দায়িত্ব পালনে পুলিশ কি ‘উভয় সংকটে’
- বিবিসি
- প্রকাশ: ২৯ আগস্ট ২০২৫, ১১:৪০ AM , আপডেট: ৩০ আগস্ট ২০২৫, ০৩:৩৫ PM
সভা-সমাবেশ নিষিদ্ধ ঘোষণা সত্ত্বেও বিএনপি নেতা ইশরাক হোসেনের সমর্থকরা প্রধান উপদেষ্টার বাসভবনের সামনে সমাবেশ করেন, যেখানে পুলিশ ব্যারিকেড সরিয়ে দিয়েছিল। একই সময়ে, আওয়ামী লীগ কার্যক্রম নিষিদ্ধের দাবিতে যমুনার তীরবর্তী এলাকায় অবস্থান নিয়েছিলেন এনসিপি নেতা হাসনাত আব্দুল্লাহ ও তার সমর্থকরা।
তবে প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে পুলিশ ভিন্নভাবে কার্যকরী ভূমিকা পালন করেছে। এর আগে ধর্ষণবিরোধী প্রতিবাদ কর্মসূচিতেও পুলিশকে কঠোর অবস্থানে দেখা গিয়েছিল। ভিন্ন প্রেক্ষাপটে পুলিশের ভূমিকা নিয়ে বারবার প্রশ্ন ওঠে। কিছু ঘটনায় তারা নিরব থাকলেও, অন্য ক্ষেত্রে অতিরিক্ত বল প্রয়োগের অভিযোগ উঠায় পুলিশকে ‘উভয় সংকটে’ ফেলা হচ্ছে—এ নিয়েও চলছে আলোচনা।
রাষ্ট্রীয় বাহিনীর নিরপেক্ষতা নিয়েও প্রশ্ন তুলছেন অনেকে। সম্প্রতি প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে পুলিশের ভূমিকা আবারও আলোচনায় এসেছে। প্রশ্ন উঠছে, প্রধান উপদেষ্টার বাসভবন অভিমুখে বিক্ষুব্ধ শিক্ষার্থীদের থামাতে পুলিশ আর কী করতে পারত? সভা-সমাবেশ নিষিদ্ধ ঘোষণার পর অতীতে যে কর্মসূচিগুলো ওই এলাকায় হয়েছে, সেগুলো নিয়ন্ত্রণে পুলিশ কী ধরনের পদক্ষেপ নিয়েছিল—এই প্রসঙ্গও তুলে ধরছেন অনেকে।
সম্প্রতি পুলিশের সামনেই ছিনতাই ও মব তৈরি করে হামলার ঘটনা ঘটেছে, যেখানে পুলিশ নিরব ছিল এসব নিয়েও সমালোচনা হয়েছে। পুলিশ বলছে, ব্যবস্থা নিলে পক্ষপাত বা অতিরিক্ত বল প্রয়োগের অভিযোগ ওঠে, আর ব্যবস্থা না নিলে গাফিলতি বা দায়িত্বহীনতার অভিযোগ আসে। ফলে যেভাবেই হোক, সমালোচনা এড়ানো প্রায় অসম্ভব।
সাবেক আইজিপি নুরুল হুদা মনে করেন, এটি পুলিশের জন্য নতুন নয়। তিনি বলেন, দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি পুলিশি দায়িত্ব পালনে গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব ফেলে। ‘যখন স্পেসিফিক পলিটিক্যাল গভর্নমেন্ট নেই, তখন ঝামেলা বা সমস্যা হয়,’ তিনি জানান।
জুলাই অভ্যুত্থানের পর থেকেই আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণে পুলিশের ভূমিকা নিয়ে সমালোচনা চলেছে। বছর পেরলেও পরিস্থিতির খুব উন্নতি হয়নি বলেই মনে করেন অনেকে। একই সঙ্গে অভিযোগ রয়েছে, দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে পুলিশও বাঁধার মুখে পড়েছে।
গত ২১ ও ২২ মে বিএনপি নেতা ইশরাক হোসেনকে মেয়রের দায়িত্ব দেওয়ার দাবিতে তার সমর্থকেরা যমুনার তীরবর্তী এলাকায় অবস্থান নেন। এর আগে বিভিন্ন সংগঠন একই স্থানে আওয়ামী লীগের কার্যক্রম নিষিদ্ধের দাবিতে বিক্ষোভ করলেও পুলিশের ভূমিকা ছিল সীমিত। এছাড়া সামনেই ছিনতাই ও জনতার হামলার ঘটনাও ঘটেছে সম্প্রতি।
গত জুলাই মাসে ধানমন্ডিতে পুলিশের সামনেই অস্ত্র দেখিয়ে ছিনতাইয়ের ভিডিও ভাইরাল হয়। মোহাম্মদপুরে একটি ছিনতাইয়ের ঘটনায় পুলিশের অসহযোগিতার অভিযোগও উঠেছে। ধানমন্ডি ও শাহবাগে পুলিশের সামনেই মব তৈরি করে হামলার ঘটনা ঘটেছে, যেখানে পুলিশের সদস্যরাও আক্রান্ত হয়েছেন। অতীতেও দ্বিমুখী আচরণের কারণে পুলিশ সমালোচিত হয়েছেন, তবে সম্প্রতি পরিস্থিতি আরও তীব্র হয়েছে।
বিশেষ করে প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের প্রধান উপদেষ্টার বাসভবনের দিকে যাওয়ায় বাধা দেয়ার ধরন নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, শিক্ষার্থীদের উত্তেজনা থাকলেও পুলিশের ভূমিকা তা বাড়িয়ে দিয়েছে। কয়েকজন শিক্ষার্থীকে বেধড়ক পিটিয়েছে পুলিশ। শিক্ষার্থীদের অভিযোগ, আন্দোলন দমাতে অতিরিক্ত বল প্রয়োগ করা হয়েছে। পুলিশেরও কয়েকজন আহত হয়েছেন। পরে ডিএমপি কমিশনার শেখ মো. সাজ্জাত আলী শিক্ষার্থীদের কাছে দুঃখপ্রকাশ করেন।
জুলাই অভ্যুত্থানের পর বছর পেরলেও আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নানা কারণে চ্যালেঞ্জের মুখে। পুলিশের সামনেই অপরাধ, পুলিশকে লক্ষ্য করে হামলা, আসামি ছিনতাই এ ধরনের ঘটনা নিয়মিত শিরোনামে উঠে আসে। অভ্যুত্থান পরবর্তী পুলিশ সংস্কার কমিশন প্রতিবেদন জমা হলেও বাস্তবায়ন শুরু হয়নি।
জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের সময় অতিরিক্ত বল প্রয়োগের অভিযোগ ওঠে। দেশের অধিকাংশ থানায় হামলা ও লুটপাটের ঘটনাও ঘটেছিল। পুলিশ সদর দপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ও অভ্যুত্থানে সংঘর্ষে ৪৪ জন পুলিশ সদস্য নিহত হন। সিনিয়র কর্মকর্তাদের মতে, জুলাইয়ে পুলিশ হত্যার বিচার না হওয়ায় বাহিনীর মনোবল ভেঙে পড়েছে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে পুলিশের এক কর্মকর্তা বিবিসি বাংলাকে বলেন, ‘রাজনৈতিক কারণে পুলিশ সদস্য যদি ভিকটিম হয়, তার দায় কে নেবে? এজন্য দায়িত্ব পালনে সংশয় দেখা দেয়।’ তিনি আরও বলেন, ‘অভ্যুত্থান পরবর্তী সময়ে রাজনৈতিক পরিস্থিতি এবং ট্যাগিং সংস্কৃতি কাজের ক্ষেত্রকে জটিল করে দিয়েছে।’
পুলিশ সদর দপ্তর স্বীকার করছে, তারা সবসময় ‘উভয় সংকটে’ থাকে। কোনো ঘটনায় ব্যবস্থা নিলে পক্ষপাত বা অতিরিক্ত বল প্রয়োগের অভিযোগ আসে, আর ব্যবস্থা না নিলে দায়িত্বহীনতা বা গাফিলতির অভিযোগ। পাশাপাশি রাজনৈতিক, সামাজিক এবং গণমাধ্যমের চাপও থাকে। পুলিশের কাজের পরিধি আইনি কাঠামো দ্বারা নির্ধারিত, যেখানে ক্ষেত্রবিশেষে জন-আকাঙ্ক্ষার সাথে সামঞ্জস্য রাখতে হয়।
সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী মনজিল মোরসেদ মনে করেন, পুলিশের ব্যবহার রাজনৈতিকভাবে প্রিপারলি করার ব্যবস্থা আগে বন্ধ করতে হবে। আগে সরকারগুলো পুলিশকে রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করায় সাধারণ মানুষের কাছে পুলিশি ভাবমূর্তি সংকটগ্রস্ত হয়েছে। তিনি বলেন, ‘জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে পুলিশ হত্যা বিচার না হওয়ায় মনোবল ভেঙে গেছে।’
মোরসেদ আরও বলেন, ‘পুলিশ যদি একজনের জীবন রক্ষা করতে গুলি করে, সে আসামী হয়ে জেল খেতে যাবে না—এই নিশ্চয়তা যদি না দেওয়া হয় বা পুলিশ মারা গেলে বিচার হবে না, তাহলে পরিস্থিতি ঠিক হওয়ার সম্ভাবনা কম।’ তিনি এও বলেন, ‘পুলিশের কেউ অন্যায় করলে তার বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নেওয়ার সুযোগ আছে, কেউ আইনের ঊর্ধ্বে নয়।’
সাবেক আইজিপি নুরুল হুদা মনে করেন, ‘উভয় সংকট’ নতুন নয়। ‘যখন স্পেসিফিক পলিটিক্যাল গভর্নমেন্ট নেই, সমস্যা হয়। তবে পুলিশের ভূমিকার ধরন সমাজের ওপরও নির্ভর করে। আমাদের সমাজ রিঅ্যাকটিভ, খুব তাড়াতাড়ি প্রতিক্রিয়া দেখায়।’ তিনি পুলিশের ওপর হামলা ও বিচার প্রসঙ্গে বলেন, ‘কাজ করতে গিয়ে আঘাত পেতে পারি, এগুলো জেনেই পেশায় আসি।’