শৈশবেই গড়ে ওঠে সভ্য জাতির ভিত্তি
- ড. মো. আব্দুল জলিল
- প্রকাশ: ১৯ জুন ২০২৫, ০৬:৪৮ PM , আপডেট: ২৯ জুলাই ২০২৫, ০৮:৫৪ PM
একটি জাতির সভ্যতা, শৃঙ্খলা ও মানবিক গুণাবলির মূল ভিত্তি তৈরি হয় সেই জাতির নাগরিকদের শৈশবে, বিশেষত প্রাথমিক শিক্ষার স্তরে। বাল্যকালই হচ্ছে এমন একটি সময়, যখন একটি শিশুর ব্যক্তিত্ব, চিন্তা-চেতনা, মূল্যবোধ এবং নৈতিকতা গঠিত হয়। এ সময় যদি আমরা শিশুদের শিখিয়ে দিতে পারি আচরণ, বিনয়, শৃঙ্খলা, দায়িত্ববোধ, পরিবেশ সচেতনতা, সহমর্মিতা, সহানুভূতি এবং শ্রদ্ধাবোধ তবে ভবিষ্যতে তারা শুধু একজন শিক্ষিত মানুষ নয়, বরং একজন সুসভ্য ও নৈতিকতাসম্পন্ন নাগরিক হিসেবে গড়ে উঠবে।
জাপানের উদাহরণ
জাপান পৃথিবীর অন্যতম সভ্য, শৃঙ্খলিত ও উন্নত দেশ যার মূল ভিত্তি গড়ে উঠেছে তাদের শিক্ষাব্যবস্থার উপর। জাপানের প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোতে যে শিক্ষা দেওয়া হয় তা কেবল পাঠ্যপুস্তক নির্ভর নয়, বরং জীবনের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। শিশুদের বন-জঙ্গলে নিয়ে গিয়ে প্রকৃতিকে জানাতে শেখানো হয়; রাস্তা পারাপারের সময় ট্রাফিক নিয়ম শেখানো হয় ব্যবহারিকভাবে; খাওয়ার পর নিজের প্লেট পরিষ্কার রাখা, স্কুলের ফ্লোর ঝাড়ু দেওয়া, এমনকি টয়লেট পরিষ্কার করাও শেখানো হয়। এসব কাজের মাধ্যমে শিশুদের মধ্যে গড়ে ওঠে দায়িত্ববোধ, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা ও সামাজিক দায়বদ্ধতা।
জাপানি সমাজে তাই আমরা দেখি, একটি ছোট শিশু পর্যন্ত ময়লা কোথায় ফেলতে হবে জানে, লাইনে দাঁড়াতে জানে, অপরকে সম্মান দেখাতে জানে, নিজের কাজ নিজে করতে জানে। এর ফলাফল আমরা দেখতে পাই পুরো সমাজে যেখানে শৃঙ্খলা ও মানবিকতা প্রতিটি মানুষের দৈনন্দিন জীবনের অংশ।
বাংলাদেশের প্রাথমিক শিক্ষা ব্যবস্থার দুরবস্থা
অপরদিকে, আমাদের দেশের প্রাথমিক শিক্ষা ব্যবস্থা এক ভয়াবহ দুরবস্থার মধ্যে রয়েছে। পাঠ্যক্রমে চরিত্র গঠন বা নৈতিকতার শিক্ষা থাকলেও তা বাস্তবে প্রয়োগ হয় না। শিক্ষকরা অনেক সময় নিজেরাই সেই নৈতিকতা প্রদর্শন করতে ব্যর্থ। তাদের প্রশিক্ষণের অভাব, জবাবদিহিতার অভাব, এবং একটি সুসংগঠিত নীতিমালার অনুপস্থিতি শিক্ষার মূল উদ্দেশ্যকে ব্যাহত করছে।
বাংলাদেশের অনেক বিদ্যালয়ে বাচ্চারা শুধু পরীক্ষার প্রস্তুতি নিতে ব্যস্ত। জীবনের জন্য প্রয়োজনীয় আচরণিক শিক্ষা, পরিবেশ সচেতনতা, সামাজিক মূল্যবোধ এই সমস্ত বিষয় শিক্ষার পরিধির বাইরে রয়ে যাচ্ছে। শিশুদের শেখানো হয় না কীভাবে নিজের কাজ নিজে করতে হয়, কীভাবে পরিষ্কার রাখতে হয় আশেপাশের পরিবেশ, কিংবা কীভাবে ভদ্রভাবে কথা বলতে হয়।
ফলাফল: অসচেতন, স্বার্থপর, অবিনয়ী প্রজন্ম
এ ধরনের একতরফা ও সীমাবদ্ধ শিক্ষাব্যবস্থার ফলে আমরা পাচ্ছি এক ধরনের প্রজন্ম, যারা আত্মকেন্দ্রিক, দায়িত্বজ্ঞানহীন এবং সামাজিক শৃঙ্খলা রক্ষায় সম্পূর্ণ উদাসীন। আমরা রাস্তা-ঘাটে দেখি, মানুষ ময়লা ফেলছে যেখানে-সেখানে, লেন মেনে গাড়ি চালাচ্ছে না, লাইনে দাঁড়াতে চায় না, ধাক্কা লাগলেও ক্ষমা চায় না, এমনকি বৃদ্ধ বা নারীকে সম্মান জানানোতেও অনীহা প্রকাশ করে।
জাতি হিসেবে আমরা দিনে দিনে যেন কিছুটা অসভ্য হয়ে উঠছি, এটাই বাস্তবতা। নিজের সুবিধা আদায়ের জন্য অন্যের ক্ষতি করতেও পিছপা হচ্ছি না। ঘুষ, দুর্নীতি, প্রতারণা, অহংকার, অশ্রদ্ধা, এই সমস্ত নেতিবাচক প্রবণতা আমাদের সমাজে দিনদিন বৃদ্ধি পাচ্ছে, যার মূল উৎস খুঁজলে আমরা পাব শৈশবের সেই অপূর্ণ, বিকৃত এবং একপাক্ষিক শিক্ষা।
করণীয়
এ অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য আমাদের সবচেয়ে বেশি মনোযোগ দিতে হবে প্রাথমিক শিক্ষায়। শুধু পাঠ্যবইয়ের সিলেবাস নয়, বরং নৈতিকতা, সামাজিক আচরণ, সহানুভূতি, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা, নাগরিক দায়িত্ব—এই বিষয়গুলোকে পাঠক্রমের অবিচ্ছেদ্য অংশ করতে হবে। শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ দিতে হবে কীভাবে শিশুদের জীবনমুখী শিক্ষা দিতে হয়। পরিবার, স্কুল ও সমাজ তিনটি স্তর থেকেই শিশুদের মধ্যে গুণগত পরিবর্তনের জন্য একযোগে কাজ করতে হবে।
আমরা যদি শৈশবেই একটি শিশুকে ভালো মানুষ হিসেবে গড়ে তোলার কাজ শুরু করি, তবে ভবিষ্যতে সমাজে শৃঙ্খলা, সৌজন্যতা, এবং মানবিকতা ফিরে আসবে। সেই সঙ্গে বাংলাদেশও আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে একটি সুসভ্য ও সম্মানিত জাতি হিসেবে পরিচিতি পাবে। পরিশেষে বলা যায় শিশুরা জাতির ভবিষ্যৎ। তাদের মধ্যে সভ্যতার বীজ বপন করতে না পারলে ভবিষ্যতে আমরা যেমন সমাজ চাই, তা কোনোদিন বাস্তবে রূপ নেবে না। তাই আজই সময়, আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থায় মৌলিক ও মানবিক শিক্ষার পুনরুদ্ধার ঘটানোর।
লেখক: বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ, লেখক ও গবেষক, বিজিএমইএ ইউনিভার্সিটি অফ ফ্যাশন এন্ড টেকনোলজি ঢাকা।