এক ব্যক্তির ‘ভুলে’ ভ্যাকসিন নিয়ে আরো সংকটে দেশ

করোনাভাসের টিকা
করোনাভাসের টিকা  © সংগৃহীত

বাংলাদেশে ভ্যাকসিন সংকট কাটানোর নানা উদ্যোগের মধ্যেই এবার চীনের ভ্যাকসিন নিয়ে জটিলতার আশঙ্কা করা হচ্ছে। চীনা ভ্যাকসিনের দাম গোপন রাখতে ব্যর্থ হওয়ায় এই জটিলতা বলে জানা গেছে।

গত ২৭ মে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের আতিরিক্ত সচিব শাহিদা আক্তার সংবাদ সম্মেলনে সিনোফার্মের টিকার প্রতি ডোজ ১০ ডলার দামে কেনার চুক্তির কথা জানান। তিনি আরো জানান, বাংলাদেশ চীন থেকে দেড় কোটি ডোজ টিকা কিনবে। মোট দাম পড়বে ১৫ কোটি ডলার, যা বাংলাদেশি মূদ্রায় এক হাজার ২৬৭ কোটি ৫০ লাখ টাকা।

কিন্তু চীনের সাথে ভ্যাকসিন চুক্তির শর্ত ছিল দাম প্রকাশ করা যাবে না। তাই আতিরিক্ত সচিব শাহিদা আক্তার দাম প্রকাশ করে দেয়ায় বিপাকে পড়েছে চীন। বাংলাদেশের জন্য ধার্য করা দাম নিয়ে আপত্তি জানিয়েছে শ্রীলঙ্কা। কারণ, তারা চীনের কাছ থেকে টিকা পাচ্ছে ১৫ ডলারে। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, চীন এরই মধ্যে তাদের অস্বস্তির কথা জানিয়েছে। ফলে বাংলাদেশকেও শেষ পর্যন্ত ১৫ ডলারেই চীনা টিকা কিনতে হতে পারে।

এই ঘটনায় এরই মধ্যে মন্ত্রীপরিষদ বিভাগের অতিরিক্ত সচিব শাহিদা আক্তারকে ওএসডি করা হয়েছে। চুক্তির সাথে জড়িত একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, ‘‘আমরা এমনকি মন্ত্রীকেও চুক্তির শর্ত মেনে দাম জানাইনি। এই কর্মকর্তা কেন জানালেন সেটা নিয়ে ভাবার বিষয় আছে।”

পড়ুন: সংক্রমণের ৮০ শতাংশই ভারতীয় ধরন

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক ড. ইমতিয়াজ আহমেদ বলেন, "সারা বিশ্বে ভ্যাকসিন নিয়ে নানা ধরনের তৎপরতা আছে। কেউ ভ্যাকসিন মজুত করছে, বিক্রি করছে না। কারুর ভ্যাকসিনের মেয়াদ পেরিয়ে গেলেও অন্য দেশকে দিচ্ছে না। আমাদের ভ্যাকাসিন কূটনীতি বুঝতে হবে। যেখানে দাম গোপন করার চুক্তি আছে, সেখানে সেই দাম একজন কর্মকর্তা কীভাবে প্রকাশ করলেন। তাকে কি আগে ব্রিফ করা হয়নি! তিনি কি চুক্তির শর্ত জানেন না? হয়তো না জেনে করতে পারেন। আবার উদ্দেশ্যমূলভাবেও করতে পারেন। আমি জানি না। কিন্তু আমাদের ক্ষতি হয়ে গেল।”

এ প্রসঙ্গে জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. লেনিন চৌধুরী বলেন, ‘‘ভ্যাকসিন নিয়ে আমাদের কাজ যে অপরিকল্পিতভাবে এগোচ্ছে তার একটা বড় প্রমাণ এটা।”

বিষয়টি নিয়ে স্বাস্থ্য ও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কেউ আনুষ্ঠানিকভবে কথা বলতে রাজি হননি। তবে পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবদুল মোমেন সংবাদ মাধ্যমকে বলেছেন, ‘‘দাম প্রকাশ করায় চীন এখন বিভিন্ন দেশের চাপের মুখে পড়েছে। আমরা চীনকে বলেছি, এরকম আর হবে না।”

বাংলাদেশ এখনো রাশিয়ার সঙ্গে ভাকসিনের চুক্তি করেনি। আলাপ-আলোচনা চলছে। সেখান থেকেও এক কোটি ভ্যাকসিন আনার পরিকল্পনা আছে সরকারের।

বাংলাদেশে এখন অক্সফোর্ডের টিকা দেয়া বন্ধ আছে। টিকা আছে মাত্র দুই লাখ ছয় হাজার ৫৫ ডোজ। সবাইকে দ্বিতীয় ডোজের টিকা দেয়াও বাকি আছে।

করোনাভাইরাসের টিকাদান কর্মসূচি শুরুর পর থেকে এ পর্যন্ত অক্সফোর্ডের টিকা দেয়া হয়েছে মোট ৯৯ লাখ ৯৩ হাজার ৯৪৫ ডোজ। এর মধ্যে প্রথম ডোজ নিয়েছেন ৫৮ লাখ ২০ হাজার ১৫ জন, আর দ্বিতীয় ডোজ নিয়েছেন ৪১ লাখ ৭৩ হাজার ৯৩০ জন। প্রথম ডোজ অক্সফোর্ডের টিকা নেয়া সবাইকে দ্বিতীয় ডোজ দেয়া যাচেছ না। ভারতের সেরাম ইনস্টিটিউটও চুক্তি অনুযায়ী এখন টিকা দিতে পারছে না। অন্য কোনো দেশ থেকেও এই টিকা সংগ্রহের কোনো অগ্রগতির খবর নেই।

ফাইজারের এক লাখ ৬২০ ডোজ টিকা ঢাকায় এসেছে চার দিন আগে। এক সপ্তাহের মধ্যে এই টিকা দেয়া শুরু হবে। যারা আগে নিবন্ধন করেছেন, তারাই এই টিকা পাবেন। দুই ডোজ করে ৫০ লাখ মানুষকে এই টিকা দেয়া যাবে। এই টিকা দিয়েছে কোভ্যাক্স। তাদের কাছ থেকে এক কোটি ডোজ টিকা কম দামে পাওয়ার কথা আছে।

চীন থেকে উপহার হিসেবে পাওয়া পাঁচ লাখ টিকার ট্রায়াল শুরু হয়েছে। তবে এই টিকার অগ্রাধিকার আছে। বাংলাদেশে চীনা নাগরিক, চীনের বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে অধ্যয়নরত বাংলাদেশি ছাত্র, যারা এখন দেশে আছেন, তারা আগে পাচ্ছেন। এই টিকা গত ২৪ ঘন্টায় দেয়া হয়েছে ২০ জনকে। আর ২৫ মে থেকে এ পর্যন্ত দেয়া হয়েছে দুই হাজার ১৬২ জনকে। চীনের আরো ৯ লাখ ডোজ টিকা উপহার দেয়ার কথা আছে।

বৃহস্পতিবার বাজেট বক্তৃতায় অর্থমন্ত্রী বলেছেন দেশের ৮০ ভাগ মানুষকে টিকা দেয়া হবে। আর প্রতিমাসে ২৫ লাখ ডোজ টিকা দেয়ার পরিকল্পনা আছে। লেনিন চৌধুরী প্রশ্ন তুলেছেন, ‘‘যদি প্রতিমাসে ২৫ লাখ ডোজ দেয়া হয় তাহলে ১৪-১৫ কোটি মানুষকে টিকা দিতে কত দিন লাগবে?”

তার মতে, এখন পর্যন্ত যা অবস্থা, তাতে টিকা পরিস্থিতি ভালো নয়। ‘আমরা যা করছি তার চেয়ে বেশি বাড়িয়ে বলছি। ফলে একটা অস্বচ্ছ পরিস্থিতি সৃষ্টি হচ্ছে।’

আর অধ্যাপক ইমতিয়াজ বলেন, চীন প্রতিদিন তার দেশের ১৯ মিলিয়ন মানুষকে টিকা দিচ্ছে। আমরা কত জনকে দিতে পারছি? এখন তো বলতে গেলে কাউকে টিকা দেয়াই হচেছ না। আমাদের আরো দক্ষতা দেখাতে হবে। ভ্যাকসিন কূটনীতি আরো জোরদার করতে হবে। সবাই নিজের জন্য করছে। সেটা মাথায় রাখতে হবে। আমাদের সতর্ক এবং দায়িত্বশীলতার সাথে কাজ করতে হবে। দায়িত্বহীন হলে যা অর্জন তা-ও আবার ফসকে যাবে। মনে রাখতে হবে, টিকা আমাদের পেতেই হবে। [সূত্র: ডয়চে ভেলে বাংলা]


সর্বশেষ সংবাদ