি দুঃখজনক বাস্তবতা তুলে ধরা জরুরি। দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে একমাত্র বাংলাদেশেই বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের বেতন সবচেয়ে কম। শুধু বেতনই নয়, প্রায় সব ধরনের সুযোগ-সুবিধাতেও আমরা পিছিয়ে। এর ফলে শিক্ষকতা পেশা এখন আর মেধাবীদের কাছে আকর্ষণীয় নয়। তারা সরকারি-বেসরকারি অন্যান্য পেশায় বা বিদেশমুখী হতে আগ্রহী হচ্ছে। যদি এ ধারা অব্যাহত থাকে, তবে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে মেধাবী শিক্ষক পাওয়া কঠিন হবে। প্রশ্ন হলো—আপনারা কি চান না আপনাদের সন্তান দেশের সবচেয়ে মেধাবী শিক্ষকদের কাছ থেকেই জ্ঞান অর্জন করুক? যদি শিক্ষকতা পেশা আকর্ষণীয় না হয়, তবে মেধাবীরা এই পেশায় আসবে কেন?
দ্বিতীয়ত, ভাতা ও সুবিধার প্রসার ঘটাতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয়ের উচ্চপদস্থ শিক্ষকদের জন্য গাড়ি সুবিধা থাকা প্রয়োজন। কারণ প্রশাসনিক কাজ, বিভিন্ন সভা, গবেষণা কার্যক্রম ও বাইরের একাডেমিক দায়িত্ব পালনে এটি অপরিহার্য। গবেষণা ও প্রকাশনার জন্য আন্তর্জাতিক জার্নালে প্রবন্ধ প্রকাশের ফি বরাদ্দ থাকা উচিত, যা বর্তমানে শিক্ষকদের নিজেদের অর্থেই বহন করতে হয়। এছাড়া জাতীয় ও আন্তর্জাতিক কনফারেন্সে অংশগ্রহণের জন্য আলাদা কনফারেন্স ফি প্রদান করা প্রয়োজন। বই, অনলাইন রিসোর্স এবং সফটওয়্যার কেনার জন্য ‘বুক অ্যালাউন্স’ নিশ্চিত করতে হবে।
তৃতীয়ত, ডিজিটাল যুগে শিক্ষাদান ও গবেষণার জন্য প্রযুক্তিগত সহায়তা অপরিহার্য। তাই ইন্টারনেট ও মোবাইল অ্যালাউন্স বাড়ানো উচিত। বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকরা প্রায়ই অনলাইন ক্লাস, গবেষণা যোগাযোগ, আন্তর্জাতিক নেটওয়ার্কিং এবং শিক্ষার্থীদের সাথে ভার্চুয়াল মিটিং পরিচালনা করেন। এ খাতে ব্যয়ভার বহনের জন্য একটি নির্দিষ্ট ভাতা তাদের জন্য স্বস্তিদায়ক হবে।
চতুর্থত, স্বাস্থ্য, আবাসন ও সামাজিক নিরাপত্তা শিক্ষকদের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। উন্নত বিশ্বে শিক্ষকদের জন্য স্বাস্থ্যবীমা ও মেডিকেল সুবিধা নিশ্চিত করা হয়। বাংলাদেশেও শিক্ষকদের জন্য একটি কার্যকর হেলথ ইন্স্যুরেন্স স্কিম চালু করা জরুরি। একইভাবে, বড় শহরে শিক্ষকরা বাসস্থানের ক্ষেত্রে সমস্যায় পড়েন। তাই হাউজিং বা হাউস রেন্ট অ্যালাউন্স বাড়ানো উচিত। অবসরের পর আর্থিক নিরাপত্তার জন্য পেনশন সুবিধা ও অন্যান্য সেবা-পরবর্তী সুবিধা নিশ্চিত করা অপরিহার্য।
পঞ্চমত, প্রণোদনা ও বোনাসের মাধ্যমে শিক্ষকদের উদ্যমী রাখা সম্ভব। নতুন কোর্স উদ্ভাবন, শিক্ষার্থী মেন্টরিং, গবেষণা পরিচালনা এবং আন্তর্জাতিক মানের অর্জনের জন্য বিশেষ প্রণোদনা দেওয়া যেতে পারে। বছরে অন্তত একবার একাডেমিক পারফরম্যান্সের ভিত্তিতে বোনাস প্রদান শিক্ষকদের উৎসাহ বাড়াবে এবং মানসম্পন্ন গবেষণাকে এগিয়ে নেবে। যেমন কোন শিক্ষক যদি কিউ-ওয়ান জার্নালে কোন গবেষণা প্রবন্ধ প্রকাশ করতে পারে, তাহলে তাকে ১ লাখ টাকা বোনাস দেওয়া যেতে পারে। এতে শিক্ষকরা অন্য কোনো আয়ের প্রতি আগ্রহ হারাবে এবং গবেষণামুখী হবে।
আরও পড়ুন: বেসরকারি শিক্ষকদের ভাতা বাড়াতে অর্থ উপদেষ্টাকে শিক্ষা উপদেষ্টার চিঠি
এখানে একটি দুঃখজনক বাস্তবতা তুলে ধরা জরুরি। দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে একমাত্র বাংলাদেশেই বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের বেতন সবচেয়ে কম। শুধু বেতনই নয়, প্রায় সব ধরনের সুযোগ-সুবিধাতেও আমরা পিছিয়ে। এর ফলে শিক্ষকতা পেশা এখন আর মেধাবীদের কাছে আকর্ষণীয় নয়। তারা সরকারি-বেসরকারি অন্যান্য পেশায় বা বিদেশমুখী হতে আগ্রহী হচ্ছে। যদি এ ধারা অব্যাহত থাকে, তবে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে মেধাবী শিক্ষক পাওয়া কঠিন হবে। প্রশ্ন হলো—আপনারা কি চান না আপনাদের সন্তান দেশের সবচেয়ে মেধাবী শিক্ষকদের কাছ থেকেই জ্ঞান অর্জন করুক? যদি শিক্ষকতা পেশা আকর্ষণীয় না হয়, তবে মেধাবীরা এই পেশায় আসবে কেন?
বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের বঞ্চনার একটি বাস্তব উদাহরণ এখানে প্রাসঙ্গিক। সাবেক ইউজিসি চেয়ারম্যানের কাছ থেকে শোনা একটি ঘটনা—বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব প্রফেশনালসে (বিইউপি) এক ব্রিগেডিয়ারকে ডিন হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়। যোগদানের পরপরই তিনি ভিসির কাছে গাড়ি সুবিধার অনুরোধ করেন। কিন্তু ভিসি তাকে জানান, ডিনদের জন্য সরকারিভাবে কোনো গাড়ি সুবিধা নেই। তখন সেই ব্রিগেডিয়ার বিস্মিত হয়ে বলেন—‘তাহলে আমাকে পনিশমেন্ট পোস্টিং দেওয়া হয়েছে?’ ভেবে দেখুন, যেখানে একজন উপসচিব, ইউএনও, থানার ওসি, বন কর্মকর্তা বা পুলিশ কর্মকর্তার গাড়ি সুবিধা থাকে, সেখানে প্রথম থেকে তৃতীয় গ্রেডের একজন অধ্যাপক—যিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিন—তার কোনো গাড়ি সুবিধা নেই। এ থেকে স্পষ্ট বোঝা যায়, বিশ্ববিদ্যালয়কে আমরা কোন পর্যায়ে রেখেছি!
শিক্ষকদের জন্য মর্যাদাপূর্ণ বেতন ও সুবিধা কেবল তাদের স্বার্থ রক্ষার বিষয় নয়, এটি দেশের ভবিষ্যৎ গড়ার অন্যতম হাতিয়ার। কারণ শিক্ষকই একজন শিক্ষার্থীর চিন্তাধারা গড়ে তোলেন, তাকে জ্ঞানচর্চায় উদ্বুদ্ধ করেন এবং সঠিক পথে পরিচালিত করেন। তাই শিক্ষকের আর্থিক অনিশ্চয়তা দূর করা মানে শিক্ষা ব্যবস্থাকে শক্তিশালী করা।
অতএব, সরকারের কাছে আমাদের সুস্পষ্ট আহবান—পে-কমিশন যেন শুধু একটি বেতন কাঠামো তৈরি না করে, বরং একটি আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন, গুণনিষ্ঠ এবং গবেষণা-উৎসাহব্যঞ্জক কাঠামো প্রণয়ন করে। অনার্স-মাস্টার্সে প্রথম শ্রেণির জন্য চারটি ইনক্রিমেন্ট, পিএইচডির জন্য তিনটি এবং পোস্ট-ডকের জন্য অতিরিক্ত তিনটি ইনক্রিমেন্ট প্রদানের সুপারিশ অবশ্যই বিবেচনায় আনা উচিত। পাশাপাশি গাড়ি সুবিধা, প্রকাশনা ফি, কনফারেন্স ফি, বই ও শিক্ষাসামগ্রী ভাতা, ইন্টারনেট ও মোবাইল অ্যালাউন্স, স্বাস্থ্য ও আবাসন সুবিধা, পেনশন এবং প্রণোদনা অন্তর্ভুক্ত করতে হবে।
বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকরা শুধু ক্লাসরুমেই জ্ঞান বিতরণ করেন না, তাঁরা গবেষণা করেন, সমাজের সমস্যার সমাধান খোঁজেন, নতুন জ্ঞান সৃষ্টি করেন। অথচ তাদের বেতন-ভাতা ও সুবিধা রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে উপেক্ষিত। এখন সময় এসেছে, পে-কমিশন একটি যুগোপযোগী, বাস্তবসম্মত ও মর্যাদাপূর্ণ বেতন কাঠামো প্রস্তাব করবে।
আজ যদি আমরা শিক্ষকদের সম্মান না করি, তবে আগামীকাল আমাদের সন্তানরা মেধাহীন শিক্ষকদের কাছে পড়তে বাধ্য হবে। রাষ্ট্র কি সেই ঝুঁকি নিতে চায়? তাই এখনই উদ্যোগ নিতে হবে—শিক্ষকদের সম্মান, বেতন, ভাতা ও সুবিধা নিশ্চিত করার মাধ্যমে একটি উন্নত ও জ্ঞানভিত্তিক বাংলাদেশ গড়ে তোলার জন্য।
লেকক: সহযোগী অধ্যাপক, ব্যবসায় প্রশাসন ডিসিপ্লিন,
খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়
ইমেইল: amm203@gmail.com