‘আমি শহীদ হতে যাই’: মাকে শেষবারের মত ফোনে বলেছিলেন শাকিল

জুলাই আন্দোলনে নিহত মো. শাকিল
জুলাই আন্দোলনে নিহত মো. শাকিল  © টিডিসি সম্পাদিত

প্রায় প্রতিদিনই মোবাইলে ছেলের সঙ্গে কথা হতো। সেদিন শুক্রবারও জুমার নামাজ পড়ে শাকিল আমাকে ফোন করে, কেমন আছি জিজ্ঞেস করে। আমিও জিজ্ঞেস করি, বাবা, তুমি কেমন আছো? এরপর আমি বলি, বাবা, বাইরে যাইও না। কেউ ডাকলেও যেও না। কিন্তু ছেলে আমাকে বলে, ‘মা, আমি শহীদ হতে যাই।’ বড় ভাই রাকিবকেও একই কথা বলেছে।

কথাগুলো বলেন ভোলার লালমোহন উপজেলার বদরপুর ইউনিয়নের ৫ নম্বর ওয়ার্ডের কাজিরাবাদ এলাকার শহীদ মো. শাকিলের মা শাকিনুর বেগম। চোখে কান্না, কণ্ঠে দুঃখ আর বুকভরা অসহায়ত্ব নিয়েই তিনি বলছিলেন তার সর্বশেষ কথা—ছেলের সঙ্গে।

মাত্র ২০ বছর বয়সে ঢাকায় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনে পুলিশের গুলিতে প্রাণ দেন মো. শাকিল। পাঁচ ভাই ও এক বোনের মধ্যে তিনি ছিলেন সবার ছোট। পাঁচ বছর আগে তার বাবা মো. জালাল উদ্দিন প্যারালাইসিসে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করেন। এরপর বড় ভাইয়েরা ছোট ভাইকে মাদ্রাসায় ভর্তি করান ঢাকার কামরাঙ্গীরচর ও বছিলায়। সেখান থেকে ২০ পারা কুরআন শরিফ মুখস্থ করেন শাকিল। পরে পরিবারের অভাব দূর করতে পড়ালেখা ছেড়ে দেন।

২০২২ সালে শাকিল ঢাকার মোহাম্মদপুরের বছিলায় মেঝো ভাই মো. রাকিবের সঙ্গে একটি মিষ্টির কারখানায় কাজ শুরু করেন। মাসে ৮ হাজার টাকা বেতন পেতেন। দুই ভাই একসঙ্গেই কারখানায় কাজ করতেন ও মালিকের ভাড়া করা একটি রুমে থাকতেন।

২০২৪ সালের ১৯ জুলাই, শুক্রবার। দুপুর ১২টার দিকে কারখানার কাজ শেষ করে দুই ভাই একসঙ্গে গোসল করে জুমার নামাজ আদায় করেন। পরে খেয়ে রুমে বিশ্রাম নেন। বিকেল তিনটার দিকে শাকিল বলেন, বড় ভাই মিরাজের বাসায় যাবেন। সেটাই ছিল তার শেষ যাওয়া।

এর আগে বিকেলেই মা শাকিনুর বেগমের সঙ্গে শেষবারের মত ফোনে কথা হয় ছেলের। মা তাকে বারবার নিষেধ করেন বাইরে যেতে। শাকিল তখন বলে ওঠেন, ‘মা, আমি শহীদ হতে যাই।’ ভাই রাকিবও নিষেধ করেছিলেন, কিন্তু তাকেও শাকিল একই কথা বলেন।

সন্ধ্যার পর ওয়েস্ট ধানমন্ডি হাউজিং এলাকায় স্থানীয় একটি মসজিদে নামাজ পড়ে বের হন ভাই রাকিব। তখন একটি জটলা দেখে এগিয়ে যান। সেখানে রাস্তায় গুলিবিদ্ধ অবস্থায় পড়ে থাকতে দেখেন শাকিলসহ আরও কয়েকজনকে। তড়িঘড়ি করে কারখানার লোকজন নিয়ে আহতদের প্রথমে ধানমন্ডির একটি বেসরকারি হাসপাতালে এবং পরে উন্নত চিকিৎসার জন্য ঢাকা মেডিকেলে নিয়ে যাওয়া হয়। কিন্তু ততক্ষণে সব শেষ—চিকিৎসকরা শাকিলকে মৃত ঘোষণা করেন।

পরদিন শনিবার পরিবারের লোকজন মরদেহ নিয়ে ঢাকার রওনা দেন। রবিবার সকাল ১১টার দিকে গ্রামের বাড়িতে দাফন করা হয় শাকিলকে পারিবারিক কবরস্থানে।

শাকিলের মেঝো ভাই মো. রাকিব বলেন, ‘ছোট ভাইকে অনেক চেষ্টা করে মাদ্রাসায় ভর্তি করিয়েছিলাম। সে ২০ পারা হাফেজও হয়। কিন্তু অভাবের কারণে আর পড়া হয়নি। আমি তাকে আন্দোলনে যেতে বারণ করেছিলাম, কিন্তু সে বলে, ভাই, আমি শহীদ হতে যাই। এখন মনে হচ্ছে, সত্যিই সে শহীদ হয়েছে। আমি গর্বিত।’

শাকিলের মা শাকিনুর বেগম বলেন, ‘বাবা ৯ বছর প্যারালাইজড ছিলেন, ছয় বছর আগে মারা যান। তখন থেকেই আমি মানুষের বাড়িতে কাজ করে ছেলেমেয়েকে বড় করেছি। দুই বছর আগে রাকিবের সঙ্গে মিষ্টির দোকানে চাকরি নেয় শাকিল। গত কোরবানির ঈদের এক দিন আগে বাড়িতে এসেছিল। ঈদের পরে বাবার কবর জিয়ারত করে আবার ঢাকায় চলে যায়।’

মায়ের চোখ তখন আকাশের দিকে। কণ্ঠে একটিই আকুতি—‘আমার ছেলে মারা যাওয়ার পর জামায়াতে ইসলামি ও কিছু লোক সামান্য সহায়তা দিলেও সরকারিভাবে কোনো সাহায্য পাইনি। তবে আমার দাবি একটাই—ছেলের হত্যার বিচার যেন দেখি আমি মরার আগে। ডাইনী শেখ হাসিনার সর্বোচ্চ শাস্তি দেখে যেতে চাই।’

আজও শাকিলের স্মৃতি নিয়ে বেঁচে আছেন মা। কোরআন মুখস্থ করা সেই শিশুটি একদিন বলেছিল—‘মা, আমি শহীদ হতে যাই।’ মা ভেবেছিলেন, ছেলে হয়তো দুষ্টুমি করছে। কিন্তু তা ছিল এক সাহসী ঘোষণা। এবং তা-ই সত্যি হয়ে গেল।

প্রসঙ্গত, ২০২৪ সালের জুলাইয়ে কোটা সংস্কারের দাবিতে দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ও চাকরিপ্রত্যাশীরা ন্যায্য অধিকার আদায়ের দাবিতে আন্দোলনে নামেন। শুরুতে এই আন্দোলন ছিল শান্তিপূর্ণ, কিন্তু সরকার তা দমন-পীড়নের মাধ্যমে প্রতিহত করার চেষ্টা করে। এতে পরিস্থিতি আরও উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। সরকার এই শান্তিপূর্ণ আন্দোলনে দমন-পীড়নের মাধ্যমে আন্দোলন দমন করতে গিয়ে সরকারই আরও প্রবল প্রতিরোধের মুখে পড়ে। ছাত্র-জনতার শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভ দমনে সরকারের সহিংস হস্তক্ষেপে প্রায় হাজারো নিরস্ত্র মানুষ প্রাণ হারান, আহত হন হাজার হাজার। মাত্র তিন সপ্তাহের মধ্যে আন্দোলন পরিণত হয় গণঅভ্যুত্থানে। পতন ঘটে টানা ১৫ বছর ক্ষমতায় থেকে দীর্ঘদিন নিপিড়ীন নির্যাতন চালানো আওয়ামী লীগ সরকারের। ক্ষমতাসীন দলের সভানেত্রী শেখ হাছিনা দেশ ছেড়ে পালিয়ে ভারতে আশ্রয় নিতে বাধ্য হন।


সর্বশেষ সংবাদ