শৈশবের ৫ টাকার ঈদ সালামি ছিল এক পরম প্রাপ্তি

এইচ এম আবদুল্লাহ আল মামুন
এইচ এম আবদুল্লাহ আল মামুন  © টিডিসি

বিশিষ্ট ইসলামিক সাংস্কৃতিক ও গণমাধ্যম ব্যক্তিত্ব এইচ এম আবদুল্লাহ আল মামুন, যিনি বর্তমানে তানজীমুল উম্মাহ আলিম মাদ্রাসা, মেইন ক্যাম্পাস, উত্তরা-ঢাকায় ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন—তিনি ঈদকে দেখেন এক ব্যতিক্রমী দৃষ্টিভঙ্গিতে। দ্য ডেইলি ক্যাম্পাসকে দেওয়া এক স্মৃতিচারণমূলক সাক্ষাৎকারে তিনি ফিরে তাকিয়েছেন নিজের শৈশবের ঈদ আনন্দে, যেখানে ঈদের মানে ছিল কেবল নতুন জামা বা সালামির সীমায় আটকে থাকা নয়—বরং সকলের সঙ্গে মিলেমিশে ভালো থাকার এক অসাধারণ প্রচেষ্টা।

লক্ষ্মীপুর জেলার জামিরতলি গ্রামে কেটেছে তাঁর শৈশব। সেখানকার সরল-সাধারণ ঈদ উদযাপনই তাঁর জীবনের সামাজিক চেতনার ভিত্তি গড়ে দেয়। ছোটবেলা থেকেই তাঁর মধ্যে ছিল নেতৃত্বের তীব্র আকাঙ্ক্ষা। ঈদের সকালে তাকবির দিতে দিতে পাড়ার ছোট-বড় সবাই মিলে যেতেন ঈদগাহে, যা ছিল তাঁর নানুবাড়ির পাশেই। নামাজ শেষে প্রথমেই যেতেন নানুর কাছে—তিনি মাথায় হাত বুলিয়ে দিতেন সালামি, মাত্র ৫ টাকা। যা ছিল এক পরম প্রাপ্তি।

ঈদের দিন দল বেঁধে এক বাড়ি থেকে আরেক বাড়ি গিয়ে কোলাকুলি, শুভেচ্ছা, আর সালামি সংগ্রহের সেই আনন্দ আজও তাঁর স্মৃতিতে উজ্জ্বল। কোনো বছর সালামির পরিমাণ দাঁড়াতো ৫০০ টাকাও, আর সেই টাকাতেই কিনে দিতেন গরিব শিশুদের জামাকাপড় কিংবা খাবার।

এই উদ্যোগ এক সময় রূপ নেয় মহল্লাকেন্দ্রিক ঈদ ঐক্যে। বড়রাও এতে আকৃষ্ট হয়ে পরে যুক্ত হন, যোগ দেন যুবকরাও। আজও সেই ঐতিহ্য চলছে। ঈদের নামাজের পর সবাই মিলে দলবদ্ধ হয়ে আশপাশের মানুষের বাড়িতে গিয়ে শুভেচ্ছা বিনিময় করেন, যেন সামাজিক বন্ধনের এক জীবন্ত নিদর্শন।

গত দুই বছর ধরে তিনি শিশু-কিশোরদের নিয়ে আয়োজন করছেন নাশিদ প্রতিযোগিতা—রাসূল (সা.)-এর জীবন ও ইসলামের বার্তা নিয়ে গান-কবিতার মাধ্যমে ঈদের আনন্দকে এক অনন্য মাত্রায় পৌঁছে দিচ্ছেন। তাঁর মতে, এই উদ্যোগ শিশুমনে ইসলামি মূল্যবোধ গড়ে তোলে।

শৈশবে যেভাবে সালামির টাকা গরিবদের জন্য ব্যয় করতেন, আজও তিনি সেই চর্চা বজায় রাখার চেষ্টা করেন। বলেন, “আজ আমি যখন শিশুদের সালামি দিই, তখন নিজের শৈশবের কথা মনে পড়ে। তখন আমরাও তো পেতাম! এখন দিচ্ছি। এটাই জীবনের চক্র। তবে একটা আফসোস থেকেই যায়—আজ আর কেউ আমার মাথায় হাত বুলিয়ে ৫ টাকার সালামি দেয় না।”

ঈদুল আযহা এলে তাঁর দায়িত্ব বেড়ে যায় বহুগুণ। পরিবারের সদস্যদের অনুপস্থিতিতে কোরবানির পুরো ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব কাঁধে তুলে নেন তিনি। আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য নিজ হাতে কোরবানি করেন, বিনিময়ে কোনো সম্মানী নেন না। অষ্টম শ্রেণি থেকে ঈদের খুতবা ও সালাত পরিচালনা করে আসছেন।

তাঁর মতে, নবীন ইসলামি স্কলারদের নিজ নিজ এলাকায় সমাজের প্রতি এমন দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করা উচিত। ঈদের দিন হোক নেতৃত্ব প্রদর্শনের এক উজ্জ্বল উদাহরণ।

ঈদের সময় এলাকার মানুষজন তাঁর সঙ্গে সময় কাটাতে চান। তিনি চেষ্টা করেন যাদের প্রয়োজন, তাদের পাশে দাঁড়াতে। কেউ কেউ বাড়িতে এসে থাকেন, সবাইকে সামর্থ্য অনুযায়ী সাহায্য করেন এবং ঈদের আনন্দে তাদের অংশীদার করেন। ঈদের নামাজ শেষে শত শত মানুষ কোলাকুলির জন্য অপেক্ষা করেন—এই মুহূর্তগুলোই তাঁর জীবনের শ্রেষ্ঠ প্রাপ্তি বলে মনে করেন তিনি।

শৈশবের একটি স্মৃতি তাঁকে আজও আন্দোলিত করে—পঞ্চম শ্রেণিতে পড়ার সময় বড় ভাই ও মামাদের পাঠানো অর্থ দিয়ে তিনি প্রায় ২০০-২৫০ পরিবারের মধ্যে সেমাই-চিনির প্যাকেট বিতরণ করতেন। এখন তাঁর ভাতিজারা সে দায়িত্ব বহন করছেন। এটিই তাঁর শৈশবের ছোট্ট উপহার, যা আজও জীবন্ত।

এইচ এম আবদুল্লাহ আল মামুন বলেন, ঈদ কেবল উৎসব নয়, এটি একটি আনন্দময় ইবাদত। ঈদ মানে সাম্য, ভালোবাসা ও সহানুভূতির বীজ বপন করা। শৈশব থেকে যে ভালো কাজের অভ্যাস শুরু করেছিলেন, আজও তা ধরে রাখার চেষ্টা করেন। তাঁর বিশ্বাস—ভালো কাজের সূচনা করলে তা প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে ছড়িয়ে পড়ে।

এইচ এম আবদুল্লাহ আল মামুনের এই স্মৃতিচারণ নিছক ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা নয়—বরং এটি একটি জনপদের সামাজিক বিবর্তনের সজীব দলিল। তাঁর শৈশবের ব্যক্তিগত উদ্যোগ ধীরে ধীরে মহল্লাভিত্তিক ঈদ ঐক্যে রূপ নেয়। শিশু-কিশোরদের অন্তর্ভুক্তিমূলক সংস্কৃতি, ধর্মীয় অনুভব আর মানবিক দায়িত্ববোধের মেলবন্ধন—এসবই তাঁর চিন্তার ঈদ।

একসময় ৫ টাকার সালামিতে খুশি হওয়া সেই ছোট্ট ছেলেটিই আজ শত শত শিশু ও অসহায় মানুষের মুখে হাসি ফোটানোর চেষ্টা করছেন। এটাই আত্মোন্নতির প্রকৃত ব্যাখ্যা।

আজ যখন ঈদ অনেকের কাছে ‘ভোগের উৎসব’ হয়ে দাঁড়িয়েছে, তখন এইচ এম আবদুল্লাহ আল মামুনের মতো মানুষেরা ঈদের প্রকৃত রূপকে সামনে আনছেন। ঈদ মানে কেবল পশু কোরবানি নয়, বরং নিজের আনন্দ, নিজের সামর্থ্য, নিজের নেতৃত্ব—সবকিছুকে সমাজের জন্য উৎসর্গ করা।

এই স্মৃতিচারণ আমাদের শেখায়—শৈশব থেকেই যদি ভালো কাজের অভ্যাস গড়ে তোলা যায়, তবে তা একদিন সমাজ পরিবর্তনের হাতিয়ার হয়ে উঠতে পারে। ঈদ হোক ভ্রাতৃত্ব, সহানুভূতি আর নেতৃত্বের এক বার্ষিক অনুশীলন—এই হোক আমাদের অঙ্গীকার।


সর্বশেষ সংবাদ