অপারেশন রাইজিং লায়ন: মধ্যপ্রাচ্য থেকে বৈশ্বিক বিভাজনের নতুন সূচনা
- এস এম তৌফিকুল ইসলাম
- প্রকাশ: ১৯ জুন ২০২৫, ০৪:০০ PM , আপডেট: ১৯ জুন ২০২৫, ০৯:০৬ PM
১৩ জুন ২০২৫—ইতিহাস হয়তো দিনটিকে স্মরণ রাখবে ‘অপারেশন রাইজিং লায়ন’-এর সূচনার দিন হিসেবে। ওই দিন ইসরায়েল একতরফাভাবে ইরানের বিরুদ্ধে সামরিক অভিযান শুরু করে, বিমান হামলা চালায় ইরানের পারমাণবিক স্থাপনা ও সামরিক ঘাঁটিতে। পাশাপাশি হামলা চালায় ইরানের নানা বেসামরিক স্থাপনায়। ইউক্রেন যুদ্ধের ফলে আন্তর্জাতিক রাজনীতি যেখানে আগে থেকেই উত্তপ্ত ও অস্থির, সেখানে এই নতুন যুদ্ধ বিশ্বমানচিত্রে আরও এক স্তরের সংকট ও উত্তেজনার জন্ম দিয়েছে।
পাঁচ মাস আগে ইরানের সঙ্গে কৌশলগত অংশীদারিত্ব চুক্তি স্বাক্ষর করে রাশিয়া। কিন্তু ইরানের পক্ষে সরাসরি অবস্থান নিতে পারেনি রাশিয়া। মস্কো উদ্বেগ প্রকাশ করলেও ইসরায়েলের বিরুদ্ধে কোনো কড়া অবস্থান নেয়নি তারা।
রুশ পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এই সংঘাতকে “বিপজ্জনক ও অস্থিতিশীলতা সৃষ্টিকারী” বলে উল্লেখ করেছে। তবে রুশ প্রচারমাধ্যমগুলো সংঘাত থেকে সম্ভাব্য লাভের বিষয়গুলোও তুলে ধরেছে—বিশ্ববাজারে তেলের দাম বৃদ্ধি রাশিয়ার অর্থনীতিকে স্বস্তি দিতে পারে, আর ইউক্রেন যুদ্ধ থেকে আন্তর্জাতিক মনোযোগ সরে যাওয়া রাশিয়ার জন্য বাড়তি সুবিধা তৈরি করতে পারে।
তবে লাভের আশা যতটা, ক্ষতির আশঙ্কাও ততটাই। সরাসরি ইসরায়েলের সঙ্গে সংঘাতে না গিয়ে রাশিয়া হয়তো স্বল্পমেয়াদে কৌশলগত লাভ খুঁজছে, কিন্তু এতে দীর্ঘমেয়াদে তাদের মিত্র দেশ হারানোর ঝুঁকি তৈরি হচ্ছে। সিরিয়ায় আসাদ সরকারের টিকে থাকা রাশিয়ার জন্য যেমন গুরুত্বপূর্ণ, তেমনি ইরানে যদি শাসনব্যবস্থায় বড় ধরনের পরিবর্তন আসে, তবে রাশিয়ার মধ্যপ্রাচ্য কৌশল প্রায় ধসে পড়বে।
ইতিহাস বলছে, ১৯৭৯ সালের ইসলামি বিপ্লবের আগে ইরান ও ইসরায়েল ছিল ঘনিষ্ঠ, যদিও তা ছিল অঘোষিত। তেল দিত ইরান, আর ইসরায়েল দিত অস্ত্র ও প্রশিক্ষণ। ইসলামি বিপ্লব সেই সম্পর্ককে রূপান্তরিত করে এক প্রগাঢ় শত্রুতায়। আজকের যুদ্ধ সেই ভাঙনেরই বিস্ফোরক পরিণতি। এ শত্রুতা শুধু আদর্শিক নয়, বরং বিশ্বাসভঙ্গের প্রতিক্রিয়া। সম্পর্কের শূন্যতা থেকেই জন্ম নিতে পারে সবচেয়ে গভীর বিদ্বেষ—ইতিহাস তার সাক্ষ্য দেয়।
বর্তমানে ইরান-ইসরায়েল যুদ্ধ আর শুধু সীমিত পরিসরের সংঘাত নয়। এটি পরিণত হয়েছে ভূরাজনৈতিক ভারসাম্য পুনর্গঠনের কেন্দ্রে। যুক্তরাষ্ট্র আগেই ইসরায়েলের পাশে অবস্থান নিয়েছে। চীন উত্তেজনা প্রশমনের কথা বললেও তার কৌশলগত অবস্থান জটিল। রাশিয়া নিরপেক্ষতা বজায় রাখার চেষ্টা করলেও ক্রমাগত চাপের মুখে পড়ছে। এই উত্তেজনা যদি লেবানন, ইরাক, ইয়েমেন, এমনকি পাকিস্তান বা আফগানিস্তান পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়ে, তবে তা সহজেই এক পূর্ণাঙ্গ আঞ্চলিক যুদ্ধে রূপ নিতে পারে, যার পরিণতি হতে পারে বৈশ্বিক সংঘাত।
বাংলাদেশ এ সময় দাঁড়িয়ে আছে এক সংবেদনশীল সীমানায়। জ্বালানি আমদানি, শ্রমবাজার ও রেমিট্যান্স—সবখানেই মধ্যপ্রাচ্যের সঙ্গে গভীর নির্ভরতা রয়েছে। এই অঞ্চল যদি দীর্ঘমেয়াদি অস্থিরতায় পড়ে, তবে বাংলাদেশের অর্থনীতি বড় ধরনের চাপের মুখে পড়বে।
এছাড়া, বৈশ্বিক রাজনীতিতে নতুন মেরুকরণ শুরু হলে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোকে হয়তো নিজেদের অবস্থান স্পষ্ট করতে হবে। বাংলাদেশ কি নিরপেক্ষ থাকবে, নাকি কোনো নির্দিষ্ট পক্ষকে সমর্থন করবে—এই প্রশ্ন এখন কেবল কূটনৈতিক নয়, অর্থনৈতিক ও নিরাপত্তার দিক থেকেও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে।
বিশ্ব রাজনীতি যেন আবার এক নতুন বিভাজনের প্রান্তে এসে দাঁড়িয়েছে। এই মুহূর্তে গৃহীত সিদ্ধান্তগুলোই নির্ধারণ করবে ভবিষ্যতের রূপরেখা—কে কার পাশে দাঁড়াবে, কে যুদ্ধ ঠেকাতে পারবে, আর কার জন্য যুদ্ধ কেবল সময়ের অপেক্ষা হয়ে থাকবে।
লেখক: রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও অনলাইন অ্যাক্টিভিস্ট
যোগাযোগা: smtawfiqulislam@gmail.com