ব্যর্থতার গল্প কেউ শুনতে চায় না, সবাই চায় ব্যর্থতা জয়ের গল্প জানতে

ফয়সাল তানভীর
ফয়সাল তানভীর  © টিডিসি ফটো

মো. ফয়সাল তানভীর। ৩৮তম বিসিএসে সফলতার সঙ্গে উত্তীর্ণ হয়ে পুলিশ ক্যাডারে ১০ম স্থান অধিকার করেছেন। নাটোর সরকারী বালক উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এসএসসি, রাজশাহী নিউ গভ. ডিগ্রি কলেজ থেকে এইসএসসি এবং চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করেন তিনি। সম্প্রতি তার বিসিএস জয়, ভবিষ্যৎ স্বপ্ন ও সফলতার গল্প বলেছেন দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসকে। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন মো. আবদুর রহমান —

দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাস: আপনার ছোটবেলা কেমন কেটেছে?
ফয়সাল তানভীর: নাটোর জেলা শহরে ছোটবেলা কেটেছে আমার। কর্মজীবী বাবা মায়ের সন্তান হিসেবে আমি ছোটবেলা থেকেই একা বড় হয়েছি। সেক্ষেত্রে আমার গার্ডিয়ান হিসেবে পাশে পেয়েছি আমার দেড় বছরের বড় আপাকে।

স্কুলে যাওয়া, পড়াশোনা সব কিছুতেই আমাদের আত্মনির্ভরশীল হতে হয়েছে তখন থেকেই। আর বাবা মা সবসময় মাথার ওপর ছিলেন ছায়া হিসেবে। বর্তমানে আমি ৩৮তম এবং আমার বড় আপা ৩৯তম বিসিএসের মাধ্যমে দুজনেই বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিসে প্রতিনিধিত্ব করছি। যা আমার বাবা মায়ের কাছে অনেক গর্বের বিষয়।

দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাস: পড়াশেনায় কোনো প্রতিবন্ধকতা ছিল কি?
ফয়সাল তানভীর: প্রতিবন্ধকতার মধ্যেই বড় হয়েছি। আর এই ছোট-বড় প্রতিবন্ধকতাগুলোই আমাকে আজকের অবস্থানে আসতে সাহায্য করেছে। মাধ্যমিকে বিজ্ঞান বিভাগ থেকে জিপিএ-৫ প্রাপ্তির পর উচ্চ মাধ্যমিকে আমি বড় ধাক্কা খাই; মাত্র জিপিএ ৩.৮০ নিয়ে পাশ করি।

অতঃপর সিদ্ধান্ত নেই বিজ্ঞান বিভাগ ছেড়ে মানবিকে ভর্তি হবার। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগে ভর্তির হবার পর নতুন করে নিজেকে মেলে ধরার সুযোগ পাই। কিন্তু কিছুদিন পর সেখানেও প্রতিকূল পরিস্থিতির মুখে পড়তে হয়। সেশনজটের কবলে পড়ে ছাত্রজীবন থেকে ২-৩ বছর নষ্ট হয়। তারপরও আমি আমার ক্যারিয়ার নিয়েই ফোকাসড ছিলাম, মনে হত একদিন না একদিন তো আমার গ্রাজুয়েশন শেষ হবে। তখন কেউ আর আটকাতে পারবে না। সত্যিকার অর্থেও সেটাই হয়েছে।

দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাস: বিসিএসের স্বপ্ন দেখেছিলেন কখন থেকে?
ফয়সাল তানভীর: বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকতা অথবা বিসিএস ক্যাডার হওয়া এ দুটো স্বপ্ন অনার্সের শুরু থেকেই ছিল। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে পিএসসির নিয়োগে স্বচ্ছতা এবং ধারাবাহিকতার দৃষ্টান্ত থেকে মনে আরও সাহস পাই যে বিসিএস নিয়ে শ্রম দিলে ভালো কিছু প্রাপ্তির সম্ভাবনা রয়েছে। 

দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাস: বিসিএস যাত্রার গল্প শুনতে চাই—
ফয়সাল তানভীর: বিসিএস দেবার জন্য যখন মনস্থির করি তখন আমি শুরুতেই ভেবেছিলাম যে খুব কমপ্যাক্ট একটা প্রিপারেশন নিতে হবে। মানে অল্পসময়ে অধিক পরিশ্রমের মাধ্যমে যাতে সাফল্যের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছাতে পারি। আগেই বলেছি যে সেশনজটের কারণে আমার ২ বছর তখন নষ্ট হয়েছে অলরেডি। তাই আমি প্রথম বিসিএস কেই টার্গেট করি।

পড়ুন: অনার্স পাসের আগেই বিসিএস আবেদন, হলেন এএসপি

আমার চিন্তা ছিল, আমি মোটামুটি তিনবছর বাইরের জগত থেকে বিচ্ছিন্ন থেকে চেয়ার-টেবিলে বসে দিয়ে পড়াশোনা করবো। বাঁকিটা ভাগ্যই নির্ধারণ করবে। ২০১৭, ১৮, ১৯ এই তিনবছর বন্ধুদের থেকে আড্ডা-গল্প থেকে দূরে ছিলাম। আলহামদুলিল্লাহ ২০২০ সালে ৩৮তম বিসিএসের ফলাফল প্রকাশিত হবার পর আমি বুঝতে পারি যে, আমার কৌশলটা কাজে লেগেছে।

দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাস: বিসিএসের প্রস্তুতি কিভাবে নিতে হয়?
ফয়সাল তানভীর: যারা বিসিএস নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করেন তারা মোটামুটি সবাই জানে যে এর প্রস্তুতি কিভাবে নিতে হয়। প্রিলিমিনারি-রিটেন-ভাইভা মোট ১৫০০ মার্কের পরীক্ষার পর সর্বোচ্চ নম্বর প্রাপ্তরাই সাফল্যের মুখ দেখে। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে এত এত পরীক্ষার্থীর মাঝে কেন কেউ সফল হয় কেনইবা ব্যর্থ হয়?

নিজের অভিজ্ঞতার আলোকে আমি দেখেছি যে ছেলেটা প্রিলিমিনারি-রিটেনে অকৃতকার্য হচ্ছে আর যে ভাইভার ফলাফলের পরেও সাফল্য লাভ করছে তারা সবাই মোটামুটি একই বই, একই সাজেশন্স অনুসরণ করেন। কিন্ত দুজনের মাঝে পার্থক্যটা হল ‘ডেডিকেশন’ এবং ‘স্ট্র্যাটেজি’র বেলায়।

বিসিএস প্রস্তুতির জন্য তিনটি জিনিস আবশ্যক। গোছানো স্ট্র্যাটেজি বা কর্মপদ্ধতি অনুসরণ, অসম্ভব রকমের ডেডিকেশন, কোন পর্যায়েই মানসিকভাবে পিছিয়ে না পড়া। এ তিনটি বিষয় শুরুতেই মাথায় রেখে ধৈর্য সহকারে পড়াশোনা করতে হবে, আশা করি সাফল্য অবশ্যই ধরা দেবে।

দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাস: যাদের স্বপ্ন বিসিএস, তাদের সম্পর্কে কী বলবেন?
ফয়সাল তানভীর: স্বপ্ন যাদের বিসিএস তাদের জন্য বলবো যে স্বপ্ন দেখার পাশাপাশি প্রয়োজন সেটা বাস্তবায়নের জন্য কঠোর পরিশ্রমের। অনেককেই দেখেছি ম্যাজিস্ট্রেট কিংবা এএসপি হবার ইচ্ছা পোষণ করতে, কিন্তু পড়ার টেবিলে যথেষ্ট সময় তারা দেন না; নানা অজুহাত দেখান। এটা আসলে নিজের সাথেই প্রতারণা।

জীবনে সমস্যা থাকবে, বাধাবিপত্তি থাকবে। কিন্তু সেটাকে নিজের ব্যর্থতার জন্য অজুহাত হিসেবে ব্যবহার করা চলবে না। ব্যর্থতার গল্প কেউ শুনতে চায়না, সবাই চায় আপনি কিভাবে ব্যর্থতাকে জয় করলেন সেই গল্প শুনতে। তাই নিজের গল্পের শ্রোতাদের খুঁজতে হলেও আপনাকে সফল হতে হবে।

এছাড়া যে বিষয়গুলোর প্রতি বিশেষ দৃষ্টি রাখতে হবে সেগুলো হলো- বিগত বছরের প্রশ্ন সমাধান করা, ইংরেজি, গণিত ও মানসিক দক্ষতার জন্য বেশি বেশি অনুশীলন করা, যে বিষয়ে বেশি দুর্বলতা আছে সে বিষয়ে বেশি সময় দেয়া, যেহেতু প্রিলিতে নেগেটিভ মার্কিং আছে তাই বৃত্ত ভরাটের ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ সতর্কতা অবলম্বন করা ইত্যাদি।

দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাস: কারও কাছ থেকে অনুপ্রেরণা পেয়েছেন কি?
ফয়সাল তানভীর: আমি বাইরের কারো থেকে অনুপ্রেরণা খুঁজে নেওয়ার পক্ষপাতী নই। বরং নিজেই নিজের অনুপ্রেরণা হবার চেষ্টা করি সবসময়। আজ থেকে দশ বছর পর নিজেকে কোথায় দেখতে চাই, কোন অফিসের ঊর্ধ্বতন পদে নাকি অধস্তন পদে, এ ধরনের চিন্তা থেকে নিজেই নিজেকে অনুপ্রাণিত করার চেষ্টা করেছি সবসময়।

দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাস: কেন পুলিশ ক্যাডার বেছে নিয়েছিলেন এবং কাজের চ্যালেঞ্জগুলো শুনতে চাই-
ফয়সাল তানভীর: পুলিশ ক্যাডার বেছে নেওয়ার প্রধান কারণটা হল ইউনিফর্ম সার্ভিসের প্রতি ভালোবাসা। বাংলাদেশ পুলিশ বাহিনীর নীল ইউনিফর্ম শুরু থেকেই আমাকে আকৃষ্ট করেছে। এই অনুভূতিটা আমি প্রকাশ করি ‘Love for the Blue’ শিরোনামে।

এই ভালোবাসা থেকেই পুলিশের মত এমন চ্যালেঞ্জিং একটা প্রফেশনকে বেছে নিয়েছি। একজন পুলিশ সদস্যেকে যেকোনো সময় যেকোনো কাজের জন্য প্রস্তুত থাকতে হয়। টাইম ম্যানেজমেন্ট এবং স্ট্রেস ম্যানেজমেন্ট দু’টাই বোধ হয় পুলিশ পেশার প্রধান চ্যালেঞ্জ। আর জীবনের ঝুঁকি নিয়ে অনেক সময় অনেক কাজ করতে হয়। এটি সিভিল সার্ভিসের অন্য চাকরির ক্ষেত্রে নেই। তাই অবশ্যই এ চাকরি অন্যান্য চাকরির তুলনায় ঝুঁকিপূর্ণ।

কিন্তু তারপরও এই প্রফেশনই আপনাকে দেবে বিপদে মানুষের পাশে দাঁড়ানো এবং দেশ মাতৃকার প্রয়োজনে নিজেকে নিয়োজিত করার সুবর্ণ সুযোগ। এসব ভাবনা থেকেই আসলে পুলিশ ক্যাডার আমার প্রথম পছন্দ ছিল।

দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাস: একজন পুলিশ কর্মকর্তা হিসেবে আপনার ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা কী?
ফয়সাল তানভীর: ভবিষ্যৎ নিয়ে ভাবতে আমার ভালো লাগে। আগামী দুবছরে পুলিশের ব্যাসিক ট্রেইনিং শেষ করে মূল সার্ভিসে যোগদান করতে হবে। এরপর ইচ্ছা আছে নর্থ আমেরিকান কোন দেশ থেকে উচ্চশিক্ষা অর্জনের।

কর্মক্ষেত্রে বাংলাদেশ পুলিশের বিভিন্ন বিশেষায়িত ইউনিট যেমন RAB, SWAT ইত্যাদিতে কাজ করতে চাই। সর্বোপরি আগামী ৩০ বছর সততার সাথে দেশের সাধারণ মানুষের কল্যাণে নিজেকে নিয়োজিত করতে চাই। সাধারণ মানুষের কাছে যেন পুলিশ হিসেবে আস্থার প্রতীক হয়ে দাঁড়াতে পারি, এমন কাজ করতে চাই।

দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাস: সাম্প্রতিক করোনা দুর্যোগে আপনার ভূমিকা কী?
ফয়সাল তানভীর: গতবছর করোনার প্রকোপ শুরুর পর নিজ জেলাতেই ছিলাম, সেখানে বিচ্ছিন্নভাবে কিছু প্রান্তিক মানুষকে সাহায্য করেছি। অতঃপর ৩৮তম বিসিএস এর ফলাফল প্রকাশের পর পুরো ব্যাচের পক্ষ হতে শীতবস্ত্র বিতরণ করেছি।

কিন্ত আফসোস এই যে ট্রেইনিং শেষ না হবার কারণে এখনো মাঠ পর্যায়ের প্যান্ডেমিক পুলিশিং কার্যক্রমে অংশগ্রহণ করতে পারিনি। আশা করি অতি দ্রুতই ট্রেইনিং শেষে মানুষের পাশে গিয়ে দাঁড়াতে সক্ষম হবো।

দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাস: আপনার মূল্যবান সময় দেওয়ার জন্য ধন্যবাদ।
ফয়সাল তানভীর: দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসের জন্য শুভ কামনা রইল। ধন্যবাদ।


সর্বশেষ সংবাদ

×
  • Application Deadline
  • December 17, 2025
  • Admission Test
  • December 19, 2025
APPLY
NOW!
GRADUATE ADMISSION
SPRING 2026!
NORTH SOUTH UNIVERSITY
Center of Excellence