এমপিওভুক্ত শিক্ষকরা কি রাষ্ট্রে অপাংক্তেয়?

প্রতীকী
প্রতীকী  © ফাইল ছবি

সম্প্রতি শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা (মাউশি) বিভাগ এমপিওভুক্ত বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক ও কর্মচারীদের চাকরি বিধির খসড়া প্রনয়ণ করেছে। এতে তাদের আচরণ ও শৃঙ্খলা বিষয়ক দশটি ধারা উল্লেখিত আছে। একটি কর্মশালার মাধ্যমে খসড়াটি পুঙ্খানুপুঙ্খ বিশ্লেষণ করে পরবর্তীতে চূড়ান্ত করা হবে বলে তারা জানিয়েছেন।

ইতোমধ্যে বিষয়টি ঘিরে সচেতন মহলে বেশ মিশ্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়েছে। উল্লেখ্য, দেশে বর্তমানে ২৯ হাজার ১৬৪টি এমপিওভুক্ত স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসা ও কারিগরি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান রয়েছে। এগুলোতে পাঁচ লাখেরও বেশী শিক্ষক-কর্মচারী কর্মরত আছেন। এদের মধ্যে অধিকাংশই শিক্ষক।

বলাবাহুল্য, দেশের মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা স্তরের (জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় ভুক্ত) প্রায় ৯৭ শতাংশ বেসরকারি এমপিভুক্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান দ্বারা পরিচালিত। এতে চার লাখ বেসরকারি শিক্ষক শিক্ষাসেবায় অগ্রণী ভূমিকা রেখে চলেছেন। তাই দেশের সামগ্রিক শিক্ষা জনবলের এক বিশাল অংশকে এই প্রণিত বিধিমালার আওতায় নিয়ন্ত্রণ করা কতটা যুক্তিঙ্গত, বাস্তবিক ও ফলপ্রসূ হবে তা বিশেষ চিন্তার দাবী রাখে।

খসড়া বিধিতে বলা হয়েছে, ‘‘শিক্ষক-কর্মচারীরা কোনো বিষয়ে হস্তক্ষেপের অনুরোধ বা প্রস্তাব নিয়ে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে সংসদ সদস্য বা বেসরকারি কোনো ব্যক্তির কছে যেতে পারবেন না।’’ এটি সাধারণ গণতান্ত্রিক অধিকার পরিপন্থী এক নিদারুণ নীতি বৈকি। কেননা, প্রতিটি পেশাগত মানুষের পেশাগত জীবনের পাশাপাশি তার ব্যক্তিগত ও নাগরিক সুবিধা-অসুবিধা শেয়ারিং-এর জন্য সামাজিক ক্ষেত্র থাকে।

এমপিও শিক্ষকরা এমনিতেই অনেক সময় প্রতিষ্ঠান পরিচালনা পর্ষদের পরিকল্পিত রোষানলের শিকার হন (যা প্রায়ই দেখা যায়)। কেননা, আমাদের দেশে এসকল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর পরিচালনা কমিটি অধিকাংশ ক্ষেত্রে শিক্ষা ও শিক্ষকবান্ধব হয়ে ওঠেনি যা প্রায়ই নানা অপ্রিয়কর ঘটনার মধ্যদিয়ে প্রতীয়মান হয়। তার উপর এসকল অবরুদ্ধ নীতি তাদের প্রবঞ্চনার মাত্রাকে আরো বাড়িয়ে তুলতে পারে। যার নেতিবাচক প্রভাব সামগ্রিক শিক্ষাব্যবস্থার ওপর পরতে পারে।

এতে শিক্ষকরা কমিটি কর্তৃক স্যাবোটাজের শিকার হবেন এবং গোপন দুর্নীতির সংস্কৃতি উৎসাহিত হবে। বিধিতে রাজনীতি নিষিদ্ধ করা হয়েছে। যা বাংলাদেশ স্বাক্ষরিত আইএলও ইউনেস্কো নীতির পরিপন্থি।

তবে, দেশের ইতিহাস-ঐতিহ্য, জাতিসত্তা ও জাতিসংস্কৃতি পরিপন্থি তথা দেশবিরোধী কোনো অপরাজনীতি গ্রহণযোগ্য হতে পারে না; এসকল গর্হিত ইস্যুতে বিধি নিষেধ আরোপ অবশ্যই প্রাসঙ্গিক ও যুক্তিসংগত। কেননা, এ হেন কার্যকলাপ কোনো রাজনীতির সংজ্ঞায় পড়ে না।

খসড়ায় প্রাইভেট টিউশন, খণ্ডকালীন চাকরি ও ব্যবসা নিষিদ্ধের কথা বলা হয়েছে। এমপিও শিক্ষকরা রুগ্ণ বেতনে এমনিতেই নাজুক জীবনযাপন করে, তার উপর বৈশ্বিক মহামারিতে সৃষ্ট মূল্যস্ফীতির দোর্দান্ড প্রতাপ তাদেরকে বেশ আর্থিক ঝুঁকির দিকে ঠেলে দিয়েছে। এর উপর আবার টিউশনসহ অবসর সময়ে কিছু আর্থিক আয়ের বিধিনিষেধ তাদেরকে চরম মানসিক বিষণ্নতায় নিমগ্ন করতে পারে, যার নেতিবাচক প্রভাব শিক্ষার ওপর পরতে পারে।

আমরা দেখেছি যে, একটু জটিল ব্যাধিতে আক্রান্ত হলে কোনো-কোনো এমপিও শিক্ষকরা আর্থিক সহায়তা প্রাপ্তির জন্য নিরুপায় হয়ে কখনো-কখনো ক্লাসে স্টুডেন্টদের কাছেও চাঁদা তোলেন। যা খুবই কষ্টদায়ক ও লজ্জাস্কর বটে। অনেকে লোক লজ্জার ভয়ে অভাবের যাতনে পরিবার-পরিজন নিয়ে নিভৃতে দিনাতিপাত করে থাকে।

যদি সরকারি রেজিস্টার্ড চিকিৎসকরা চাকরির পাশাপাশি প্রাইভেট প্র্যাকটিস করতে পারেন তবে কিছুটা আর্থিক সংশ্লেষের স্বার্থে শিক্ষকরা অবসর সময়ে কেন তাদের মেধা-মননের চর্চা করতে পারবে না? এই বিধিটি অবশ্যই প্রশ্নবিদ্ধ দ্বিচারিতা! করোনা মহামারিতে এমনিতেই শিক্ষার্থীরা পড়াশুনায় পিছিয়ে আছে; কিছুটা আর্থিক সন্মানীর পাশাপাশি শিক্ষার্থীদের পড়াশুনার অতিরিক্ত উৎকর্ষের স্বার্থে যদি শিক্ষকরা প্রাইভেট টিউশন প্র্যাকটিস করে থাকে তাতে সামগ্রিক সুবিধা ছাড়া অসুবিধা কোথায়?

বাস্তবতার নিরিখে বিষয়গুলো অবশ্যই ভাববার দাবি রাখে।  বিধিতে শিক্ষকরা কোনো লেখায়, মিডিয়ায় ও জনসমক্ষে বক্তৃতায় সরকার বিব্রতকর পরিস্থিতিতে পড়তে পারে এমন কোনো কথা, মতামত বা বিবৃতি প্রদান করতে পারবেন না মর্মে উল্লেখ করা হয়েছে; এটি যুক্তিসংগত। কেননা, সরকারের সুবিধাভোগী প্যারালাল পার্ট হিসাবে এমপিও শিক্ষকগণ এটা করতে পারেন না।

তবে, সৃজনশীল সমাজ গঠনে গঠনমূলক ও বুদ্ধিবৃত্তিক মুক্তমত চর্চা ও প্রকাশের ক্ষেত্রে বিধিটা যেন অন্তরায় হয়ে না ওঠে সেদিকে সতর্কতা ও খেয়াল রাখতে হবে। কেননা, পরিমার্জিত সমাজ গঠনে শিক্ষকদের বিশেষ নৈতিক দায় রয়েছে। খসড়ায় বিতর্কিত ধর্মীয় বিষয়ে বিরত থাকতে বলা হয়েছে।

বলা বাহুল্য, ধর্ম নিরপেক্ষতা তথা অসাম্প্রদায়িকতা আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের এক অবিচ্ছেদ্য ও মৌলিক চেতনা যার ওপর ভিত্তি করেই আমরা আমাদের গৌরবময় স্বাধীনতা অর্জন করেছি।

বর্তমান সরকার তার রাজনৈতিক দর্শনে ধর্ম নিরপেক্ষতা ও অসাম্প্রদায়িকতাকে লালন করে। এ বিষয়ে তাদের নির্বাচনী ইশতেহারেও প্রতিফলন ঘটিয়েছে। এ লক্ষ্য অর্জনে শিক্ষকদেরও সমাজে ও বিভিন্ন প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাস্তরে অগ্রণী ভূমিকা পালনের দায় রয়ে গেছে।

সুতরাং, উপরোক্ত ধর্ম সংশ্লিষ্ট বিধিনিষেধ যাতে সেই লক্ষ্য অর্জনে ব্যাঘাত না ঘটায় সেদিকে সজাগ দৃষ্টি রাখতে হবে। এ বিষয়ে উপরোক্ত বিধির যথার্থ ব্যাখ্যা থাকা উচিত।

উল্লেখ্য, বাংলাদেশের শিক্ষা ব্যবস্থাপনাকে তিনটি ভাগে ভাগ করা হয়েছ; যেমন- সরকারি, বেসরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত। এই ত্রি-বিভাজনের মধ্যে আর্থিক ও সামাজিক বৈষম্য বেশ প্রকট। বিশেষ করে একই কারিকুলামের আওতায় একই সমাজে একই একাডেমিক যোগ্যতায় সরকারি ও বেসরকারি শিক্ষকদের আর্থিক ও সামাজিক মর্যাদার মনস্তাত্ত্বিক বৈষম্য এ সমস্যাকে দিনে-দিনে নীরবে ঘনীভূত করছে। তার ওপর আবার বেসরকারি শিক্ষকদের নিয়ন্ত্রণে এমন অবরুদ্ধকরণ বিধি-প্রবিধি সমস্যাকে আরো ত্বরান্বিত করতে পারে।

প্রসঙ্গত, জাতির পিতাকে হত্যার পর দীর্ঘ প্রায় দুই যুগব্যাপী এদেশের মৌলিক ইতিহাস-ঐতিহ্যকে কুপরিকল্পিতভাবে বিকৃত করা হয়েছিল। পক্ষাঘাত করা হয়েছে বাঙালি জাতিসত্তার মৌলিক চেতনাকে। এমন বিকৃত শিক্ষা-ভাবধারার মধ্য দিয়ে রীতিমতো একটা প্রজন্ম বেড়ে ও গড়ে উঠেছে।

সময়ের আবর্তে বাঙালির মৌলিক চেতনা বিরোধী নষ্ট-ভ্রষ্ট এমন মতবাদ বর্তমানে রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠাও পেয়েছে যা জাতীয় রাজনীতির জন্য মোটেও সুখকর নয়। বরং অশনি বটে। জাতীয়তার স্বার্থে এমন পরিস্থিতির উত্তরণ অত্যন্ত জরুরি। এক্ষেত্রে শিক্ষকদের সংবেদনশীল ইতিবাচক ভূমিকা অনস্বীকার্য। পাশাপাশি টেকসই উন্নয়নের লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে ও সরকার ঘোষিত চতুর্থ শিল্প বিপ্লব সংঘটনে শিক্ষকদের অপরিসীম ভূমিকা রাখার শতভাগ নৈতিক দায় বর্তায়।

কেননা, তরুণ প্রজন্মের মেধা-মননকে জাতীয় স্বার্থে উৎপাদনশীল করতে শিক্ষকদেরই প্রধান ভূমিকা পালন করতে হবে।তাই সার্বিক বাস্তবতা পর্যবেক্ষণ ও বিবেচনাপূর্বক এধরনের বিধিনিষেধ আরোপের ক্ষেত্রে আরো চিন্তাশীল ও যত্নশীল হওয়া সমীচীন বলে মনে করি।

আমাদের মনে রাখতে হবে, শিক্ষা যদি জাতির মেরুদণ্ড হয় তবে শিক্ষক হলো সেই মেরুদণ্ডের মজ্জা। তারা পরিশীলিত জাতি গঠনের প্রধান কারিগর। কোনো কঠোর শাসন-অনুশাসনের ফ্রেমে এই সুশীল পেশাজীবীদের বেঁধে রেখে আর যাই হোক অন্তত সৃষ্টিশীল শিক্ষাসমাজ সৃষ্টি করা যায় না—এই বাস্তবতা মাথায় রেখেই রাজনৈতিক ও আমলাতান্ত্রিক সিদ্ধান্ত নেওয়া হিতকর হবে বলে মনে করি।

লেখক: কলামিস্ট।


সর্বশেষ সংবাদ