ডাক্তার হওয়ার স্বপ্ন দেখতেন সাভার ক্যান্টনমেন্ট স্কুলের ছাত্র সদ্য
- জাবির আহম্মেদ জিহাদ, জামালপুর প্রতিনিধি
- প্রকাশ: ০২ জুলাই ২০২৫, ০৫:৫০ PM , আপডেট: ০৫ জুলাই ২০২৫, ০২:৪১ PM
২০২৪ সালের রক্তাক্ত জুলাই। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলন তখন সবে রূপ নিচ্ছে গণঅভ্যুত্থানে। উত্তাল রাজধানী ঢাকায় বৈষম্যহীন নতুন বাংলাদেশ গড়ার স্বপ্নে রাস্তায় রক্ত ঝরছে তরুণদের। একদিকে মিছিল-স্লোগানে মুখর রাজপথ, অন্যদিকে গুলির শব্দে কাঁপছে শহর। এমন এক পড়ন্ত বিকেলে সাবওয়ান আকতার সদ্য বন্ধুদের সাথে মিছিলে গিয়ে ফিরলেন নিথর দেহ হয়ে, পুলিশের গুলিতে ঝাঁঝরা বুক নিয়ে।
জামালপুর সদর উপজেলার শরীফপুর ইউনিয়নের রঘুনাথপুর গ্রামে জন্ম নেওয়া সদ্যর মা খাদিজা বিন জুবাইদ তার নাম রেখেছিলেন ভালোবাসা থেকে— এই নামটার মধ্যেই যেন সদ্য ফোঁটা ফুলের মতো একটা প্রাণ আছে বলতেন তিনি। ছোটবেলা থেকেই সদ্য ছিলো শান্ত স্বভাবের, গভীর দৃষ্টি ও স্পষ্ট উচ্চারণের একজন চিন্তাশীল শিশু। খেলাধুলা ভালোবাসলেও, তার চোখ সবসময় ছুটে যেত দেশের খবর আর সমাজের অন্যায়ের দিকে।
সাভার ক্যান্টনমেন্ট পাবলিক স্কুল অ্যান্ড কলেজের দশম শ্রেণির ছাত্র ছিল সদ্য। মা-বাবা স্বপ্ন দেখতেন সে ডাক্তার হবে, মানুষের সেবা করবে। কিন্তু সদ্য বলতো— ‘ডাক্তার হবো ঠিকই, কিন্তু অন্যায়ের বিরুদ্ধে আমি কখনো চুপ থাকতে পারি না আম্মু।’ বন্ধুরা তাকে ডাকত ‘ছোট নেতা’ নামে। কেউ বিপদে পড়লে সদ্য-ই আগে গিয়ে দাঁড়াতো। শিক্ষকরা ভালোবাসতেন তার বিনয় আর প্রশ্ন করার সাহসের জন্য।
আরও পড়ুন: ‘হাসিনার পতন ঘটাইয়া বাড়িত আইয়াম— আইল ঠিকই, কিন্তু লাশ হইয়া’
২০২৪ সালের জুন-জুলাইয়ে ঢাকাসহ সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ে কোটা সংস্কার আন্দোলন। বিশ্ববিদ্যালয়ের পর স্কুল-কলেজের ছাত্রছাত্রীরাও সংহতি জানাতে রাস্তায় নামে। সদ্য বলতো, ‘আজকের সিদ্ধান্তেই তো আমাদের ভবিষ্যৎ গড়া হবে। এটা শুধু বড়দের বিষয় নয়।’ তার সেই প্রত্যয়ের ফলেই সে অংশ নেয় সাভারে ছাত্রদের এক শান্তিপূর্ণ সমাবেশে। বাবা জানতেন না, সে কোথায় যাচ্ছে। মা জানতেন না, সেটাই ছেলের শেষবারের মতো ব্যাগ গোছানো।
৫ আগস্ট ২০২৪ (সোমবার)। সাভার থানার মোড়ে ছাত্রদের সমাবেশ চলছিল। মুখে স্লোগান, হাতে প্ল্যাকার্ড— এই দেশ বৈষম্যের নয়, ‘শেখ হাসিনা দেশ ছেড়ে পালাও’। দুপুরের সূর্য তখন উত্তপ্ত। হঠাৎ পুলিশের গাড়ি থামে। বিনা উসকানিতে শুরু হয় গুলিবর্ষণ। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই গুলিতে লুটিয়ে পড়ে সদ্য।
বন্ধুরা দৌড়ে আসে, একজন তাকে কোলে তুলে নেয়। সঙ্গে সঙ্গে তাকে নিয়ে যাওয়া হয় এনাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। কিন্তু চিকিৎসকরা জানান— সাবওয়ান আকতার সদ্য শহীদ হয়েছেন।
বাবা মো. আখতারুজ্জামান যখন হাসপাতালে পৌঁছান, তখন ছেলের লাশ ঢাকা হয়ে গেছে। খোলা ছিল শুধু মুখ। তিনি চিৎকার করে কাঁদেন না, চোখে জলও আসে না— স্তব্ধ হয়ে শুধু বলেন, ‘তুই তো খেলতে গেছিস বাবা, ফিরে এলি কেন কফিনে?’ মা খাদিজা বারবার ছেলের মুখে হাত রেখে বিলাপ করছিলেন, ‘আমার সদ্য সব সময় সবার আগে হাঁটতো, এখন সবচেয়ে পেছনে শুয়ে আছে।’
আরও পড়ুন: আঁটকে পড়াদের উদ্ধারে গিয়ে নিজের প্রাণই দিলেন আলামিন
লাশ আসে নিজ গ্রামে জামালপুরের রঘুনাথপুরে। সারা গ্রামের মানুষ কাঁদে, যারা চিনত না তারাও কাঁদে। তার ছোট ভাই কিছুই বুঝে না, শুধু বলে, ‘ভাইয়া আবার খেলতে যাবে?’ — এই প্রশ্ন শুনে কান্না চেপে রাখা কেউই আর পারে না।
সাবওয়ান আকতার সদ্যর কবর হয় গ্রামের মাটিতেই—ছোট্ট একটা কবর, কিন্তু দেশের ইতিহাসে গেঁথে যায় অমর শিকড়। এই শিশুর শহীদ হওয়া দেশের স্কুল-কলেজে, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে, পত্রিকায়, পরিবারের মুখে মুখে আলোড়ন তোলে।
২০২৪ সালের সেপ্টেম্বরে ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা মো. নাহিদ ইসলাম সরাসরি সদ্যর বাবার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। সেই দৃশ্য ভাইরাল হয়। শহীদ বাবাকে জড়িয়ে ধরে তিনি বলেন, ‘আপনার সন্তান শুধু আপনার নয়, সে এখন এই জাতির সন্তান।’ সরকারের পক্ষ থেকে সদ্যর নামে একটি বৃত্তি, স্মারক এবং জাতীয় শিক্ষা প্রকল্প চালুর ঘোষণা দেওয়া হয়।
আজো সকালে ছেলের ছবির সামনে বসে দোয়া পড়েন মা। মাঝে মাঝে বলেন, ‘সদ্য, তোর জন্য আমি দুধ-ভাত রেখে দিয়েছি, ফিরে আয় না।’ বাবা চুপচাপ বসে থাকেন উঠোনের সেই গাছের নিচে, যেখানে সদ্য দৌড়াতো। পাখির ডাক শুনলে বলেন— ‘এই বুঝি সদ্য ডাকছে!’
প্রসঙ্গত, ২০২৪ সালের জুলাইয়ে কোটা সংস্কারের দাবিতে দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ও চাকরিপ্রত্যাশীরা ন্যায্য অধিকার আদায়ের দাবিতে আন্দোলনে নামেন। শুরুতে এই আন্দোলন ছিল শান্তিপূর্ণ, কিন্তু সরকার তা দমন-পীড়নের মাধ্যমে প্রতিহত করার চেষ্টা করে। এতে পরিস্থিতি আরও উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। সরকার এই শান্তিপূর্ণ আন্দোলনে দমন-পীড়নের মাধ্যমে থামাতে গিয়ে সরকারই আরও প্রবল প্রতিরোধের মুখে পড়ে। ছাত্র-জনতার শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভ দমনে সরকারের সহিংস হস্তক্ষেপে প্রায় হাজারো নিরস্ত্র মানুষ প্রাণ হারান, আহত হন হাজার হাজার। মাত্র তিন সপ্তাহের মধ্যে আন্দোলন পরিণত হয় গণঅভ্যুত্থানে। পতন ঘটে টানা ১৫ বছর ক্ষমতায় থেকে দীর্ঘদিন নিপীড়ন নির্যাতন চালানো আওয়ামী লীগ সরকারের। ক্ষমতাসীন দলের সভানেত্রী শেখ হাসিনা দেশ ছেড়ে পালিয়ে ভারতে আশ্রয় নিতে বাধ্য হন।