অনিয়ম ও দুর্নীতি
রাণীপুরা আলিম মাদ্রাসার অধ্যক্ষের বিরুদ্ধে মন্ত্রণালয়-অধিদপ্তরসহ সরকারি ৬ দপ্তরে অভিযোগ
- টিডিসি রিপোর্ট
- প্রকাশ: ১৮ নভেম্বর ২০২৫, ১০:৪৫ PM , আপডেট: ১৮ নভেম্বর ২০২৫, ১০:৪৫ PM
নিয়মিত মাদ্রাসায় না আসা, শিক্ষক পদোন্নতিতে উৎকোচ নেওয়া, মাদ্রাসার উন্নয়ন ফান্ডের তছরুপসহ নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জ উপজেলায় অবস্থিত রাণীপুরা মাদ্রাসাতুল কোরআন ওয়াস সুন্নাহ আলিম মাদ্রাসার অধ্যক্ষ মুহাম্মদ শহিদ হোসাইনের বিরুদ্ধে নানা অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে। এর পরিপ্রেক্ষিতে সম্প্রতি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটির সচেতন অভিভাবক ও এলাকাবাসীর উদ্যোগে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাদ্রাসা ও কারিগরি শিক্ষা বিভাগ, মাদ্রাসা শিক্ষা অধিদপ্তর, মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ডসহ সরকারি ৬ দপ্তরে একটি অভিযোগ জমা দিয়েছেন। এতে তার বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে অনুরোধ করা হয়েছে। বাকি দপ্তরগুলো হলো জেলা শিক্ষা অফিস, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার অফিস ও উপজেলা শিক্ষা অফিস।
অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে মাদ্রাসার অ্যাডহক কমিটির সভাপতি ও উপজেলা একাডেমিক সুপারভাইজার আশরাফুল আলম সিদ্দিকী দ্য ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, ‘মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ড ও মাদ্রাসা শিক্ষা অধিদপ্তরসহ সরকারি বিভিন্ন দপ্তরে এ ধরনের অভিযোগ জমা দিয়েছে শুনেছি। তা ছাড়া ডাকযোগে আমার কাছেও অভিযোগটি এসেছে।’
তবে অধ্যক্ষের বিরুদ্ধে এসব অভিযোগ সঠিক নয় বলে দাবি করে তিনি বলেন, ‘মাদ্রাসায় একজন নাইট গার্ড রয়েছেন। রাতে তিনি সঠিকভাবে দায়িত্ব পালন না করায় চুরির ঘটনা ঘটেছে। এ ঘটনার তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার তার উদ্যোগে এ ধরনের মিথ্যা অভিযোগ জমা দেওয়া হয়েছে।’
মাদ্রাসার সাবেক সভাপতি, স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা ও সাবেক পৌর মেয়র রফিকুল ইসলামের আত্মীয় আরমান হোসেনের সঙ্গে আর্থিক লেনদেনের মাধ্যম অধ্যক্ষ হিসেবে নিয়োগ পাওয়ার অভিযোগ রয়েছে মুহাম্মদ শহিদ হোসাইনের বিরুদ্ধে।
অভিযোগ সূত্রে জানা গেছে, নিয়োগ পেয়েই তিনি অধ্যক্ষের কার্যালয় সংস্কারের নামে মাদ্রাসার ফান্ড ভাঙা শুরু করেন। মাদ্রাসার অফিস সহকারী আজাদুলের সঙ্গে যোগসাজশ করে নানা ভুয়া ভাউচার বানিয়ে মাদ্রাসার অর্থ ইচ্ছামতো ব্যয় অব্যাহত রাখারও অভিযোগ ওঠে। এ ছাড়া মোহাম্মদ শহিদ হোসাইন অধ্যক্ষ হিসেবে যোগদানের পর থেকে শিক্ষক, কর্মচারীদের কাছ থেকে যোগদানের পর ‘মাদ্রাসা উন্নয়ন তহবিলে অনুদান’ নানা নামে উৎকোচ নেন বলে জানান মাদ্রাসার শিক্ষকরা।
জানা গেছে, মাদ্রাসাটির মানোন্নয়নকল্পে মাদ্রাসার কোনো শিক্ষক পরামর্শ দিতে চাইলে, পরবর্তী সময়ে সুযোগ বুঝে অন্য কোনো ইস্যুতে ওই শিক্ষকদের শাসিয়ে দেওয়া হয় এবং কথায় কথায় শিক্ষকদের শোকজ ও চাকরি খাওয়ার হুমকি দেন অধ্যক্ষ। ইতোমধ্যে তার আচরণে ক্ষুব্ধ হয়ে দুজন শিক্ষক অব্যাহতি নিয়ে অন্যত্র চলে গেছেন।
মাদ্রাসার উন্নয়ন বা শিক্ষার্থীদের মানোন্নয়নে কোনো পদক্ষেপ না নেওয়া হলেও শিক্ষকের পদোন্নতি বা কোনো রেজুলেশন করতে প্রত্যেককে মাদ্রাসা উন্নয়ন বা নানা নামে ঘুষ-উৎকোচ দিতে হয়েছে। এর মধ্যে প্রতিষ্ঠানটির সহকারী অধ্যাপক (বাংলা) তাহমিনা খাতুন ২৫ হাজার টাকা, সহকারী অধ্যাপক (ইংরেজি) ড. আব্দুল মালেককে ২৫ হাজার টাকা, সহকারী অধ্যাপক (ইসলামের ইতিহাস) কাওসার আহমদকে ৩০ হাজার টাকা, হোসনে আরা বেগমকে একটি সোফার টাকা দিতে হয়েছে। এ ছাড়া মাদ্রাসার মাঠ ইজারাসহ বিভিন্ন আয় ও ফান্ডগুলো নানাভাবে তছরুপ করার অভিযোগ রয়েছে অধ্যক্ষের বিরুদ্ধে।
এ ছাড়া নতুন নিয়োগপ্রাপ্ত প্রত্যেক শিক্ষক-কর্মচারীকে ৫ থেকে ১০ হাজার টাকা পর্যন্ত দিতে হয়েছে। এ ছাড়া উপঢৌকনের নামে মাদ্রাসার অফিস সহকারী আজাদুলকে ৫০০-১০০০ টাকা দিতেই হয়। তবে স্থানীয় ও প্রভাবশালীদের সঙ্গে সম্পর্ক থাকায় মাদ্রাসার সহকারী ক্রীড়া শিক্ষক আহিহাব উদ্দিনকে প্রমোশনের সময় টাকা দিতে হয়নি।
অভিযোগ সূত্রে জানা গেছে, শিক্ষকদের বিষয়ে জানতে মাদ্রাসার পিয়ন ও আয়াদের মাধ্যমে খোঁজখবর রাখেন অধ্যক্ষ। নিয়মিত মাদ্রাসায় না এলেও অফিসে এলেও সকাল ১০টার পরে আসেন এবং অল্প সময় থেকে চলে যাওয়ার অভিযোগ রয়েছে। এ ছাড়া শিক্ষকদের সঙ্গে নিয়মিতই করেন খারাপ আচরণ। প্রায়ই শিক্ষকদের সঙ্গে ধমকের সুরে কথা বলেন তিনি। কখনো কখনো দেরিতে মাদ্রাসায় এলেও দুপুর ১২টার দিকে বের হয়ে গিয়ে স্থানীয় বাজারে মাসুমের ফার্মেসি দোকানে বসে আড্ডায় দেন।
এসব বিষয়ে শিক্ষকরা প্রশ্ন তুললে অধ্যক্ষ বলেন, ‘আমি কোনো অভিভাবকের সঙ্গে চা খেয়ে আসতে একটু লেট হতেই পারে। আমারটা আমি সভাপতি বা কর্তৃপক্ষের কাছে জবাব দেব। আমি আপনাদের (শিক্ষক-কর্মচারী) বস, সে হিসেবে আমার কাছে জবাবদিহি করতে বাধ্য আপনারা, আমি নই।’
সম্প্রতি মাদ্রাসার অ্যাডহক কমিটি করা হয়। উপজেলার এক বিতর্কিত কর্মকর্তা অ্যাকাডেমিক সুপার ভাইজার আশরাফ সিদ্দিকীকে সভাপতি এবং স্থানীয় ফার্মেসি দোকানদার মশিউর রহমান মাসুম বিল্লাহকে অভিভাবক সদস্য বানানো হয়।
নিয়ম অনুযায়ী অভিভাবক কমিটির সদস্য হতে হলে সন্তান-সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থী হতে হয়। তবে মাসুম বিল্লাহর এক ছেলে অন্য প্রতিষ্ঠানের পাশাপাশি এই মাদ্রাসার সপ্তম শ্রেণিতে ভর্তি দেখিয়ে তাকে অভিভাবক সদস্য করা হয়।
অভিযোগ সূত্রে জানা গেছে, সম্প্রতি আলিম প্রথম বর্ষে ভর্তিসংক্রান্ত ইস্যুতে পার্শ্ববর্তী মহিলা মাদ্রাসার শিক্ষক ও এলাকার কিছু অভিভাবকদের সঙ্গে এ মাদ্রাসার শিক্ষক-কর্মচারীদের তর্ক-বিতর্কের ঘটনা ঘটে। ওই মহিলা মাদ্রাসার শিক্ষক বলেন, অধ্যক্ষ শহিদ হোসাইন শিক্ষার্থী বা অভিভাবকদের সঙ্গে যোগাযোগ না করে তার মাদ্রাসায় আলিম শ্রেণিতে কয়েকজন শিক্ষার্থীকে ভর্তির আবেদন করে দেন। অনুমতি ছাড়া কাউকে ছাড়পত্র না দিতে অফিস কর্মকর্তাদের নির্দেশ দিয়ে ঘটনার সপ্তাহে অধ্যক্ষ মাদ্রাসায় আসেননি।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন স্থানীয় অভিভাবক বলেন, ‘অধ্যক্ষ শহিদ হোসাইনকে তো মাদ্রাসায় তেমন দেখি না। উনি কখন আসেন কখন যায় কেউ জানেন না।’
স্থানীয় এলাকাবাসীদের একজন বলেন, ‘প্রিন্সিপাল তো এখানে ফার্মেসিতেই (মাদ্রাসার পাশে স্থানীয় মাসুম বিল্লাহ নামের একজনের ফার্মেসির দোকান) ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসে থাকেন, অফিস করেন কখন?’
স্থানীয় এক বাসিন্দা বলেন, ‘মাসুম বিল্লাহ জোর করে মাদ্রাসার অফিস সহকারী হতে চেয়েছিল এক সময়, যার মাদ্রাসার অফিস সহকারী হওয়ার যোগ্য হয়নি, তার দোকানেই এখন মাদ্রাসা চলাকালে অফিস করেন অধ্যক্ষ শহিদ হোসাইন। কিছুদিন পূর্বে বাইক অ্যাক্সিডেন্টে পা ভেঙে দীর্ঘ দুই মাস মাদ্রাসায় না এলেও প্রিন্সিপাল শহিদ হোসাইন কোনো ছুটি নেননি। কাউকে ভারপ্রাপ্ত দায়িত্বও দেননি এবং পূর্ণ বেতন ভোগ করেন। এ সময় তিনি তার কথিত প্রতিনিধি মাসুম বিল্লাহকে (ফার্মেসি দোকানদার) মাদ্রাসার শিক্ষকদের ওপর নজর রাখার জন্য বলেন।’
এ বিষয়ে রাণীপুরা মাদ্রাসাতুল কোরআন ওয়াস সুন্নাহ আলিম মাদ্রাসার অধ্যক্ষ শহিদ হোসাইন দ্য ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, ‘আমার বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ কাল্পনিক, কেউ যদি খুশি হয়ে মাদ্রাসায় কোনো উপহার দেয়, তা তো না করা যায় না। তবে শিক্ষক যোগদানের নামে কোনো টাকা বা উপহার নেওয়া হয়নি। আমি নিয়মিত মাদ্রাসায় আসি এবং সবার আগে আসি ও সবার পরে বের হই।’
অন্য মাদ্রাসা থেকে শিক্ষার্থী ভর্তি করানোর বিষয়ে তিনি বলেন, ‘পাশের একটি মাদ্রাসার রেজিস্ট্রেশন নেই, তাই সেখানকার শিক্ষার্থীরা এখানে আলিমে ভর্তি হয়েছে। কেউ এসে ভর্তি হতে চাইলে আমাদের তো করার কিছু নেই।’