ছাত্রদের আন্দোলনে যোগদিয়ে গুলিতে ঝাঁঝরা হলেন শহীদ লিটন

গণঅভ্যুত্থানে নিহত শহীদ মো. লিটন
গণঅভ্যুত্থানে নিহত শহীদ মো. লিটন  © টিডিসি সম্পাদিত

২০২৪ সালের রক্তাক্ত জুলাই। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলন তখন সবে রূপ নিচ্ছে গণঅভ্যুত্থানে। উত্তাল রাজধানী ঢাকায় বৈষম্যহীন নতুন বাংলাদেশ গড়ার স্বপ্নে রাস্তায় রক্ত ঝরছে তরুণদের। একদিকে মিছিল-স্লোগানে মুখর রাজপথ, অন্যদিকে গুলির শব্দে কাঁপছে শহর। অভ্যুত্থানে জামালপুর জেলার ইসলামপুর উপজেলার এক তরুণ শহীদ হন, যিনি আমাদের সময়ের এক নীরব নায়ক মো. লিটন।

লিটনের পুরো নাম লিটন আনছারী। তিনি ইসলামপুর উপজেলার খামারিয়া পাড়া গ্রামের সন্তান। বাবা ছবুম মন্ডল, মা জামিলা। সাত ভাইবোনের মধ্যে তিনি ছিলেন সবার ছোট — দুই বোন আর পাঁচ ভাইয়ের ছোট্ট, আদরের সন্তান। একসময় স্বপ্ন দেখা শুরু করেছিলেন, হয়তো তিনিও একদিন পরিবারের মুখ উজ্জ্বল করবেন, মা-বাবার কষ্ট কমাবেন।

গ্রামের খামারিয়া পাড়া থেকে উঠে এসে লিটনের পথচলা সহজ ছিল না। একসময় ঢাকায় চলে আসেন জীবিকার তাগিদে। থাকতেন মধ্য বাড্ডায়। তিনি পেশায় ছিলেন গার্মেন্টসকর্মী। প্রতিদিন সকাল থেকে রাত পর্যন্ত পরিশ্রম, তারপর অল্প সময় নিজের মতো,এই ছিল তার জীবনচক্র। তবে শুধু নিজের জন্য নয়, পরিবারের জন্যই মূলত তার সব পরিশ্রম।তবে তার ভেতরে ছিল এক সংগ্রামী মন। তিনি চোখে স্বপ্ন দেখতেন। এমন একটি রাষ্ট্রের, যেখানে সাধারণ মানুষের কথা শোনা হবে, যেখানে সরকার হবে জবাবদিহিতার, যেখানে শিক্ষা ও চাকরি থাকবে সকলের নাগালে।

আরও পড়ুন: আঁটকে পড়াদের উদ্ধারে গিয়ে নিজের প্রাণই দিলেন আলামিন

২০২৪ সালের জুলাই মাসে ঢাকা উত্তাল হয়ে ওঠে। শিক্ষার্থীরা রাজপথে নামে কোটা সংস্কার, নিয়োগে স্বচ্ছতা এবং সরকারের স্বৈরাচারী দমন-পীড়নের বিরুদ্ধে। হাজার হাজার তরুণের সাথে লিটনও নিজেকে এই আন্দোলনের এক অংশ করে তোলেন। যদিও তিনি ছাত্র ছিলেন না, কিন্তু ছাত্রদের উদ্দেশ্য ছিল তার হৃদয়ের কাছাকাছি। তিনি নিজে থেকে ছাত্রদের পাশে দাঁড়ান, মিছিল করেন, স্লোগান দেন।

লিটনের পরিবার জানতো, সে আন্দোলনে যুক্ত, কিন্তু তারা ভাবেনি তা এতটা ভয়াবহ পরিণতিতে যাবে। পরিবার শুধু জানত, লিটনের ভেতরে অন্যায় সহ্য না করার এক অসীম শক্তি আছে।

২০ জুলাই ২০২৪, শনিবার। সকাল ১১টা। চারপাশে উত্তেজনা, টিয়ার গ্যাস, গুলির শব্দ। সে সময় রাজধানী ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় পুলিশ ও আন্দোলনকারীদের মধ্যে তুমুল সংঘর্ষ চলছিল। লিটনও ছিলেন সেই বিক্ষোভকারীদের সঙ্গে। একপর্যায়ে, ক্ষুধা লেগে যায় তার। অনেকক্ষণ ধরে না খেয়ে আন্দোলনে ছিলেন। হেঁটে যাচ্ছিলেন একটি হোটেলের দিকে, হয়তো ভাত বা রুটি খেয়ে আবার মিছিলে ফিরে আসবেন এমন আশায়।

কিন্তু ভাগ্য তা হতে দিল না।তখনই হঠাৎ পুলিশের একটি দল গুলিবর্ষণ শুরু করে। কেউ দৌড় দিল, কেউ আশ্রয় নিল। আর লিটন? মাথায় একটি গুলি লাগে তার। মুহূর্তেই রাস্তায় লুটিয়ে পড়েন। আশেপাশের কেউ এগিয়ে আসতে পারেনি গুলির ভয়াবহতায়। কিছুক্ষণ পর পুলিশ গায়ে লাঠি দিয়ে সরিয়ে দেয় তার নিথর দেহ।একজন তরুণ, একজন শ্রমিক, একজন ভাই  এইভাবে শহীদ হলেন।

আরও পড়ুন: ‘হাসিনার পতন ঘটাইয়া বাড়িত আইয়াম— আইল ঠিকই, কিন্তু লাশ হইয়া’

খবর ছড়িয়ে পড়ে গ্রামে  লিটন মারা গেছে, গুলিতে। প্রথমে কেউ বিশ্বাস করেনি। জামিলা বেগম ছেলের ফোনে বারবার কল দিয়েছিলেন, কিন্তু সাড়া মেলেনি। পরে লাশের ছবি ভাইরাল হলে, তার ভাইয়েরা ঢাকায় ছুটে আসে কিন্তু লাশ নিয়ে যেতে পায়নি তাৎক্ষণিক। কোন অ্যামবুলেন্স পাইনি। পরের রাত ১১:০০ টার পর অ্যাম্বুলেন্স নিয়ে দীর্ঘ সময় নিয়ে তার ঘরের পাশেই শহীদ লিটনকে কবর দেয়া হয়।

তার মা কাঁদতে কাঁদতে বলেন, ছোট ছিল, মায়া ছিল খুব… মানুষকে কষ্ট দিতে পারতো না… দেশ ঠিক করার স্বপ্ন দেখতো।

প্রসঙ্গত, ২০২৪ সালের জুলাইয়ে কোটা সংস্কারের দাবিতে দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ও চাকরিপ্রত্যাশীরা ন্যায্য অধিকার আদায়ের দাবিতে আন্দোলনে নামেন। শুরুতে এই আন্দোলন ছিল শান্তিপূর্ণ, কিন্তু সরকার তা দমন-পীড়নের মাধ্যমে প্রতিহত করার চেষ্টা করে। এতে পরিস্থিতি আরও উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। সরকার এই শান্তিপূর্ণ আন্দোলনে দমন-পীড়নের মাধ্যমে আন্দোলন দমন করতে গিয়ে সরকারই আরও প্রবল প্রতিরোধের মুখে পড়ে। ছাত্র-জনতার শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভ দমনে সরকারের সহিংস হস্তক্ষেপে প্রায় হাজারো নিরস্ত্র মানুষ প্রাণ হারান, আহত হন হাজার হাজার। মাত্র তিন সপ্তাহের মধ্যে আন্দোলন পরিণত হয় গণঅভ্যুত্থানে। পতন ঘটে টানা ১৫ বছর ক্ষমতায় থেকে দীর্ঘদিন নিপিড়ীন নির্যাতন চালানো আওয়ামী লীগ সরকারের। ক্ষমতাসীন দলের সভানেত্রী শেখ হাছিনা দেশ ছেড়ে পালিয়ে ভারতে আশ্রয় নিতে বাধ্য হন।


সর্বশেষ সংবাদ

X
APPLY
NOW!