পঙ্গুত্ব মোকাবেলায় হাসপাতালে প্রশিক্ষিত রিহ্যাবিলিটেশন জনবল নিয়োগের দাবি বিশেষজ্ঞদের
- টিডিসি রিপোর্ট
- প্রকাশ: ১৩ নভেম্বর ২০২৫, ০৩:৪২ PM
শারীরিক প্রতিবন্ধকতা, ব্যথা, পেশী ও স্নায়ুর সমস্যায় আক্রান্ত জনগোষ্ঠীর যথাযথ চিকিৎসায় সারাদেশের হাসপাতালগুলোতে ফিজিক্যাল মেডিসিন অ্যান্ড রিহ্যাবিলিটেশন ইউনিটকে শক্তিশালী করার দাবি জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। একইসাথে ইউনিটগুলোতে দক্ষ ও প্রশিক্ষিত জনবল নিয়োগের দাবিও জানিয়েছেন তারা। জাতীয় ফিজিক্যাল মেডিসিন অ্যান্ড রিহ্যাবিলিটেশন দিবসে আয়োজিত আলোচনা সভা থেকে এই দাবি জানান তারা।
‘সম্মিলিত পুনর্বাসনে চাই সম্মিলিত প্রচেষ্টা’ প্রতিপাদ্যে দিবসটি উদযাপিত হচ্ছে। এ উপলক্ষে আজ বৃহস্পতিবার (১৩ নভেম্বর) বেলা ১১টার দিকে বাংলাদেশ মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএমইউ) মিলন হল মিলনায়তনে বাংলাদেশ সোসাইটি অব ফিজিক্যাল মেডিসিন অ্যান্ড রিহ্যাবিলিটেশনের (বিএসপিএমআর) উদ্যোগে এই আলোচনা সভা আয়োজিত হয়। এর আগে ‘সবার জন্য রিহ্যাবিলিটেশন সেবা: সুস্থ জীবনের অধিকার’ প্রতিপাদ্যে একটি বর্ণাঢ্য র্যালি বের করে সংগঠনটি।
আলোচনা সভায় প্রধান অতিথি প্রো-ভাইস চ্যান্সেলর অধ্যাপক ডা. মো. মুজিবুর রহমান হাওলাদার বলেন, ভালো ডাক্তার তৈরি করার উদ্দেশ্য একটাই- এদেশের জনমানুষের চিকিৎসা নিশ্চিত করা। আমরা প্রশাসনে আসার পর থেকে রিহ্যাবিলিটেশনের জন্য একটা রোবটিক সেন্টার স্থাপন করেছি, যেখানে ৫৮টি রোবট চালু আছে। এই টেকনোলজি ব্যবহার করে চিকিৎসার ক্ষেত্রে আমূল পরিবর্তন আনা সম্ভব।
বিশেষ অতিথির বক্তব্যে বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের (বিসিবি) সভাপতি আমিনুল ইসলাম বুলবুল চিকিৎসকদের উদ্দেশ্যে বলেন, মানুষের বেঁচে থাকার জন্য আপনারা যে হার্ড ওয়ার্ক করেন, রিসার্চ করেন তা প্রশংসার দাবি রাখে। ক্রিকেট খেলতে ফিজিক্যাল ও মেন্টাল দিকটা অনেক গুরুত্বপূর্ণ। খেলোয়াড় ভালো পার্ফরমেন্স করতে চাইলে ফিজিক্যাল মেন্টেইনের জন্য আপনাদের সাহায্য আমাদের প্রয়োজন।
তিনি বলেন, আমাদের রান হয়তো কাউন্ট হয়, কিন্তু আপনারা যারা আমাদের সুস্থতায় কাজ করেন- তারা যে পারফর্ম করেন, তাদের রানটা আর কাউন্ট হয় না। আমরা যখন অসুস্থ হই, আমরা শুধু সেবা নিই। কিন্তু আপনাদের যে পরিশ্রম তার জন্য আমরা অনেক বেশি কৃতজ্ঞ আপনাদের প্রতি।
আলোচনা সভায় বক্তারা বলেন, ফিজিক্যাল মেডিসিন অ্যান্ড রিহ্যাবিলিটেশন হল এমন একটি চিকিৎসা শাখা- যা বিভিন্ন ধরনের শারীরিক প্রতিবন্ধকতা, ব্যথা, পেশী ও স্নায়ুর সমস্যায় আক্রান্ত রোগীদের পুনর্বাসনের মাধ্যমে স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনার লক্ষ্য নিয়ে কাজ করে। এটি শুধুমাত্র চিকিৎসা নয়- বরং ‘জীবনকে পুনরুদ্ধারের চিকিৎসা।’
আলোচকরা জানান, বাংলাদেশে প্রতিবছর লক্ষ লক্ষ মানুষ স্ট্রোক, আঘাতজনিত অক্ষমতা, দুর্ঘটনা, পেশী-সন্ধি বাথা, শিশুদের সেরিব্রাল পালসি, বয়স্কদের চলাচলজনিত সীমাবদ্ধতা ইত্যাদি প্রতিবন্ধিতা সমস্যায় ভোগেন। ফিজিক্যাল মেডিসিন বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ, আধুনিক ফিজিওথেরাপি, অকুপেশনাল থেরাপি, স্পিচ থেরাপি ও রিহ্যাবিলিটেশন প্রোগ্রামের মাধ্যমে এদের অনেকেই আবার স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসতে সক্ষম হন।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) বরাত দিয়ে সভায় আলোচকরা বলেন, ২০২২ সালে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের সংখ্যা আনুমানিক ৪৩ লক্ষ ৩০ হাজার ৭১০ জন। প্রতি হাজারে এই সংখ্যা ২৫.৫। এর মধ্যে শারীরিক প্রতিবন্ধিতা উল্লেখযোগ্য। তবে প্রতিবন্ধীদের সেবা ও পুনর্বাসনের ক্ষেত্রে অনেক চ্যালেঞ্জ রয়েছ, যেমন যথাযথ তথ্যের ঘাটতি, পুনর্বাসন সেবার সীমাবদ্ধতা, গ্রামীণ এলাকাতে প্রতিবন্ধীদের সামাজিক ও অর্থনৈতিক অন্তর্ভুক্তি সীমাবদ্ধ অর্থনৈতিক দৈন্য এবং শিক্ষার সুযোগ। বাংলাদেশের গড় আয়ু বৃদ্ধির কারণে বার্ধক্যজনিত সমস্যাও ভবিষ্যতে স্বাস্থ্য ব্যবস্থার একটি চ্যালেঞ্জ।
২০২০ সালের একটি নিবন্ধে প্রকাশিত ও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) তথ্য অনুসারে, বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যার ষাটোর্ধ্ব বয়সী ব্যক্তির সংখ্যা প্রায় ৯.৮%। গবেষণায় দেখা গেছে, ২০১৫ সালে ষাটোর্ধ্ব বয়সী মানুষের অংশ ছিল ৭.৭% এবং ২০২৩ সালে ৯.৫%, যা ২০২০ থেকে ২০৫০ সাল পর্যন্ত এই বয়সী অংশ প্রায় ৩ গুণ বাড়বে। এর ফলে বয়স্কদের শারীরিক অক্ষমতা, দীর্ঘমেয়াদি সংক্রমণ (ক্রনিক ডিজিজ) ও পুনর্বাসনের চাহিদা দ্রুত বেড়ে যাবে। প্রতিবন্ধিতা ও অক্ষমতা বৃদ্ধিপ্রবণ, বয়স বাড়ার সঙ্গে শারীরিক অক্ষমতা-হারে (মবিলিটি ইস্যু, শোনার বা দৃষ্টির সমস্যা, হাড়-পেশি দুর্বলতা) প্রকোপ দ্রুত বাড়ছে।
বিএসপিএমআর বলছে, প্রতিবন্ধীদের সেবা ও পুনর্বাসনের ক্ষেত্রে বর্তমান চ্যালেঞ্জগুলো মাঝে জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে সেবার ঘাটতি, প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত বিশেষজ্ঞ ও থেরাপিস্টের সীমাবদ্ধতা, পুনর্বাসন অবকাঠামো ও সহায়ক প্রযুক্তির স্বল্পতা, প্রতিবন্ধিতা সম্পর্কিত তথ্য ও পরিসংখ্যানের ঘাটতি, সামাজিক মনোভাব ও সচেতনতার অভাব অন্যতম।
আলোচনা সভায় বক্তারা দেশের প্রতিটি সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালে ফিজিক্যাল মেডিসিন ও রিহ্যাবিলিটেশন ইউনিটকে আরও শক্তিশালী করার প্রতি গুরুত্বারোপ করেন। তারা বলেন, পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত রিহ্যাবিলিটেশন জনবল নিয়োগ দেওয়া হোক এবং জনসচেতনতা বাড়ানো হোক, যাতে মানুষ সঠিক সময়ে সঠিক চিকিৎসা গ্রহণ করতে পারে। একইসাথে বিদ্যমান আইনকে কার্যকর, নতুন আইন প্রণয়ন ও নীতিমালা বাস্তবায়নে তৎপরতা বাড়ানো প্রয়োজন।
এছাড়া সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয়, জেলা-উপজেলা প্রশাসন, এসএনজিও ও সিভিল সোসাইটির একসঙ্গে কাজ করার জন্যও আহ্বান জানান তারা। বলেন, স্কুল, কলেজ, কর্মক্ষেত্র, সড়ক পরিবহনসহ সর্বত্র প্রতিবন্ধীবান্ধব ইউনিভার্সাল ডিজাইনের মান মেনে তৈরি করতে হবে।
বাংলাদেশ সোসাইটি অব ফিজিক্যাল মেডিসিন অ্যান্ড রিহ্যাবিলিটেশনের জেনারেল সেক্রেটারি সহযোগী অধ্যাপক ডা. এ কে আজাদের সঞ্চালনায় ও নির্বাহী সভাপতি অধ্যাপক ডা মো তসলিম উদ্দিনের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে মূল বক্তা হিসেবে ছিলেন সংগঠনটির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ডা. এম এম জামান। এতে আরও বক্তব্য রাখেন প্রথম আলোর সাংবাদিক শিশির মোড়ল ও সংগঠনটির সাংগঠনিক ডা. মো. সোহেল রানা প্রমুখ।
উল্লেখ্য, বাংলাদেশে ফিজিক্যাল মেডিসিন ও রিহ্যাবিলিটেশন চিকিৎসা কার্যক্রম শুরু হয় ১৯৬৭ সালে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হতে। স্বাধীনতা-উত্তর সময়ে যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা ও দুর্ঘটনাজনিত আহতদের পুনর্বাসনের মাধ্যমে এর বিস্তৃতি শুরু হয়। বাংলাদেশ কলেজ অব ফিজিশিয়ান্স অ্যান্ড সার্জন্স (বিসিপিএস) ১৯৯০ সালে ফিজিক্যাল মেডিসিন ও রিহ্যাবিলিটেশনে পোস্টগ্রাজুয়েট কোর্স চালু করে। সরকারি পর্যায় জাতীয় অর্থোপেডিক্স হাসপাতাল ও ইনস্টিটিউট (নিটোর), বাংলাদেশ মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় এবং ঢাকা, শহীদ সোহরাওয়ার্দী, ময়মনসিংহ, চট্টগ্রাম, রাজশাহী, খুলনা, রংপুর ও বরিশাল শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালসহ প্রায় সকল সরকারি মেডিকেল কলেজে ফিজিক্যাল মেডিসিন ও রিহ্যাবিলিটেশন বিভাগ চালু রয়েছে। জেলা সদর পর্যায়ে ধীরে ধীরে ইউনিট স্থাপনের উদ্যোগ চলছে। পেশাগত সংগঠন বিএসপিএমআর প্রতিষ্ঠিত হয় ১৯৯৫ সালে।