দেশেই আন্তর্জাতিক বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সুযোগ পাচ্ছেন আইইউটি শিক্ষার্থীরা

অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ রফিকুল ইসলাম
অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ রফিকুল ইসলাম  © টিডিসি ফটো

মোহাম্মদ রফিকুল ইসলাম একজন শিক্ষাবিদ। তিনি বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) নেভাল আর্কিটেকচার ও মেরিন ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের অধ্যাপক এবং গাজীপুরে অবস্থিত ইসলামিক ইউনিভার্সিটি অব টেকনোলজির (আইইউটি) উপাচার্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। সম্প্রতি তিনি তার ব্যক্তিগত জীবন, বিশ্ববিদ্যালয় সম্পর্কে ভাবন ও সমসাময়িক বিষয়ে খোলামেলা কথা বলেছেন। তার কথাগুলো শুনেছেন দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসের তাওফিকুল ইসলাম হিমেল

দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাস: আপনার শৈশব ও বেড়ে ওঠা নিয়ে জানতে চাই
ড. মোহাম্মদ রফিকুল ইসলাম: আমার জন্ম সিরাজগঞ্জের প্রত্যন্ত গ্রামে। আমার বাবা বগুড়াতে রেভিনিউতে চাকরি করতেন, সেই সুবাদে আমার পড়াশোনা বগুড়া কেন্দ্রীক। ছোটবেলায় আমি ঢাকায় আমার বড় আপার বাসায় ছিলাম। ষষ্ঠ শ্রেনী পর্যন্ত সেখানে থেকে পড়াশোনা করি মিরপুরের শহীদ আবু তালেব শিক্ষা নিকেতনে।

তারপর ১৯৮০ সালে যখন বগুড়া ক্যান্টনমেন্ট পাবলিক স্কুল যাত্রা শুরু করে তখন আমার বাবা বললেন এই স্কুলের প্রিন্সিপাল আমার শিক্ষক। উনি খুবিই একজন ভালো শিক্ষক, তুমি এখানে চলে আস। আমি সেখানে ফেব্রুয়ারিতে যাই এবং ভর্তি পরীক্ষা দিয়ে ৭ম শ্রেনীতে ভর্তি হই।

আমার রোল ছিলো ৪২। সপ্তম শ্রেনীর ফাইনাল পরীক্ষায় আমি ১ম হয়েছিলাম। আলহামদুলিল্লাহ তার পর আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। সেখান থেকেই মাধ্যমিকে স্টার মার্কসসহ ৬টি বিষয়ে লেটার নিয়ে পাস করলাম। তারপর বগুড়া ক্যান্টনমেন্ট কলেজ থেকে ১ম ব্যাচে স্টার মার্কসসহ বেশ কয়েকটি বিষয়ে লেটার নিয়ে উচ্চমাধ্যমিক পাশ করলাম।

দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাস: আপনার পরিবারে কে কে আছেন?
ড. মোহাম্মদ রফিকুল ইসলাম: আমার ছোট পরিবার। আমার বাবা মারা গেছেন। মা বিভিন্ন সময় বিভিন্ন জায়গায় থাকতে পছন্দ করেন। উনি ঢাকাতে আমাদের ভাই-বোনদের বাসা এবং আমার বাসায় থাকেন, আবার গ্রামের বাড়িতেও থাকেন। ওনার বয়স ৮৩ চলছে এখন। আমার পরিবারে আমার সহধর্মিণী, এক ছেলে ও এক মেয়ে আছে। মেয়ে এমআইএসটিতে বায়োমেডিক্যাল ইঞ্জিয়ারিংয়ের তৃতীয় বর্ষে পড়ালেখা করছে। আর ছেলে এ বছর ইঞ্জিনিয়ারিং ইউনিভার্সিটি  স্কুল এন্ড কলেজ থেকে মাধ্যমিক পরীক্ষা দিচ্ছে। 

দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাস: আপনার বিশ্ববিদ্যালয় জীবন নিয়ে জানতে চাই
ড. মোহাম্মদ রফিকুল ইসলাম: ১৯৮৬ সালে বুয়েটে নেভাল আর্কিটেকচার ও মেরিন ইঞ্জিনিয়ারিং-এ ভর্তির পর সেশনজটের কারণে ক্লাস শুরু হয় প্রায় ২ বছর  পরে। তাই আমি একটা সময় বিদেশ চলে যেতে চেয়েছিলাম। তবে আমার বাবা চাননি আমি দেশের বাইরে যাই। তাই আমি বুয়েটেই পড়াশোনা করি। বুয়েটে আমাদের ডিপার্টমেন্টটি অনেক ছোট ছিলো, ভালো ল্যাবও ছিলো না। তাই মন খারাপ থাকত। তবে যখন রেজাল্ট ভালো করতে শুরু করলাম তখন আবার মন ভালো হতে শুরু করল যে, বুয়েটের শিক্ষক হব ইনশাল্লাহ। আলহামদুলিল্লাহ একটা সময় হয়েই গেলাম।

দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাস: চলার পথে কেমন প্রতিবন্ধকতা পেয়েছেন?
ড. মোহাম্মদ রফিকুল ইসলাম: প্রতিটি মানুষের জীবনেই চলার পথে প্রতিবন্ধকতা আসতে পারে। সেজন্যই ইংরেজীতে একটি প্রবাদ আছে- 'Failure is the pillar of success'.

আমার জীবনেও অনেক প্রতিবন্ধকতা ছিলো। আমি একই সময়ে পিএইচডির জন্য স্কলারশিপ পেয়েছিলাম তিনটি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। তখন আমি বুয়েটে লেকচারার ছিলাম। আমার মাস্টার্স ছিল, সাড়ে তিন বছরের মত চাকরির অভিজ্ঞতাও ছিল তবে ডিপার্টমেন্টের কিছু প্রতিবন্ধরতার জন্য প্রমোশনটা হয়নি।

তখন আমাকে লেকচারার অবস্থাতেই বিদেশে যেতে হয়েছিল। আমার ইচ্ছে ছিল বুয়েটে আর ফিরব না। আমি বিদেশে ভালো চাকরির অফারও পেয়েছিলাম। তবে আমার পরিবারের ইচ্ছায় আমাকে ফিরতে হয়েছে। বিশেষ করে আমার সহধর্মিণীর ইচ্ছায়। এরকম আরো অনেক প্রতিবন্ধকতা এসেছে জীবন চলার পথে।

দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাস: অনুপ্রেরণা পেয়েছেন কাদের কাছ থেকে?
ড. মোহাম্মদ রফিকুল ইসলাম: অনেকের কাছে থেকেই অনুপ্রেরণা পেয়েছি।  আমাদের স্কুলের ভাইস প্রিন্সিপাল আব্দুর রশিদ স্যার তিনি অনেক কঠোর ছিলেন। তিনি কঠোর না হলে আমি হয়ত এতদূর আসতে পারতাম না। তিনি সবসময় আমাদের বাস্তব জীবন সম্পর্কে ধারনা এবং ভবিষ্যতের জন্য প্রস্তুত হতে বলতেন। তাছাড়া সায়েদুল ইসলাম স্যার, তাহমিনা ম্যাডাম, রেজাউল করিম স্যার, সাবেদ আলী স্যার, আক্কাস আলী স্যারের কথা বেশ মনে পড়ে।

কলেজের কথা বললে তোফাজ্জল স্যার, মহসিন স্যার, হান্নান স্যার, রেজাউল করিম স্যার এর কথা সারাটা জীবন মনে থাকবে ইনশাল্লাহ। আর বিশ্ববিদ্যালয়ের জীবন এর কথা বললে, দীপক কান্তি স্যার, প্রয়াত মিজান স্যার, এম এইচ খান স্যার, সাদিকুল বারী স্যার এবং ইন্ডাস্ট্রি  থেকে ড. আব্দুল্লাহ বারী স্যারদের অবদান আমার জীবনের আশীর্বাদ।

দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাস: শিক্ষকতায় আপনার বেশ অভিজ্ঞতা রয়েছে। শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের মধ্যে সম্পর্ক কেমন হওয়া উচিৎ?
ড. মোহাম্মদ রফিকুল ইসলাম: ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্ক হবে বন্ধুর মত। যেনো শিক্ষার্থী নির্ভয়ে একজন শিক্ষকের সঙ্গে কথা বলতে পারেন। তখনই একজন শিক্ষার্থী একজন শিক্ষকের কাছ থেকে কিছু শিখিতে পারবে। তবে তারা যেন ভুলে না যায় যে তারা ছাত্র-শিক্ষক এবং এমন হয় না যেন বন্ধুত্ব একজন ব্যাচমেইটের সঙ্গে রয়েছে।

আরও পড়ুন: ‘বাংলাদেশিদের বেশি মনোযোগ টাকা আয়ে, নিজের দিকে নয়’

দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাস: আইইউটিতে উপাচার্য হিসেবে যোগ দেয়ার গল্পটা সংক্ষেপে জানতে চাই
ড. মোহাম্মদ রফিকুল ইসলাম: আমি ২০০২ থেকে আইইউটিতে পার্টটাইম শিক্ষক হিসেবে ছিলাম। মাঝের সময় ২০০৭ সালে মালেশিয়ার ইউনিভার্সিটি টেকনোলোজি মালেশিয়াতে শিক্ষক ছিলাম। ওখানে আমার ডেভেলপ করা একটি প্রোগ্রাম ভালোভাবে চলছে। ২০১০ সালে আমি জাপানে পোষ্ট ডক্টোরাল রিসার্চ করতে যাই এবং ২০১১ সালের মার্চ মাসে একটি ভয়াবহ ভূমিকম্প হয়। আমি সেইদিনের কথা কখনো ভূলতে পারবো না। আল্লাহ আমায় সেদিন বাঁচিয়ে ছিলেন। আমার মনে হচ্ছিলো কেয়ামত হচ্ছে। সেদিন মূল ভুমিকম্পের  পরে ওই রাতে ৭৪টি ভূমিকম্প হয়।

পরদিন আমি নিয়ত করি পরিবার নিয়ে হজ্জ করতে যাব। পরের বছর ২০১২ সালে পরিবার নিয়ে পবিত্র হজ পালন করতে যাই। এরপর ২০১৪ সালে আমি ভিজিটিং প্রফেসর হিসেবে ইউনিভার্সিটি মালেশিয়া তেরেংগানু নামের একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে যাই ১ মাসের জন্য।

এরপর সৌদি আরবের কিং আব্দুল আজিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে ২০১৪-২০১৫ তে অধ্যাপক হিসাবে ছিলাম। কিং আব্দুল আজিজ বিশ্বাবিদ্যালয় এর ম্যারিটাইম ফ্যাক্সল্টি ছিল জেদ্দার Obhur Bay এর নিকট। ফলে প্রতিদিন আমার বাসা থেকে মদিনা রোড দিয়ে যেতে হত এবং কিং আব্দুল্লাহ রোড দিয়ে ফিরে আসতে হত। আর আসার পথেই ওআইসির হেড কোয়ার্টার চোখে পড়তো। তখন থেকেই আমার ইচ্ছে হয়েছিল যে আমি একসময় আইইউটির ভিসি পদের জন্য একটা আবেদন করবো।

২০১৫-তে দেশে ফিরে আসি। তারপর একবার আইইউটি এর ভিসি পদের জন্য সার্কুলার হয়েছিল কিন্তু আমি জানতে পারিনি। পরেরবার আমার এক বন্ধু জানায় আইইউটি ভিসি নিয়োগ করবে, সার্কুলার হয়েছে। তখন আমি  আবেদন করার সিদ্ধান্ত নেই এবং যথাযথ কর্তৃপক্ষ এর মাধ্যমে আবেদন করি।

এরপর বাংলাদেশ সরকার ৩ জনের একটি শর্ট লিস্ট করে ওআইইসিতে পাঠায়। সেই শর্ট লিষ্ট আমিও ছিলাম। পরে ইন্টারভিউ দিতে গেলাম ওআইসির হেড কোয়ার্টারে। আমার ইন্টারভিউ হয় বেশ ভালো হয়েছিল এবং তখনই ইন্টারভিউ বোর্ডের সদস্য মহোদয়গণ আমার ইন্টারভিউর প্রশংসা করেছিলেন। এভাবেই আমার ভিসি হওয়া ২০২০ সালের ১ সেপ্টেম্বরে।

দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাস: একজন আন্তর্জাতিক বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হিসেবে দেশের জন্য কি করতে চান?
ড. মোহাম্মদ রফিকুল ইসলাম: আইইউটি একটি আন্তর্জাতিক বিশ্ববিদ্যালয় হলেও মনে রাখতে হবে এটি হোস্ট কান্ট্রি বাংলাদেশের একটি আন্তর্জাতিক বিশ্ববিদ্যালয়। তাই বাংলাদেশ সরকার এমন একটি বিশ্ববিদ্যালয় পেয়ে গর্বিত। এখানে ৮৫ ভাগ শিক্ষার্থী আমাদের দেশের।

আমাদের দেশের এতজন ছেলে-মেয়ে দেশে বসেই আন্তর্জাতিক একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনার সুযোগ পাচ্ছে; এটা দেশের জন্য অনেক গর্বের একটি বিষয়। কোয়ালিটি গ্র্যাজুয়েট তৈরির মাধ্যমে আমরা দেশের ইকোনোমিতে অনেক বড় অবদান রাখছি এবং ভবিষ্যতে  আরও বেশী অবদান রাখতে চাই।

অন্যদিকে আমরা বিভিন্ন ইন্ডাস্ট্রির সমস্যাগুলো নিয়ে আমাদের শিক্ষার্থীদের দিয়ে সমাধান করার চেষ্টা করছি। আইইউটিকে আমরা সকলে মিলে বাংলাদেশ সরকার, ওআইসি এবং ওআইসির অন্য সদস্য রাষ্ট্রের সহযোগীতা নিয়ে নম্বর ওয়ান একটি মডেল বিশ্ববিদ্যালয় করতে চাই। এটা আমাদের স্বপ্ন, আমাদের দেশের সকল পিতা-মাতার স্বপ্নই হবে যেন তাদের ছেলেমেয়ে আইইউটিটতে পড়বে। এই অল্প সময়ের মধ্যেই আমরা এটি অর্জন করতে চাই। শুধু বাংলাদেশে নয়, বাইরের মেম্বর দেশ সমুহও যেনো মনে করে তাদের শিক্ষার্থীদের আইইউটিতে পাঠাবে।

দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাস: আপনার গুরুত্বপূর্ণ সময়ের জন্য অসংখ্য ধন্যবাদ।
ড. মোহাম্মদ রফিকুল ইসলাম: দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসের জন্যেও অনেক শুভ কামনা রইলো।


সর্বশেষ সংবাদ