নিকটাত্মীয়ের মধ্যে বিয়েতে সন্তানের বংশগত রোগের ঝুঁকি বাড়ে
- টিডিসি রিপোর্ট
- প্রকাশ: ০৩ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ০৭:২১ PM
আত্মীয়-স্বজনের মধ্যে বিবাহ বিশ্বের অনেক দেশেই প্রচলিত। প্রায় প্রতি তিনটি বিয়ের একটি ঘনিষ্ঠ আত্মীয়ের মধ্যে হয়ে থাকে। এর মধ্যে একটি অংশ হয় প্রথম পর্যায়ের বা ফার্স্ট ডিগ্রি রিলেটিভদের মধ্যে। অর্থাৎ আপন চাচাতো, মামাতো, খালাতো, ফুফাতো ভাইবোনের মধ্যে হয় এই বিয়ে। আর অপর অংশ হয় দ্বিতীয় বা সেকেন্ড ডিগ্রি রিলেটিভ বা বাবা-মায়ের চাচাতো, মামাতো, খালাতো বা ফুফাতো ভাইবোনের সন্তানদের মধ্যে। অবশ্য শহরের তুলনায় গ্রামাঞ্চলে বেশি হয়। এতে আবার বাল্যবিবাহের আধিক্যও বেশি থাকে। কিন্তু আত্মীয়দের মধ্যে বিবাহপ্রথার বেশ কিছু স্বাস্থ্য ঝুঁকি রয়েছে, যা বংশ পরম্পরায় সন্তানদের বয়ে বেড়াতে হয়।
নিকটাত্মীয়ের মধ্যে বিয়ের কারণে গর্ভপাত ও মৃত সন্তান প্রসবের ঝুঁকিও বাড়ে। এ ছাড়া শারীরিক ত্রুটিসংবলিত শিশুর জন্ম স্বাভাবিকের চেয়ে ৫ গুণ বেশি, প্রথম বছর বয়সে শিশুর অস্বাভাবিক মৃত্যু, হঠাৎ অজানা কারণে শিশুমৃত্যু, যথাযথভাবে শিশু বৃদ্ধি না হওয়া, শ্রবণ ও দৃষ্টিশক্তি ও বুদ্ধি প্রতিবন্ধিতা, মৃগী রোগ, অজানা রোগ এবং নানা রকমের রক্তরোগ যেমন সিকেল সেল ডিজিজ ও বিটা থ্যালাসেমিয়া প্রভৃতির ঝুঁকি বৃদ্ধি পায়।
এ ধরনের বিয়ের ফলে সৃষ্ট হওয়া স্বাস্থ্য সমস্যা ও তা প্রতিরোধে করণীয় সম্পর্কে আলোকপাত করা হলো—
জেনেটিক ঝুঁকি: আত্মীয়-স্বজনের মধ্যে বিবাহের সবচেয়ে বড় ঝুঁকি হলো জেনেটিক। এর প্রধান কারণ হলো, আত্মীয়দের মধ্যে জেনেটিক উপাদান একই হওয়ার আশঙ্কা বেশি থাকে, যা জেনেটিক রোগের ঝুঁকি বাড়ায়। এ কারণে সন্তানদের জেনেটিক এবং বিভিন্ন জন্মগত ত্রুটি হওয়ার ঝুঁকি বৃদ্ধি পায়।
অটোজোমাল রিসেসিভ রোগ: অটোসোমাল রিসেসিভ রোগ হলো এমন ভয়াবহ রোগ, যা দুটি রিসেসিভ জিনের সংমিশ্রণে ঘটে। প্রতিটি ব্যক্তির দুটি করে জিন থাকে, একটি মা থেকে এবং একটি বাবা থেকে আসে। যখন উভয় পিতা-মাতা একটি করে রিসেসিভ জিন বহন করেন এবং এটি সন্তানের মধ্যে একত্রিত হয়, তখন সন্তানের মধ্যে সেই রোগটি দেখা দেয়। যেমন—সিস্টিক ফাইব্রোসিস, থ্যালাসেমিয়া, সিকল সেল অ্যানিমিয়া। বাংলাদেশে এমনিতেই থ্যালাসেমিয়া রোগের বাহক বেশি, হিমোগ্লোবিন ই ডিজিজের বাহকও কম নয়। নিকটাত্মীয়ের বিয়েতে এ ধরনের রোগ নিয়ে সন্তান জন্ম নেওয়ার ঝুঁকি অনেকাংশে বেড়ে যায়।
জন্মগত ত্রুটি: আত্মীয়-স্বজনের মধ্যে বিবাহের ফলে জন্মগত ত্রুটি এবং বিভিন্ন জেনেটিক সিনড্রোম, যেমন: ক্লেফট লিপ/প্যালেট, ডাউন সিনড্রোম, কনজেনিটাল হার্ট ডিজিজের ঝুঁকি বৃদ্ধি পায়।
শিশু মৃত্যুহার: আত্মীয়ে মধ্যে বিবাহের ফলে জন্মগত ত্রুটি এবং শিশু মৃত্যুহার বৃদ্ধি পায়। গবেষণায় দেখা গেছে, আত্মীয় বিবাহের ফলে শিশু মৃত্যুহার ৩ থেকে ৪ শতাংশ বৃদ্ধি পেতে পারে।
অসুস্থতার হার বৃদ্ধি: আত্মীয়-স্বজনের সাথে বিবাহের কারণে শিশুদের মধ্যে অসুস্থতার হার বৃদ্ধির পাশাপাশি দীর্ঘমেয়াদি গুরুতর স্বাস্থ্য সমস্যা, যেমন—মানসিক উন্নয়নে বিলম্ব, শারীরিক বৃদ্ধিতে সমস্যার ঝুঁকি থাকে।
মানসিক এবং শারীরিক স্বাস্থ্য: আত্মীয়ে মধ্যে বিবাহের ফলে শিশুদের মানসিক স্বাস্থ্যে সমস্যা, যেমন—অটিজম, বুদ্ধিমত্তার কমতি এবং শিখন সমস্যা দেখা দিতে পারে।
বংশানুক্রমিক রোগ: আত্মীয়ে মধ্যে বিবাহের কারণে বংশানুক্রমিক রোগের ঝুঁকি বৃদ্ধি পায়, যা পরবর্তী প্রজন্মেও অব্যাহত থাকতে পারে।
পরিবারে স্বাস্থ্য সমস্যা তৈরি: আত্মীয়ে মধ্যে বিবাহের ফলে একই পরিবারের বিভিন্ন সদস্য একই ধরনের স্বাস্থ্য সমস্যায় ভুগতে পারে, যা পুরো পরিবারের স্বাস্থ্যকে ক্ষতিগ্রস্ত করে।
প্রতিরোধ ও সচেতনতা
নিকট আত্মীয়র বিয়েতে জন্মগত ত্রুটি এবং জেনেটিক রোগের ঝুঁকি কমাতে বেশ কিছু পদক্ষেপ নেওয়া যেতে পারে। বিশেষ করে সমাজে নিকট আত্মীয়ের মধ্যে বিয়ের ঝুঁকি সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধির লক্ষে বিয়ের পূর্বে এর ক্ষতিকর ঝুঁকিগুলো বিস্তারিতভাবে জানানো জরুরি। এ ছাড়া বিবাহের আগে একটি মেডিকেল চেকআপ এবং জেনেটিক স্ক্রিনিং বাধ্যতামূলক করা যেতে পারে, যা সম্ভাব্য ঝুঁকি শনাক্ত করতে সাহায্য করবে। বিশেষ করে গর্ভধারণের পূর্বেই জেনেটিক স্ক্রিনিং ও টেস্টিংয়ের মাধ্যমে থ্যালাসেমিয়া, সিস্টিক ফাইব্রোসিস, সিকল সেল অ্যানিমিয়া ইত্যাদি রোগ সম্পর্কে জানা যেতে পারে। স্বাস্থ্যকর জীবনযাত্রা, যেমন—স্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস, নিয়মিত ব্যায়াম এবং স্বাস্থ্য পরীক্ষা জেনেটিক ঝুঁকি কমাতে সহায়ক হতে পারে।
এ ছাড়া সরকার ও স্বাস্থ্য সংস্থাগুলো জেনেটিক কাউন্সেলিং এবং স্ক্রিনিং সেবা প্রদান করতে পারে। আত্মীয় বিবাহের ঝুঁকি সম্পর্কে জনসাধারণকে সচেতন করার জন্য প্রচারণা চালানো উচিত। এ ছাড়াও সরকার একটি জেনেটিক ডাটাবেস বা রেজিস্ট্রি তৈরি করা যেতে পারে, যেখানে পরিবারগুলির জেনেটিক ইতিহাস সংরক্ষিত থাকবে। এটি জেনেটিক ঝুঁকি শনাক্ত করতে সাহায্য করবে।