‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ ঘিরে বিতর্ক, আসল উদ্দেশ্য কী?

রাজু নূরুল
রাজু নূরুল  © টিডিসি সম্পাদিত

সম্প্রতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ বই নিয়ে রিপোর্ট প্রকাশ করেছে একটি অনলাইন গণমাধ্যম। সেই রিপোর্টে দাবি করা হয়েছে, বইটি বঙ্গবন্ধুর নিজের লেখা না; বরং পুলিশের সাবেক আইজিপি জাবেদ পাটোয়ারীসহ আরও ১২৩ জনকে নিয়োগ দিয়েছিলেন শেখ হাসিনা এই বই লেখার জন্য! বিনিময়ে তৎকালীন সরকার প্রত্যেককে একটা করে ফ্ল্যাট ও নগদ এক কোটি টাকা করে দিয়েছেন!

রিপোর্টের সত্য-মিথ্যা নিয়ে কথা বলার বিন্দুমাত্র ইচ্ছা আমার নাই! যে ব্যক্তি এমন এক রিপোর্ট বানাতে পারেন, এবং যে টেলিভিশন চ্যানেল সেটা প্রচার করতে পারে, তাদের ব্যাপারে কথা বলে সময় নষ্ট করা বৃথা। তবে তাদের কেউই যে এই বই পড়েন নাই, তাতে আমার বিন্দুমাত্র সন্দেহ নাই!

উদ্দেশ্য যদি হয়, এরকম একটা রিপোর্ট করে মুজিবকে অপমানের যে উৎসব চলছে, তার গোড়ায় আরেকটু পানি ঢালা, তাহলে তারা তাদের সেসব উন্মাদ জাতিগোষ্ঠীর উদ্দেশ্য হাসিলে কিছুটা হলেও সফল হয়েছে। ফেসবুকে সেই রিপোর্টের নিচে কমেন্ট সেকশনে গেলে আপনি খানিকটা আন্দাজ করতে পারবেন! মাঝেমধ্যে ভাবি, নিজ দেশ, তার প্রতিষ্ঠাতা, জন্মের ইতিহাস ও জন্মব্যথাকে অস্বীকার ও সেসব নিয়ে ঠাট্টাতামাশা করে, এমন জাতি কি পৃথিবীতে দ্বিতীয়টা আছে?

জাবেদ পাটোয়ারী লিখবেন ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’? একটা মিথ্যা রিপোর্ট করলেও তো তাতে অন্তত বিশ্বাস করার মতো কিছু উপাদান থাকতে হয়। যদি প্রয়াত আনিসুজ্জামানের কথা বলা হত, যদি সরদার ফজলুল করিম, এট লিস্ট যদি বলতো যে ড. জাফর ইকবাল লিখেছেন, তাও না হয় খানিকটা নড়েচড়ে বসা যেত। কিন্তু এমন একজনের নাম বলা হলো, যার দুই কলম লেখার অভিজ্ঞতা আছে বলে প্রমাণ নাই। আমি খোঁজাখুঁজি করে দেখলাম, পুলিশের সাবেক এই আইজিপি লেখালেখি করতেন, এরকম কোনো তথ্য পাওয়া যায় না।

‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ আমি দুইবার পড়েছি। একবার ২০১৮/১৯ সালের দিকে, আরেকবার ২২/২৩ সালের দিকে। আমার মুগ্ধতা ফুরায় না। কেউ যদি তার জীবনে শেখ মুজিবের দুই-চারটা ভাষণও মনোযোগ দিয়ে শুনে থাকে, তাহলে এই বইটার দুই-চারটা পাতা উল্টালেই বোঝা যায় যে, এটা মুজিবের লেখা! এক সহজ সাধারণ মানুষের অতি সাধারণ কথামালা।

গোটা বইয়ের শব্দ সহজ, ভাষা সহজ। কোনো সাহিত্যের মারপ্যাঁচের ধারেকাছে নাই। সারা দিন শেষে কাউকে যদি তার দিনটা কেমন গেল তার খুঁটিনাটি লিখতে বলা হয়, সেটা যেমন সৎ ও বিস্তারিতভাবে লেখা যাবে, ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ও তাই।

মুজিব তার লেখার শুরুতেই সেটা স্বীকার করেছেন, “লিখতে যে পারি না; আর এমন কী করেছি যা লেখা যায়! আমার জীবনের ঘটনাগুলি জেনে জনসাধারণের কি কোনো কাজে লাগবে? কিছুই তো করতে পারলাম না। শুধু এটুকু বলতে পারি, নীতি ও আদর্শের জন্য সামান্য একটু ত্যাগ স্বীকার করতে চেষ্টা করেছি।”

না, তিনি অকৃতজ্ঞ জাতিটার জন্য অনেক কিছু করেছেন। পাকিস্তান আমলের মাত্র উনিশ বছর সময়কালে তেরো বছরের বেশি জেলে কাটিয়েছেন। শুরু হয়েছিল ১৮ বছর বয়সে। বেঁচেছিলেন ৫৫ বছরের একটু কম! একটা মানুষ তার জীবনে কি করেছেন সেটা বোঝার জন্য এইটুকুই যথেষ্ট!

যে ধর্মের ভিত্তিতে পাকিস্তান রাষ্ট্র দাঁড়িয়েছিল, সেই ধর্ম যে জুলুমের হাতিয়ার হয়ে উঠেছিল, সেটা ‍তিনি বুঝতে পেরেছিলেন। এক জায়গায় লিখেছেন, “দুঃখের বিষয়, পাকিস্তান আন্দোলনের যারা বিরোধিতা করেছিল, এখন পাকিস্তানকে ইসলামিক রাষ্ট্র করার ধুয়া তুলে রাজনীতিকে তারাই বিষাক্ত করে তুলেছেন। মুসলিম লীগ নেতারাও কোনো রকম অর্থনৈতিক ও সমাজনৈতিক প্রোগ্রাম না দিয়ে একসঙ্গে যে স্লোগান নিয়ে ব্যস্ত রইল, তা হল ‘ইসলাম’।”

এই যে এখন যারা ধর্মের কার্ড খেলে, যারা গুপ্ত রাজনীতি করে, ঈমান আকিদাকে ভোট দিয়ে কেনাবেচা করে, তাদের এই ব্যবসা অতি পুরনো। তখনো ছিল এবং মুজিব নিজেই তার ভুক্তভোগী। আরেক জায়গায় তিনি লিখেছেন, “মুসলিম লীগ যখন দেখতে পেলেন তাদের অবস্থা ভালো না, তখন এক দাবার ঘুঁটি চাললেন। অনেক বড় বড় আলেম, পীর ও মাওলানা সাহেবদের হাজির করলেন। এক ধর্মসভা ডেকে ফতোয়া দিলেন আমার বিরুদ্ধে যে, ‘আমাকে ভোট দিলে ইসলাম থাকবে না, ধর্ম শেষ হয়ে যাবে’। সাথে শর্ষিনার পীর সাহেব, বরগুনার পীর সাহেব। সবাই আমার বিরুদ্ধে নেমে পড়লেন এবং যত রকম ফতোয়া দেওয়া যায় তাহা দিতে কৃপণতা করলেন না।”

আমি জানি না, অন্য কারো কি অভিজ্ঞতা হয়েছে, এই বই পড়তে গিয়ে আমার বারবার মনে হয়েছে, এটা কি মুজিবের আত্মজীবনী, নাকি হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর আত্মজীবনী পড়তেছি আমি। কথায় কথায়, পাতার পর পাতায় হোসেন সাহেবের কথা! সেই স্কুল জীবনে দেখা হওয়ার পর থেকে জীবনে কীভাবে সোহরাওয়ার্দী তাকে প্রভাবিত করে গেছেন, এই বইয়ে সেটা পাওয়া যায়।

মাঝেমধ্যে তো সোহরাওয়ার্দীর ব্যাপারে একেবারে আবেগে গদগদ হয়ে গেছেন তিনি। লিখেছেন, “ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের ছোট্ট কোঠায় বসে জানালা দিয়ে আকাশের দিকে চেয়ে চেয়ে ভাবছি, সোহরাওয়ার্দী সাহেবের কথা। কেমন করে তার সাথে আমার পরিচয় হল। কেমন করে তার সান্নিধ্য আমি পেয়েছিলাম। কীভাবে তিনি আমাকে কাজ করতে শিখিয়েছিলেন এবং কেমন করে তার স্নেহ আমি পেয়েছিলাম।”

আবার এক মহকুমার প্রতিনিধি মুজিবকে সেই সোহরাওয়ার্দীর সাথেই তর্ক করতে দেখা যায়! এক মিটিংয়ের বর্ণনা দিচ্ছেন এভাবে, “তিনি আনোয়ার সাহেবকে একটা পদ দিতে বললেন। আমি বললাম কখনোই হতে পারে না। সে প্রতিষ্ঠানের মধ্যে কোটারি করেছে, ভালো কর্মীদের জায়গা দেয় না। কোনো হিসাব-নিকাশ কোনো দিনও দাখিল করে না। শহীদ সাহেব আমাকে বললেন ”Who are you? You are nobody”. আমি বললাম, If I am nobody, then why you have invited me? You have no right to insult me. I will prove that, I am somebody. Thank you, sir. I will never come to you again.”

আজ যারা উঠতে-বসতে, কথায় কথায় মুজিবকে স্বৈরাচার, ফ্যাসিস্ট বলে গালি দেয়, এই যে ধরেন নাহিদ থেকে শুরু করে আরও যারা যারা এই দলে আছে, আমার ধারণা এদের কেউ এই বই পড়েন নাই। পড়লে জানতে পারতেন, পাকিস্তান রাষ্ট্রের প্রতি মুজিবের কী অপরিসীম আবেগ ছিল। এই যে বলা হয় যে, মুজিব কোনো দিন পাকিস্তান রাষ্ট্র ভাঙতে চান নাই, কোনো দিন চান নাই, সেটা তো আর সত্য নয়, কিন্তু শুরুর দিকে কেনো চান নাই, এই বই পড়লে তার খানিকটা আন্দাজ পাওয়া যায়।

মাদ্রাসার ছাত্ররা এই বই পড়লে খুশিতে আটখানা হয়ে যেত। সমাজতন্ত্রের প্রতি গাঢ় অনুরাগ পুষে রাখা এই মানুষ ব্যক্তিজীবনে আপাদমস্তক বাঙালি মুসলমান ছাড়া আর কিছুই ছিলেন না। নামাজ পড়তেন। শেখ রাসেলের সাথে ঈদগাহে তার একটা চমৎকার ছবি পাওয়া যায়।

ভাসানীর সাথে এক জেলে থাকার অভিজ্ঞতা নিয়ে লিখেছেন, ‘মওলানা সাহেবের সঙ্গে আমরা তিনজনই নামাজ পড়তাম। মওলানা সাহেব মাগরিবের নামাজের পরে কুরআন মজিদের অর্থ করে আমাদের বোঝাতেন। রোজই এটা আমাদের জন্য বাঁধা নিয়ম ছিল’। আরেক জায়গায় লিখেছেন, ‘আমি তখন নামাজ পড়তাম এবং কুরআন তেলাওয়াত করতাম রোজ। কুরআন শরিফের বাংলা তর্জমাও কয়েক খণ্ড ছিল আমার কাছে’।

আমার মনে আছে, দুইবারই বইটা শেষ করেছিলাম প্রচণ্ড অতৃপ্তি নিয়ে। শুরুতে তার পরিবার ও বংশপরম্পরা নিয়ে এত বিস্তারিত বর্ণনা করেছেন যে, কিছুটা আলসেমি লাগে বটে, কিন্তু যেই না বইটা আগাতে থাকে, মনে হয় ৭৫ বছর আগের বাংলাদেশে ঢুকে পড়েছি। একটা দেশের বীজ বপনের সংগ্রাম কেমন হয়, তার আঁচ পাওয়া যায়! ফলে ১৯৫৪ সালের যুক্তফ্রন্টের নির্বাচনে গিয়ে যখন বইটা শেষ হয়, প্রচণ্ড অতৃপ্তি কাজ করে। মনে হয় কিছুই তো জানা হল না।

কোনো পরিকল্পনা নাই, কোনো উপসংহার নাই, লেখকের জীবনের মতই হুট করে বইটা শেষ হয়ে যাওয়ার পর, পাঠককে স্তব্ধ হয়ে বসে থাকতে হয়। সেই বইটা নিয়ে চ্যানেল ২৪ যে গল্পটা ফাঁদল, তাদের স্পর্ধা দেখে বিস্মিত হয়েছি।

টেলিভিশন চ্যানেলটির মালিক ব্যবসায়ী এ কে আজাদ, যে ২০২৪ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন চেয়েছিলেন, না পেয়ে স্বতন্ত্র নির্বাচন করে সংসদ সদস্য হয়েছিলেন। আপনাদের এও মনে থাকার কথা, গত জুলাইয়ের শেষ সপ্তাহে যখন লীগ সরকারের বিরুদ্ধে সারা দেশে ব্যাপক আন্দোলন চলছে, তখনও এই এ কে আজাদের নেতৃত্বে ব্যবসায়ীরা শেখ হাসিনার সাথে দেখা করে সমর্থন ব্যক্ত করে এসেছিলেন।

তার ঠিক এক সপ্তাহ পর, ৫ আগস্ট লীগ সরকারের পতনের এক বা দুই দিন পরে, এই একই ব্যক্তিকে সবার আগে খালেদ মুহিউদ্দীনের টক শো’তে যোগ দিয়ে উচ্ছ্বাস প্রকাশ করতে দেখেছি। উপস্থাপক যখন জিজ্ঞেস করেছেন যে, আপনারা তো মাত্র কয়েক দিন আগেই শেখ হাসিনাকে সমর্থন করে এসেছেন, উত্তরে আজাদ বলেছিল, ”না পারতে করেছি। আমাদের উপায় ছিল না।”

তবে এসব এ কে আজাদ নস্যি! গত এক বছরে ড. মুহাম্মদ ইউনূসের মতো মানুষ যতভাবে শেখ মুজিবকে অপমান করেছেন, সেটা গত ৫৪ বছরের ইতিহাসে কেউ করতে পেরেছেন বলে আমার মনে হয় না। সারা দেশে মুজিবের নামে স্থাপনার নাম পরিবর্তন থেকে শুরু করে, রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান থেকে তার ছবি নামানো, টাকার গায়ে ছবি আছে বলে সেই টাকা নতুন করে ছাপানো, সারা দেশ থেকে তার সব ভাস্কর্য অপসারণ, গায়ে-মাথায় প্রস্রাব, গলায় রশি বেঁধে টেনে সেসব ভাস্কর্য অপসারণ যারা করেছেন, তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি!

যে উচ্ছ্বাস নিয়ে বঙ্গবন্ধুর ধানমন্ডির বাড়িটা উৎসব করে ভাঙা হলো, যেভাবে বাড়িটার সামনে কথায় কথায় এখন ডিজে পার্টির আয়োজন করে, আমার মনে হয় না একাত্তরে পরাজিত পাকিস্তানও এতটা নিচে নামতে পারতো কিনা!

এই যে একটা টিভি চ্যানেল একটা ডাহা মিথ্যা রিপোর্ট করল, যে কোনো সভ্য দেশে হলে এই রিপোর্টারকে ডেকে যাবতীয় তথ্য-উপাত্ত যাচাই করার উদ্যোগ নেওয়া হতো! তা তো করা হয়ইনি, উল্টো এই মিথ্যা প্রতিবেদন প্রচারের সাথে সাথে জাবেদ পাটোয়ারীসহ যাদের নাম এসেছে, তাদের টাকা-পয়সা ও সম্পদের হিসাব নেওয়ার জন্য দুদক উঠেপড়ে লেগে গেছে। মানে তারা ধরে নিয়েছে, বা তাদেরকে ধরে নিতে বাধ্য করা হয়েছে যে, এই রিপোর্ট সত্য!

মুজিবকে অপমান করার ক্ষেত্রে আমি গত এক বছরে ড. ইউনূসের কোনো গাফিলতি দেখি নাই। গত এক বছরে শুধু মুজিবকে অপমান করা যাবে, এমন সব কর্মকাণ্ডে ইউনূসের যে তৎপরতা দেখা গেছে, তার কিয়দংশও যদি মব বন্ধ, আইন-শৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণ, সংখ্যালঘু নির্যাতন রোধ, সমন্বয়কদের চাঁদাবাজি, একাত্তর ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনা রক্ষায় দেখা যেত, তাহলে এক বছর পরে এসে আমাদেরকে এরকম পতনের মুখে এসে দাঁড়াতে হতো না।

রবীন্দ্রনাথের কবিতা মনে পড়ে, “হে মোর দুর্ভাগা দেশ, যাদের করেছ অপমান,/ অপমানে হতে হবে তাহাদের সবার সমান!”

রাজু নূরুল: লেখক, অনুবাদক, গবেষক; যোগাযোগ: raju_norul@yahoo.com 


সর্বশেষ সংবাদ