আগুনের ছায়ায় বাংলাদেশ: অর্থনীতি ও জাতীয় নিরাপত্তার বিরুদ্ধে নীরব যুদ্ধ?
- রিফাত রহমান
- প্রকাশ: ২০ অক্টোবর ২০২৫, ১০:১৫ AM
বাংলাদেশের সাম্প্রতিক দিনগুলো যেন এক অদৃশ্য অস্থিরতার ছায়ায় ঢেকে গেছে। মিরপুরের রাসায়নিক গুদাম, চট্টগ্রাম ইপিজেড এবং হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের কার্গো ভিলেজ মাত্র পাঁচ দিনের ব্যবধানে এই তিনটি গুরুত্বপূর্ণ স্থানে আগুনের ঘটনা কোনো স্বাভাবিক দুর্ঘটনা বলে মেনে নেওয়া কঠিন। বরং এই ধারাবাহিক অগ্নিকাণ্ড একটি গভীর ষড়যন্ত্রের আভাস দিচ্ছে, যার লক্ষ্য দেশের অর্থনীতি ও রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তাকে দুর্বল করা।
প্রথম ঘটনাটি ঘটে রাজধানীর মিরপুরে, যেখানে জনবহুল আবাসিক এলাকায় অবৈধভাবে মজুদ করা রাসায়নিকের বিস্ফোরণে বহু প্রাণহানি ঘটে। এখনো সেই ধোঁয়ার গন্ধ মিলিয়ে যায়নি, তার মধ্যেই চট্টগ্রাম রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ অঞ্চলের (ইপিজেড) অ্যাডামস টেক্সটাইল কারখানায় দুর্বার আগুন গ্রাস করে কোটি কোটি টাকার রপ্তানি প্রস্তুত পণ্য। এই ধাক্কা সরাসরি দেশের পোশাক শিল্প যা আমাদের বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের প্রধান উৎস কে আঘাত করে।
কিন্তু সবচেয়ে উদ্বেগজনক ঘটনা ঘটে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের কার্গো ভিলেজে, যা দেশের আকাশপথ বাণিজ্যের প্রধান প্রবেশদ্বার। সেখানে আগুন ছড়িয়ে পড়ার পর শুধু ফায়ার সার্ভিস নয়, সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী ও বিমানবাহিনীর বিশেষ ইউনিটও ঘটনাস্থলে ছুটে আসে। নিয়ন্ত্রিত উচ্চ-সুরক্ষা বলয় সেখানে কিভাবে এত বড়সড় অগ্নিকাণ্ড ঘটতে পারে, তা স্বভাবতই প্রশ্ন জাগায়।
এই সব ঘটনাই ঘটছে এমন এক সময়ে, যখন বাংলাদেশের অর্থনীতি আবার ঘুরে দাঁড়ানোর পথে। আন্তর্জাতিক অঙ্গনে দেশের অবস্থান শক্তিশালী হচ্ছে, মিরসরাইয়ের শিল্পাঞ্চল, তিস্তা মহাপরিকল্পনা এবং আধুনিক যুদ্ধবিমান J-10CE ক্রয়ের আলোচনায় বাংলাদেশ আত্মবিশ্বাসের নতুন স্তরে পৌঁছাচ্ছে। ঠিক এই সময়েই দেশব্যাপী এমন দহনকাণ্ড কাকতাল মাত্র হতে পারে না।
বিশেষজ্ঞদের মতে, এই আগুনের লক্ষ্য কেবল স্থাপনা নয়, বরং দেশের মনোবল। যখন অর্থনীতির চালিকাশক্তি রপ্তানি, বিমানবন্দর, বন্দর একযোগে আঘাতপ্রাপ্ত হয়, তখন আন্তর্জাতিক অঙ্গনে একটি ‘দুর্বল রাষ্ট্রের ইমেজ’ তুলে ধরা হয়। এ এক ধরণের নীরব যুদ্ধ, যেখানে বারুদ নেই, কিন্তু আছে আগুন; গুলির শব্দ নেই, কিন্তু আছে আতঙ্ক।
আরো গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয় হলো, এই অগ্নিকাণ্ডগুলো ঘটছে বাংলাদেশ বিমানবাহিনীর প্রধানের বিদেশ সফরের প্রেক্ষাপটে। তিনি যখন দক্ষিণ কোরিয়া ও চীনের শীর্ষ প্রতিরক্ষা বৈঠকে অংশ নিতে গেছেন, তখনই দেশের ভেতরে আগুন দাউদাউ করে জ্বলছে। এ কি শুধু সময়ের দৈব মিলে যাওয়া, নাকি কোনো আন্তর্জাতিক চাপ সৃষ্টির কৌশল?
বিগত ইতিহাসে দেখা যায়, যে রাষ্ট্রকে থামাতে চাওয়া হয়, প্রথম আঘাত আসে তার অর্থনৈতিক ও প্রতিরক্ষা অবকাঠামোর ওপর। আজ বাংলাদেশের ক্ষেত্রেও সেই পুরনো কৌশলেরই পুনরাবৃত্তি হচ্ছে কি না, তা নিয়ে জাতীয় নিরাপত্তা মহলে উদ্বেগ বাড়ছে। মিরসরাইয়ে বিনিয়োগ বাধাগ্রস্ত করার চেষ্টা, বন্দরে জাহাজডুবি, বিমানবন্দরে কার্গো অচল করা সবই ইঙ্গিত দেয়, একটি অশুভ চক্র দেশের অগ্রগতিকে থামাতে সক্রিয়।
এ অবস্থায় দেশের মানুষ শুধু আগুন নেভাতে চায় না, তারা জানতে চায় এই আগুনের উৎস কোথায়? প্রতিবারের মতো তদন্ত কমিটি গঠন করলেই হবে না; প্রয়োজন একীভূত, উচ্চ-পর্যায়ের জাতীয় তদন্ত, যেখানে অর্থনীতি, গোয়েন্দা সংস্থা ও প্রতিরক্ষা বাহিনী একসাথে কাজ করবে।
বাংলাদেশ আজ এক কঠিন সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে। আগুন আমাদের অবকাঠামো পোড়াতে পারে, কিন্তু জাতির মনোবল পোড়াতে পারে না। এই দেশ অগ্নিপরীক্ষা পার করে সবসময় নতুন করে জেগে উঠেছে। এবারও তার ব্যতিক্রম হবে না। কারণ, এই আগুন কেবল ধ্বংসের বার্তা নয় এটি সতর্কবার্তা, ঘুম থেকে জাগার সংকেত। বাংলাদেশ থামবে না; বরং ছাই থেকে উঠে দাঁড়িয়ে প্রমাণ করবে, উন্নয়নের পথ আগুনে রোখা যায় না।
রিফাত রহমান
শিক্ষার্থী, আইন ও ভূমি প্রশাসন অনুষদ
পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়