স্ক্রিনের ভেতরের প্রজন্ম: জেন-জিদের ডিজিটাল জীবন

মো. সাজ্জাদুল ইসলাম
মো. সাজ্জাদুল ইসলাম  © সংগৃহীত

একটি শিশুর হাতে প্রথম স্মার্টফোন ধরা পড়ার মুহূর্তটি হয়তো এখন আর কোনো বিশেষ দৃশ্য নয়। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে প্রযুক্তি আমাদের জীবনের এমন গভীরে প্রবেশ করেছে যে, একে ছাড়া আধুনিক মানবজীবন কল্পনাই করা যায় না। কিন্তু এই পরিবর্তনের সবচেয়ে বড় সাক্ষী ও ভোক্তা হলো সেই প্রজন্ম, যাদের আমরা বলি জেনারেশন জেড—যারা ১৯৯৭ থেকে ২০১২ সালের মধ্যে জন্ম নিয়েছে। তারা এমন এক পৃথিবীতে বড় হয়েছে, যেখানে ইন্টারনেট, স্মার্টফোন, সোশ্যাল মিডিয়া ও অ্যালগরিদমই তাদের চারপাশের বাস্তবতা গড়ে দিয়েছে।

এই প্রজন্মের জীবন যেন এক অবিরাম স্ক্রিনের ভেতরেই প্রবাহিত হয়। সকালে ঘুম থেকে উঠে ইনস্টাগ্রামে স্ক্রল, দুপুরে অনলাইন ক্লাস, বিকেলে টিকটকে ভিডিও দেখা বা বানানো, রাতে ইউটিউবে কনটেন্ট দেখা সব কিছুই ডিজিটাল পর্দায় সীমাবদ্ধ। তাই তাদের জীবন অনেকটা ‘অনলাইন’ ও ‘অফলাইন’ বাস্তবতার মধ্যকার এক সেতু। তারা একই সঙ্গে বাস্তব সমাজে বাস করলেও নিজেদের প্রকাশ, যোগাযোগ ও চিন্তার বড় অংশটিই করে ভার্চুয়াল দুনিয়ায়।

তবে এই ডিজিটাল নির্ভরতা যেমন নতুন সুযোগ তৈরি করেছে, তেমনি এনেছে গভীর কিছু সংকটও। জেন-জিরা তথ্যপ্রযুক্তির সবচেয়ে সুবিধাপ্রাপ্ত প্রজন্ম হলেও তারা একই সঙ্গে সবচেয়ে একাকী প্রজন্ম হিসেবেও পরিচিত। সোশ্যাল মিডিয়ার অসীম সংযোগ তাদের বাস্তব সম্পর্কগুলোকে অনেক সময় করে তুলছে ভঙ্গুর। ইনস্টাগ্রামে নিখুঁত জীবনযাপনের প্রতিযোগিতা, টিকটকের স্বল্প মনোযোগের সংস্কৃতি কিংবা অনলাইন মন্তব্যের বিষাক্ততা তাদের মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর গভীর প্রভাব ফেলছে।

মানসিক স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ক্রমাগত “ডোপামিন রাশ” বা তাৎক্ষণিক আনন্দের পেছনে ছোটা এই প্রজন্মকে করে তুলছে অস্থির ও উদ্বিগ্ন। বাস্তব জীবনের ধৈর্য, মনোযোগ ও আবেগগত স্থিতি যেন হারিয়ে যাচ্ছে ভার্চুয়াল উত্তেজনার নিচে। কিন্তু অন্যদিকে, এই প্রজন্মই আবার মানসিক স্বাস্থ্য, আত্মপরিচয় ও সামাজিক ন্যায়বিচার নিয়ে সবচেয়ে খোলামেলা কথা বলছে। তারা অনলাইনে কণ্ঠ তুলছে বুলিং, বর্ণবাদ, পরিবেশ ও লিঙ্গ সমতার মতো বিষয়গুলোতে যা আগের প্রজন্মদের কাছে প্রায় অচিন্তনীয় ছিল।

জেন-জিদের সবচেয়ে বড় শক্তি তাদের ডিজিটাল সৃজনশীলতা। তারা অল্পতেই কনটেন্ট তৈরি করতে পারে, ভিজ্যুয়াল ভাষা বোঝে, এবং প্রযুক্তিকে ব্যবহার করে নিজেদের ভাবনা পৃথিবীর সামনে তুলে ধরে। এই প্রজন্মের অনেক তরুণ-তরুণী ইউটিউব বা ইনস্টাগ্রামে নিজেদের ব্র্যান্ড তৈরি করেছে, যেখান থেকে তারা শুধু অর্থই উপার্জন করছে না, বরং গড়ে তুলছে এক নতুন প্রভাবের সংস্কৃতি ইনফ্লুয়েন্সার কালচার।

তবে প্রশ্ন হলো, এই ডিজিটাল নির্ভরতা আমাদের সমাজ ও সংস্কৃতিকে কোন পথে নিয়ে যাচ্ছে? মানুষ যখন নিজের বাস্তব অস্তিত্বের চেয়ে ভার্চুয়াল পরিচয়কে বেশি গুরুত্ব দেয়, তখন সত্য-মিথ্যার সীমারেখা ঝাপসা হয়ে যায়। “ফিল্টার করা জীবন” আমাদের বাস্তবতার অনুভবকে বিকৃত করে। তাই জেনজিদের সামনে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ এখন প্রযুক্তিকে নিয়ন্ত্রণে রাখা, তাকে জীবনের পরিপূরক হিসেবে ব্যবহার করা প্রভু নয়, বন্ধু হিসেবে।স্ক্রিনের আলোয় আলোকিত এই প্রজন্ম পৃথিবীকে বদলে দিচ্ছে তাদের উদ্ভাবন, সাহস ও অভিযোজন ক্ষমতা নিঃসন্দেহে বিস্ময়কর। কিন্তু এই আলো যেন চোখ ধাঁধানো না হয়, বরং পথ দেখাক এই ভারসাম্যই এখন সময়ের দাবি।

কারণ, প্রযুক্তি আমাদের জীবনকে সহজ করতে এসেছে, বন্দি করতে নয়। জেন-জিদের হাতে সেই সিদ্ধান্ত তারা কি স্ক্রিনের ভেতরে হারিয়ে যাবে, নাকি সেই স্ক্রিনের আলোয় নতুন দিগন্ত খুঁজে নেবে।

লেখক: মো. সাজ্জাদুল ইসলাম লেখক ও কলামিস্ট


সর্বশেষ সংবাদ