জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে অনেক মাফিয়া রয়েছে, যারা সংস্কারমূলক কাজকে বাধাগ্রস্ত করতে চায়

অধ্যাপক ড. এ এস এম আমানুল্লাহ
অধ্যাপক ড. এ এস এম আমানুল্লাহ  © টিডিসি সম্পাদিত

২০২৪ সালের ঐতিহাসিক ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের হয়।  এরপর ওই বছরের ২৭ আগস্ট জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের নতুন উপাচার্য হিসেবে নিয়োগ পান বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. এ এস এম আমানুল্লাহ। দায়িত্ব নিয়ে তিনি যখন সংস্কারে হাত দেন, তখনই আসছে প্রভাবশালী মহলের নানা বাধা। তার ভাষ্য, ‘আমরা হুমকির মুখে আছি’। তবুও তিনি সংস্কার চালিয়ে যাবেন বলে জানান।

আগামী সপ্তাহে অধ্যাপক ড. এ এস এম আমানুল্লাহর উপাচার্য হিসেবে দায়িত্ব পালনের ১০ মাস পূর্ণ হবে। এ উপলক্ষ্যে সম্প্রতি তিনি দ্য ডেইলি ক্যাম্পাসকে একান্ত সাক্ষাৎকার দেন। এতে তিনি দায়িত্ব পালনের অভিজ্ঞতা, প্রত্যাশা-প্রাপ্তি, সংস্কার-উদ্যোগ ইত্যাদি বিষয়ে খোলামেলা কথা বলেন। পাশাপাশি তুলে ধরেন তার ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা। বিশ্ববিদ্যালয়টির ধানমন্ডি নগর কার্যালয়ে দেয়া সাক্ষাৎকারের দ্বিতীয় ও শেষ পর্ব প্রকাশিত হলো। ইন্টার্ন নিশাত তাসনিম জেসিকাকে সঙ্গে নিয়ে সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন দ্য ডেইলি ক্যাম্পাসের হেড অব নিউজ ইরফান এইচ সায়েম

এক সময় জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত কলেজগুলোর র‍্যাংকিং প্রকাশ করা হতো। মাঝখানে বেশ কয়েক বছর সেটি প্রকাশিত হয়নি। আগামীতে প্রকাশ করার উদ্যোগ নেবেন কিনা?
অধ্যাপক ড. এ এস এম আমানুল্লাহ: জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত কলেজগুলোকে র‍্যাংকিংয়ের আওতায় আনার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। ২০২২-২৩ সালের র‍্যাংকিং আমরা সম্পন্ন করেছি। তবে অবাক করার মতোভাবে লালমনিরহাটের একটি কলেজ প্রথম স্থান অর্জন করেছে। বর্তমানে আমরা ২০২৪-২৫ সালের র‍্যাংকিং নিয়েও কাজ করছি।

জুলাই গণঅভ্যুত্থানে শহীদের নিয়ে কী করছে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়?
অধ্যাপক ড. এ এস এম আমানুল্লাহ: আমরা শহীদ মুগ্ধ ও আবু সাঈদের নামে একটি স্কলারশিপ চালু করতে যাচ্ছি। যাদের এই স্কলারশিপ দেওয়া হবে তাদের তালিকাও প্রস্তুত। আমরা কয়েক হাজার শিক্ষার্থীকে কয়েক কোটি টাকার স্কলারশিপ দিচ্ছি।

এছাড়া, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের মধ্যে যারা জুলাই আন্দোলনে নিহত হয়েছেন, তাদের পরিবারের জন্য ৮ লাখ টাকা করে অর্থ সহায়তা প্রদান করা হয়েছে। এরমধ্যে জুলাই স্মৃতি ফাউন্ডেশনের ৫ লাখ আর বাকিটা জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ফান্ড থেকে দেওয়া হয়েছে।

দায়িত্ব নেওয়ার পর সংস্কারমূলক কাজকে বাধাগ্রস্ত করতে কিংবা অন্যকোনো কাজ করতে গিয়ে হুমকি পেয়েছেন কিনা?
অধ্যাপক ড. এ এস এম আমানুল্লাহ: এই খাতে অনেক প্রভাবশালী মহলের দখলদারিত্ব রয়েছে। একধরনের ‘মাফিয়া’ আছে, যারা আমাদের সংস্কারমূলক কাজকে বাধাগ্রস্ত করতে চায়। আমরা হুমকির মুখে আছি। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনায় আমাদের নিজস্ব কোনো পরিকল্পনা আগে ছিল না। এখন আমরা যতদিন দায়িত্বে আছি, প্রতিটি খাতে সংস্কারের চেষ্টা করছি এবং তার ইতিবাচক ফলও পাচ্ছি। ভবিষ্যতে হয়তো আমাদের অসম্পূর্ণ কাজ কেউ না কেউ সম্পন্ন করবে।

জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত কলেজে পড়ানো পাঠ্যবইয়ের সিলেবাস অনেক পুরানো এবং যুগোপযোগী নয়। সেটি সংস্কারে উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে?
অধ্যাপক ড. এ এস এম আমানুল্লাহ: জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান সিলেবাস অনেক পুরানো এবং যুগোপযোগী নয়। এই সিলেবাস মূলত ৬০-৭০ দশকে তৈরি, যা বর্তমান সময়ের চাহিদা ও প্রযুক্তিনির্ভর সমাজের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। আজ আমরা চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের যুগে প্রবেশ করেছি—এখানে এই ধরনের সিলেবাস দিয়ে শিক্ষার্থীদের যথাযথভাবে প্রস্তুত করা সম্ভব নয়। এমনকি এটি প্রথম শিল্পবিপ্লবের কাজ চালাতেও অকার্যকর।

এই প্রেক্ষাপটে, আমরা সিলেবাস সংস্কারে হাত দিয়েছি। দেশের অনার্স ও মাস্টার্স পর্যায়ের প্রায় ৩০-৩৫টি বিষয় অন্তর্ভুক্ত করে একটি পূর্ণাঙ্গ রিফর্মের লক্ষ্যে ইতোমধ্যেই কমিটি গঠন করা হয়েছে, যেখানে অভিজ্ঞ শিক্ষাবিদ ও গবেষকরা অক্লান্ত পরিশ্রম করে কাজ করছেন। কিছু বিষয়ে আগামী সেমিস্টার থেকেই নতুন সিলেবাস বাস্তবায়ন শুরু হবে, আর বাকিগুলো পর্যায়ক্রমে চালু করা হবে।

সম্প্রতি এক গবেষণায় দেখা গেছে, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বের হওয়া প্রায় ৩০ ভাগ গ্র্যাজুয়েট চাকরি পান না। তাদের কর্মসংস্থানে কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হবে কিনা?
অধ্যাপক ড. এ এস এম আমানুল্লাহ: আমরা দেখছি, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রায় ৩০% শিক্ষার্থীই চাকরি পায় না। বাকি ৭০% এর মধ্যে সরকারি চাকরি পায় খুবই কম, মাত্র ২০% বা তারও কম। অধিকাংশ শিক্ষার্থী প্রাইভেট বা ইনফরমাল সেক্টরে কাজ করে, যেখানে বেতন ও সুযোগ সীমিত। অনেকে আবার বিদেশে চলে যাচ্ছে—কিন্তু স্কিল ছাড়াই।

এই বাস্তবতায় আমরা সিদ্ধান্ত নিয়েছি, অনার্স ও মাস্টার্সের ১৪০ ক্রেডিটের মধ্যে ২০ ক্রেডিট বরাদ্দ করা হবে টেকনিক্যাল কোর্সের জন্য। বিষয়ভিত্তিক পড়াশোনার পাশাপাশি শিক্ষার্থীরা ICT, আউটসোর্সিং, কুকিং, গিগ ইকোনমি, সফট স্কিলস ইত্যাদি বিষয়ে প্রশিক্ষণ নিতে পারবে। এতে তারা যদি মূল বিষয়ের চাকরি না-ও পায়, টেকনিক্যাল সার্টিফিকেট দিয়ে বিকল্প কর্মসংস্থানে যুক্ত হতে পারবে।

বিশেষ করে মেয়েদের জন্য আমরা পাঁচ হাজার ছাত্রীকে আউটসোর্সিং প্রশিক্ষণ দেওয়ার পরিকল্পনা গ্রহণ করেছি। কারণ, আন্তর্জাতিক বাজারে বাংলাদেশের অবস্থান ইতোমধ্যেই দ্বিতীয়, যদিও দক্ষতার অভাবে এই সুযোগ পুরোপুরি কাজে লাগানো যাচ্ছে না। ২০২৬ সালের পর বিদেশে নারীকর্মী পাঠাতে হলে স্কিল সার্টিফিকেট বাধ্যতামূলক হবে—তাই আমরা এখন থেকেই প্রস্তুতি নিচ্ছি।

এই উদ্যোগকে আরও কার্যকর করতে নোবেল বিজয়ী অধ্যাপক ড. ইউনুস স্যারের সাথে বৈঠক হয়েছে এবং তাঁর নেতৃত্বে একটি চুক্তিরও প্রস্তুতি চলছে। পাশাপাশি, শিক্ষার্থীদের স্কিল ডেভেলপমেন্টের জন্য সংক্ষিপ্ত মেয়াদি (৩-৪ মাস) ক্রেডিট ভিত্তিক কোর্স চালু করা হবে, যাদের পড়ালেখা মাঝপথে থেমে গেছে, তাদের জন্য এটি বিশেষ সহায়ক হবে।

তৃতীয়ত, আমরা ইতোমধ্যেই আমেরিকান প্রতিষ্ঠান BYLC-এর সহযোগিতায় লালমাটিয়া কলেজে একটি ক্যারিয়ার ক্লাব চালু করেছি। এটি শিক্ষার্থীদের সিভি তৈরি, চাকরির আবেদন, বিদেশে উচ্চশিক্ষার প্রস্তুতি ইত্যাদি বিষয়ে সহায়তা করবে। আমরা এই মডেলটি দেশের ৬৪ জেলায় ছড়িয়ে দিতে চাই।

এর পাশাপাশি, সরকারের a2i (এটুআই) প্রোগ্রামের সাথে আমাদের চুক্তি হয়েছে। এদের অনলাইন লার্নিং প্ল্যাটফর্মের মাধ্যমে আমরা কলেজগুলোতে স্কিল ট্রেইনিংয়ের ঘাটতি পূরণ করতে পারব।

উচ্চশিক্ষাকে যুগোপযোগী করে গড়ে তুলতে কোনো সংস্কার হচ্ছে কিনা?
অধ্যাপক ড. এ এস এম আমানুল্লাহ: জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় বর্তমানে একটি ব্যাপক সংস্কার প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে, যার মূল লক্ষ্য হচ্ছে উচ্চশিক্ষাকে যুগোপযোগী করে গড়ে তোলা এবং শিক্ষার্থীদের কর্মদক্ষতা বাড়ানো।

আমরা আনন্দের সঙ্গে জানাচ্ছি, ন্যাশনাল স্কিল ডেভেলপমেন্ট অথরিটি (NSDA) আমাদের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হয়েছে। তারা জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য বিভিন্ন প্রোগ্রাম নিয়ে কাজ শুরু করতে যাচ্ছে, এবং আগামী মাসগুলোতে এসব কর্মসূচি বাস্তবায়নের পরিকল্পনা রয়েছে।

আমাদের মূল উদ্দেশ্য হলো—শিক্ষার্থীদের কর্মসংস্থানযোগ্য স্কিল যেমন কমিউনিকেশন স্কিল, আইসিটি জ্ঞান, ইংরেজি ভাষা দক্ষতা ইত্যাদিতে পারদর্শী করে তোলা। এজন্য আইসিটি ও ইংরেজিকে বাধ্যতামূলক করা হয়েছে।

কলেজগুলোতে শিক্ষক সংকটে পাঠদান ব্যহত, তাদের রাজনীতি নিয়ে কী বার্তা থাকবে?
অধ্যাপক ড. এ এস এম আমানুল্লাহ: জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা সারাদিন উদারতার সঙ্গে অক্লান্ত পরিশ্রম করেন। তাদের জন্য প্রয়োজনীয় সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করা উচিত, যা এখনো আমরা পুরোপুরি দিতে পারিনি। তবে তাদের এই পরিশ্রমের প্রতিফলন যদি শিক্ষার গুণগত মানে দেখা না যায়, তাহলে সে বিষয়ে প্রশ্ন উঠবে—এবং সেই প্রশ্নের যথাযথ উত্তর দিতেই আমরা কাজ করে যাচ্ছি।

কলেজগুলোতে অনেক শিক্ষক ঘাটতি রয়েছে। বিশেষ করে অনার্স ও মাস্টার্স পর্যায়ে এমপিও নেই—এই বিষয়টি নিয়ে আমরা সরকারের সঙ্গে আলোচনা করছি। আসলে বলতে গেলে বাংলাদেশে পড়াশোনার মান খুব দুর্বল, কারণ রাষ্ট্রীয়ভাবে শিক্ষা খাতে জিডিপির মাত্র ২ শতাংশের নিচেই বরাদ্দ থাকে। যে পরিমাণ অর্থ আসে, সেটাও যথাযথভাবে ব্যবহার হয় না।

তাই আমরা শিক্ষকদের প্রতি স্পষ্ট বার্তা দিয়েছি—রাজনীতি করতে হলে কলেজের বাইরে গিয়ে করুন। শিক্ষার্থীদের মধ্যেও রাজনীতি থাকবে, তবে সেটি তাদের অধিকার সংরক্ষণে সহায়ক হবে কিনা, সেটাই বিবেচ্য হবে।

কলেজগুলো মনিটরিংয়ের আওতার আনা হবে কিনা? অনেক সময় বাজেট বরাদ্দের অপ্রতুলতা শোনা যায়। বিষয়টি নিয়ে কোনো উদ্যোগ নেবেন?
অধ্যাপক ড. এ এস এম আমানুল্লাহ: আমাদের সংবিধিতে রয়েছে—জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় কলেজগুলো মনিটরিং করবে। কিন্তু গত ৩০ বছরে এই কলেজ মনিটরিং কার্যক্রম কাঙ্ক্ষিতভাবে সফল হয়নি। আমরা সেই ব্যর্থতা থেকে শিক্ষা নিয়ে KPI (Key Performance Indicator) নামক একটি সফটওয়্যার তৈরি করেছি, যার মাধ্যমে দেশের সকল কলেজকে প্রতিদিন মনিটরিং করা যাবে এবং প্রয়োজনীয় তথ্য সংগ্রহ করা সম্ভব হবে।

অতীতে বিভিন্ন কলেজে যে বিশাল বাজেট বরাদ্দ ছিল, তার একটি বড় অংশ রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ব্যয় হয়েছে—যা শিক্ষার্থী ও শিক্ষকের প্রকৃত কল্যাণে ব্যয় হলে ফল আরও ইতিবাচক হতে পারত। এখন অনেক কলেজ ফান্ডে বাজেট সংকট দেখা দিচ্ছে।

সংবিধি অনুযায়ী অডিট করা আমাদের দায়িত্ব হলেও, বাস্তবে সেটা কখনোই করা হয়নি। কোন খাতে কত টাকা খরচ হচ্ছে, কোথায় অপচয় হচ্ছে—এসব বিষয়ে তথ্য ও বিশ্লেষণ না থাকার কারণে আমরা দীর্ঘদিন পিছিয়ে ছিলাম। এখন থেকে আমরা অডিট কার্যক্রম শুরু করছি এবং খুব দ্রুত সেটি বাস্তবায়ন করা হবে।


সর্বশেষ সংবাদ