মা, আমি তো শুধু তোমার ছেলে না—দেশেরও ছেলে হবো একদিন

গণঅভ্যুত্থানে নিহত শহীদ মো. আবুজর শেখ
গণঅভ্যুত্থানে নিহত শহীদ মো. আবুজর শেখ  © টিডিসি সম্পাদিত

২০২৪ সালের রক্তাক্ত জুলাই। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলন তখন সবে রূপ নিচ্ছে গণঅভ্যুত্থানে। ঢাকার রাজপথে ন্যায়ের দাবিতে হাজারো তরুণের রক্ত ঝরছে। সেই উত্তাল দিনে গুলিতে ঝরে যায় আরেকটি তরুণ প্রাণ—জামালপুর জেলার মেলান্দহ উপজেলার নলগ্রামের সন্তান মো. আবুজর শেখ। ছাত্র-রাজনীতির সঙ্গে সরাসরি যুক্ত ছিলেন না তিনি, কিন্তু অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে পেছপা হননি কখনো।

শহীদ আবুজর শেখ, মেলান্দহের নলগ্রামের একজন সাধারণ কৃষক পরিবারের সন্তান। বাবা ছবুম মন্ডলের মৃত্যু হয় তখন, যখন আবুজর সবে হাঁটতে শিখেছে। মা মোছা. ছবি একাই ছেলেকে বড় করেন, শত অভাব আর দারিদ্র্যের সঙ্গে লড়াই করে। ছেলেকে মানুষ করার স্বপ্ন ছিল তার চোখে। বলতেন, ‘আমার আবুজর শিক্ষক হবে, গ্রামের ছেলেমেয়েদের পড়াবে।’ আবুজরও বলত, ‘মা, আমি তো শুধু তোমার ছেলে না, দেশেরও ছেলে হবো একদিন।’

স্কুলজীবন থেকেই আবুজর অন্যায়ের প্রতিবাদ করতেন। কারও বই না থাকলে ভাগ করে দিতেন, দুর্বল ছাত্রদের পাশে দাঁড়াতেন। ছিলেন মেধাবী ও নম্র স্বভাবের, বন্ধুরা বলত—‘আবুজর ভাই চুপচাপ, কিন্তু সময় এলে ঠিক সামনে দাঁড়ান।’

আরও পড়ুন: ‘রিয়াদ বাঁচলে বিসিএস ক্যাডার হতো, সব স্বপ্ন এক নিমিষে শেষ’

ঢাকায় এসে এক মেসে থাকতেন, পড়ালেখার পাশাপাশি করতেন খণ্ডকালীন কাজ। নিজ খরচ নিজেই চালাতেন। কখনও কারো ওপর নির্ভর করতেন না। ২০২৪ সালের জুলাই মাসে যখন সারা দেশজুড়ে ছাত্র-জনতার গণআন্দোলন শুরু হয়, তখন আবুজরও দাঁড়ান সাধারণ মানুষের পক্ষে। ১৯ জুলাই বিকাল সাড়ে ৫টার দিকে ঢাকার নন্দা ভট্টার ব্রিজ এলাকায় ছাত্রদের একটি শান্তিপূর্ণ সমাবেশে অংশ নেন তিনি।

সেই সমাবেশেই আচমকা শুরু হয় পুলিশের গুলিবর্ষণ। আন্দোলন ছত্রভঙ্গ হয়ে যায়। হুড়োহুড়ির মধ্যেই আবুজরের পেটে লাগে একটি গুলি। রক্তে ভিজে যায় শরীর। বন্ধুরা তখনই হাসপাতালে নিতে চাইলেও রাস্তায় ছিল একাধিক ব্যারিকেড। এক পর্যায়ে পুলিশ তাকে গ্রেপ্তার করে নিয়ে যায় থানায়। কয়েক ঘণ্টা আটকে রাখার পর তাকে নেয়া হয় ঢাকার মেট্রোপলিটন মেডিকেল সেন্টারে।

সাত দিন মৃত্যুর সঙ্গে লড়াই করেন আবুজর। হাসপাতালের বেডে নিঃশব্দে কাঁদে তার মা। গ্রামের সেই দৃশ্যপট বদলে যায়, হাসপাতালে রক্তমাখা ছেলের পাশে দাঁড়িয়ে শোকবিহ্বল এক মা বলে ওঠেন—‘তুই তো কারো ক্ষতি করিস নাই রে বাবা… ওরা তোকে মেরে ফেললো কেন?’ শেষ পর্যন্ত ২৭ জুলাই রাত ১১টা ২০ মিনিটে মৃত্যুর কাছে হার মানেন আবুজর। মৃত্যুর সনদে লেখা হয়: Primary cause of death: Firearm injury।

আরও পড়ুন: ‘স্বৈরাচার হাসিনা আমার সুখের সংসারটা তছনছ করে দিছে—আমি তার ফাঁসি চাই’

নিজ গ্রামে ফিরিয়ে আনা হয় তার নিথর দেহ। যেন গোটা নলগ্রাম স্তব্ধ হয়ে যায়। দাফনের সময় গ্রামের বহু মানুষ ভিড় করে—চোখে জল, মুখে আক্ষেপ, আর হৃদয়ে প্রশ্ন—‘এই ভালো ছেলেটাকে কেন মরতে হলো?’

তার মা বলেন, ‘ছেলেকে পড়াতে গিয়ে ধার করেছি, এখন সেই ধারেই বেঁচে আছি। কেউ এসে জিজ্ঞেস করে না, আমি কেমন আছি। সরকারকে বলি, আমার সন্তানের রক্ত যেন বৃথা না যায়। এমন মৃত্যু আর কোনো মায়ের দেখতে না হয়।’

আবুজরের পরিবারকে কিছু অনুদান দেয় ‘জুলাই স্মৃতি ফাউন্ডেশন’ ও জামায়াতে ইসলামি সহ কয়েকটি সংগঠন, কিন্তু তার মা বলেন—‘টাকা দিয়ে কি আমার আবুজর ফিরবে? আমি শুধু চাই, তার রক্ত যেন ইতিহাসে অমলিন থাকে।’

প্রসঙ্গত, ২০২৪ সালের জুলাইয়ে কোটা সংস্কারের দাবিতে দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ও চাকরিপ্রত্যাশীরা ন্যায্য অধিকার আদায়ের দাবিতে আন্দোলনে নামেন। শুরুতে এই আন্দোলন ছিল শান্তিপূর্ণ, কিন্তু সরকার তা দমন-পীড়নের মাধ্যমে প্রতিহত করার চেষ্টা করে। এতে পরিস্থিতি আরও উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। সরকার এই শান্তিপূর্ণ আন্দোলনে দমন-পীড়নের মাধ্যমে থামাতে গিয়ে সরকারই আরও প্রবল প্রতিরোধের মুখে পড়ে। ছাত্র-জনতার শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভ দমনে সরকারের সহিংস হস্তক্ষেপে প্রায় হাজারো নিরস্ত্র মানুষ প্রাণ হারান, আহত হন হাজার হাজার। মাত্র তিন সপ্তাহের মধ্যে আন্দোলন পরিণত হয় গণঅভ্যুত্থানে। পতন ঘটে টানা ১৫ বছর ক্ষমতায় থেকে দীর্ঘদিন নিপীড়ন নির্যাতন চালানো আওয়ামী লীগ সরকারের। ক্ষমতাসীন দলের সভানেত্রী শেখ হাসিনা দেশ ছেড়ে পালিয়ে ভারতে আশ্রয় নিতে বাধ্য হন।


সর্বশেষ সংবাদ