সাবেক উপাচার্যের লেখা থেকে
নব্বইয়ের ডাকসু নির্বাচন ও প্রশাসনের অজানা লড়াইয়ের স্মৃতিকথা
- অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান মিঞা
- প্রকাশ: ১৫ জুলাই ২০২৫, ০৯:২৮ PM , আপডেট: ১৬ জুলাই ২০২৫, ০২:৫২ PM
[ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান মিঞা এই লেখায় তুলে ধরেছেন ডাকসু নির্বাচনের পেছনের অজানা অধ্যায়। এখানে তিনি ১৯৯০ সালের ৬ জুন অনুষ্ঠিত ডাকসু নির্বাচন নিয়ে আলোকপাত করেছেন। যেখানে উঠে এসেছে অনিয়মিত শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণ, প্রশাসনিক চাপে সিদ্ধান্ত পরিবর্তনের কথাও। এ ছাড়াও পরের বছর নির্বাচন স্থগিত হয়ে যাওয়ার বেদনাবিধুর কাহিনি উঠে এসেছে প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতার বয়ানে। এ লেখাটি ২০০৯ সালে প্রকাশিত ‘সৌরভে গৌরবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়’ শিরোনামের বই থেকে সংক্ষিপ্ত আকারে সংকলিত।]
আমি ১৯৯০-এর ২৪ মার্চ থেকে ১৯৯২-এর ৩১ অক্টোবর পর্যন্ত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করি। আমার কার্যকাল খুব দীর্ঘ ছিল না। কিন্তু তার মধ্যেও বিচিত্র সব অভিজ্ঞতা অর্জন করি। আমি ঢাকা থেকে সেনেগালে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত হিসেবে ডিসেম্বর মাসে যোগদান করি। ঐ দেশে অবস্থানের সময় উপাচার্য হিসেবে আমার চোখের সামনে বিশ্ববিদ্যালয়ে ঘটে যাওয়া ঘটনাবলী লেখা আরম্ভ করি। কিন্তু আমার কোনো ডায়েরি ছিল না বলে দিনক্ষণ, সন-তারিখ নিয়ে বিভ্রান্তি হতে থাকে। দেশে ফিরেও আর একবার চেষ্টা করেছিলাম। কিন্তু তাও সফল হয়নি। বিশ্ববিদ্যালয় অ্যালামনাই অ্যাসোসিয়েশনের মহাসচিব রকীবউদ্দীন আহমেদের অনুরোধে আবার লিখতে বসেছি। দীর্ঘদিন গত হওয়ার ফলে এবার আরও অনেক অলঙ্ঘনীয় বাধার সম্মুখীন হচ্ছি। কিন্তু যা যতটুকু মনে আছে তাই সম্বল করে লিখছি। আশা করি সুধীজন বিষয়টা অনুধাবন করবেন।
বিশ্ববিদ্যালয় যাদের সেবাদানের জন্য তারা হলো এর ছাত্রছাত্রীবৃন্দ। সে সময় এদের সংখ্যা ছিল ২৮ হাজার। একদিকে এরা বয়সের কারণে ভীষণভাবে আবেগপ্রবণ, অন্যদিকে এদের বিরাট এক অংশ বাইরের রাজনৈতিক ধ্যানধারণার অনুসারী। এসব তো আছেই তার উপর এও সত্য যে এদের সবরকম চাহিদা, তা যতই ন্যায্য হোক না কেন, তা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ পূরণ করতে পারে না। এদের ব্যক্তিগত চাহিদা পূরণ সম্ভব হবে না। কিন্তু সমষ্টিগত চাহিদা যাতে মেটানো যায় সেজন্য প্রকৃত উপায় হচ্ছে তাদের প্রতিনিধিত্বমূলক ইউনিয়নগুলোর নির্বাচন অনুষ্ঠান করা। ডাকসু এবং হল ইউনিয়নগুলোর প্রায় বছর দেড়েক আগে নির্বাচন হয়েছিল। কিন্তু এ নির্বাচন নিয়ে অনেক প্রশ্ন উত্থাপিত হয় বলে তা কার্যকর হয়নি। আমি প্রশাসনের সুবিধার্থে এগুলোর নির্বাচন অনুষ্ঠানের উদ্যোগ নিলাম। কিন্তু সকলের কাছে গ্রহণযোগ্য নির্বাচন হওয়ার পূর্বশর্ত বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের নিরপেক্ষতা আর ক্যাম্পাসকে অস্ত্রমুক্ত রাখা। আমি জানতাম প্রথমটি আমার ব্যবস্থাপনা নির্ভর, যে সম্পর্কে আমি দৃঢ়প্রতিজ্ঞ ছিলাম। কিন্তু দ্বিতীয়টির জন্য তো সরকারি সাহায্য দরকার। এ ব্যাপারে অবস্থা সে সময় আমার অনুকূল ছিল। একটু খুলে বলি।
তখন প্রধানমন্ত্রী ছিলেন কাজী জাফর, যিনি শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে নিয়োজিত ছিলেন। কাজী জাফর রাজশাহী কলেজে আমার বছর দুয়েক পরের ছাত্র ছিলেন। সে সময় থেকেই আমার সাথে তার যথেষ্ট সুসম্পর্ক ছিল। এছাড়া তৎকালীন পুলিশের আইজি ছিলেন আমার বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে একই বছরের ছাত্র। তার সাথেও আমার সুসম্পর্ক ছিল। ক্যাম্পাসকে অস্ত্রমুক্ত রাখতে পুলিশের সাহায্য ছাড়া কোনো বিকল্প ছিল না। তাদের দিক থেকেও এ সাহায্য দেয়ার ব্যাপারে আগ্রহের কোনো কমতি ছিল না। আমি প্রধানমন্ত্রীর সাথে আলাপ করে আমার সাথে তার এবং আইজিসহ পুলিশের বড় কর্তাদের একটি মিটিং করার ব্যবস্থা নিতে অনুরোধ করলাম। সে আলোচনা হলো এবং তা ইলেক্ট্রনিক প্রচার মাধ্যমে প্রচার করা হলো। আমার উদ্দেশ্য ছিল এই যে আমি কি করছি তা যেন প্রকাশ্যে হয় যাতে এ নিয়ে কোনো কথা না ওঠে। আমার বিশ্বাস ছিল টেলিভিশনে আমার এসব প্রচেষ্টা দেখলে গুটিকয় ছাত্র ছাড়া বাকি সকলে খুশি হবে আর অভিভাবকরাও আশ্বস্ত হবেন। আমার সঙ্গে খুব সম্ভবত প্রক্টর ও প্রভোস্টরাও ছিলেন। আমার বক্তব্য ছিল একটাই, তা এই যে আমি ক্যাম্পাস পুরোপুরি অস্ত্রমুক্ত রাখতে চাই যাতে নির্বাচনকে ঘিরে কোনোরূপ আইন-শৃঙ্খলার অবনতি না ঘটে। এ বিষয়ে অপরপক্ষের আগ্রহের কোনো কমতি আমি দেখিনি। এদিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসন এবং প্রশাসনিক পদ্ধতি যাতে স্বচ্ছ এবং সম্পূর্ণ নিরপেক্ষ থাকে সে বিষয়ে সম্ভাব্য সবরকম ব্যবস্থা নেয়া হলো। আমি সংবাদপত্রের সম্পাদক মহোদয়দের ব্যক্তিগতভাবে চিঠি দিয়ে এই অনুরোধ জানালাম যে তারা যদি ইচ্ছে করেন তাহলে নির্বাচনের দিন আমাদের ব্যবস্থাপনা সশরীরে এসে দেখে যান। তাদের সংবাদদাতা/প্রতিবেদকরা তো থাকবেনই। অবশ্য সম্পাদক মহোদয়রা কেউই আসেননি। সম্ভবত এই কারণে যে তারা তাদের সংবাদদাতাদের মাধ্যমে ক্যাম্পাসে কি ঘটছে তা জানতেন। নির্বাচন শেষে সংশ্লিষ্ট সকলে এমন মতামত প্রকাশ করলেন যে ডাকসু এবং হল ইউনিয়ন নির্বাচন অত্যন্ত শান্ত, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষভাবে অনুষ্ঠিত হয়েছে। ঢাকায় অবস্থিত মাননীয় মার্কিন রাষ্ট্রদূত দ্য প্রি রোটারি বা লায়ন্স ক্লাবে এক বক্তৃতায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অনুষ্ঠিত ডাকসু নির্বাচনের কথা উল্লেখ করে বললেন যে যদি প্রশাসন চায় তাহলে নিরপেক্ষ নির্বাচন হওয়া সম্ভব তা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রমাণ করেছে। তার এ উক্তি কোনো এক ইংরেজি পত্রিকা সম্ভবত The Daily Star-এ প্রকাশিত হয়।
উপরের অংশের পাঠকদের মনে হতে পারে যে নির্বাচন হয়ত কোনো ঝুটঝামেলা ছাড়াই সম্পন্ন হয়েছিল। কিন্তু ছাত্রছাত্রীদের অংশগ্রহণে নির্বাচন হবে আর উপাচার্যকে ওরা নিশ্চিন্তে ঘুমাতে দেবে তা তো হয় না। আমাকেও অন্তত দুটো প্রায় অচলাবস্থার সম্মুখীন হতে হয়েছিল। প্রথমটি হলো যারা বিশ্ববিদ্যালয়ে এক সময়ে ছাত্র ছিল কিন্তু তখন আর ছাত্র নয় তাদের নির্বাচনে প্রার্থী হিসেবে দাঁড়াবার অধিকার নিয়ে। বিশ্ববিদ্যালয়ের বেশিরভাগ শিক্ষক, বিশেষ করে যারা প্রশাসনিক দায়িত্বে নিয়োজিত ছিলেন তারা এর ঘোর বিরোধী ছিলেন। আমার অবস্থানও তাই ছিল। কিন্তু বুড়ো খোকাদের পক্ষ এ নিয়ে আন্দোলন করতে থাকল এবং ওরা এ বিষয়ে ছিল একাট্টা। একদিন ওদের মধ্যে একজন (নাম বলছি না) ডাকসু অফিস থেকে আমাকে টেলিফোনে যা বলল তা এরকম: আপনি তো সরকারের ব্রিফ নিয়ে এখানে ‘দালালি’ করতে এসেছেন। আপনি চাচ্ছেন ডাকসুতে ঐসব দুগ্ধপোষ্য শিশুদের দিয়ে নির্বাচন করতে যারা আপনার সব কথা নির্বিবাদে মেনে নেবে আর সরকার মহানন্দে কাল কাটাবে। এসব কথা বলে ওরা দাবি জানাল যে আমি যদি ওদের নির্বাচনে অংশগ্রহণের দাবি মেনে না নেই তাহলে নির্বাচন হতে দেবে না।
ডাকসু নির্বাচনে বাধা
আমি বিষয়টি নিয়ে ডীন-প্রভোস্ট-প্রক্টর ও নির্বাচন পরিচালনা পর্ষদের সাথে আলোচনা করলাম। আমি লক্ষ করলাম যে নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য সকলেই দৃঢ়তা ব্যক্ত করছেন। ওদের দাবির ব্যাপারে কেউ কেউ কিছুটা নমনীয় ভাব ব্যক্ত করলেন যে স্বল্পমেয়াদি কোন সার্টিফিকেট/ ডিপ্লোমা জাতীয় কোর্সে প্রত্যেক ছাত্র সংগঠনের ১/২ জন করে ভর্তি করলে যদি সমস্যার সমাধান করা যেতে পারে। আমার মূল্যায়নও এরকম ছিল যে ওদের নির্বাচন করার সুযোগ না দিলে নির্বাচন হতে দিবে না। অপরপক্ষে আমি নির্বাচন অনুষ্ঠান করার জন্য দৃঢ় প্রতিজ্ঞ ছিলাম।
আমরা মোটামুটি মাস কয়েকের যেসব সার্টিফিকেট বা ডিপ্লোমা কোর্স আছে সেসব জায়গায় তাদের সুযোগ দিয়ে নির্বাচন করে নেয়া যেতে পারে এমন সিদ্ধান্ত নেয়ার কথা ভাবলাম। অবশ্য এ ব্যাপারে পুষ্টি ও খাদ্যবিজ্ঞানের শিক্ষকবৃন্দ ঘোর আপত্তি জানালেন। আমি তাদেরকে অনুনয়-বিনয় করে কোনোরকমে রাজি করালাম।
কিন্তু আর একটি বিপত্তি আসলো সেই ছাত্রী মিছিলে হামলা তদন্ত নিয়ে। এই ফাইলটি আমি দেখেছিলাম। প্রকৃতপক্ষে ঐ সময়ে এ বিষয়ে কিছু করার ছিল না। কিন্তু এর সাথে যেহেতু রাজনীতি জড়িত ছিল তাই প্রশাসনের যেকোনো দুর্বল অবস্থান সেখানে তো আঘাত করতেই হবে।
একদিন মেয়েদের একটি হল সম্ভবত শামসুন্নাহার হল পরিদর্শনের সময় আমি ভীষণ বিব্রতকর অবস্থায় পড়লাম। ওখানকার ছাত্রীরা তাদের হলের প্রধান ফটক বন্ধ করে দিল যাতে আমি ওখান থেকে না বেরুতে পারি। দীর্ঘক্ষণ আমি এবং হল প্রশাসনের প্রায় সকলে মেয়েদের সাথে এ নিয়ে দেনদরবার করতে থাকলাম। কিন্তু না, কিছুতেই কিছু হয় না। আমি তখন চুপচাপ বসে থেকে তাদের ধৈর্য পরীক্ষা করতে থাকলাম আর কি। এক পর্যায়ে ওরা ক্লান্ত হয়ে এদিক-ওদিক গেল। ঐ সময়ে দারোয়ানকে ডেকে গেট খুলে ঝট করে বেরিয়ে পড়লাম।
নির্বাচন ঘিরে আর একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা ঘটেছিল। একদিন দুপুরের দিকে আমি লাঞ্চ করার জন্য বাসায় যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছি। এমন সময় খবর পেলাম ছাত্রদলের মনোনীত প্রার্থী আমান-খোকনকে মাথায় পিস্তল ধরে রেখে কে বা কারা নাকি তাদের মনোনয়ন প্রত্যাহার করার জন্য চাপ নিচ্ছে। ঘটনাটি ঘটেছিল মধুর ক্যান্টিনে। আমি দুর্ঘটনার আশঙ্কায় ভীষণভাবে শঙ্কিত হলাম। তখন আমার কাছে কোনো প্রক্টর, প্রভোস্ট বা কোনো শিক্ষকও ছিলেন না। আমি গাড়িতে উঠে একাই মধুর ক্যান্টিনে চলে গেলাম। ওখানে গিয়ে আমি কারও হাতে কোনো ছোট বা বড় কোনো আগ্নেয়াস্ত্র দেখিনি, যদিও শুনেছি আমি গাড়ি থেকে নামবার সময় নাকি ওগুলো লুকিয়ে ফেলা হয়েছিল। তবে দেখলাম আমান-খোকনদের মাথায় পানি ঢালা হচ্ছে। বুঝলাম আমি যা শুনেছিলাম তা ঠিক ছিল। আমি গাড়ি থেকে নেমে উঁচু গলায় বললাম কি হচ্ছে এসব। কে ডাকসু'র প্রার্থী হবে তোমাদের সে বিষয়ে আমার কোনো বক্তব্য নেই। তবে আমি ক্যাম্পাসে কোনোরকম অস্ত্রবাজি হতে দেব না। আর যদি তা হয় এবং কেউ কাউকে শারীরিকভাবে নির্যাতন করে তাহলে তা আমি মেনে নেব না এবং আমি যেকোনো ব্যবস্থা নিতে বাধ্য হবো। নির্বাচনকে ঘিরে আমি ক্যাম্পাসে কোনোরকম বিশৃঙ্খলা সহ্য করব না। আমার অস্বাভাবিক জোর গলায় কথা বলায় কাজ হলো। ঐদিন যদি ঐ ঘটনাটা ঘটত তাহলে আর নির্বাচন হতো না। যা হোক নির্বাচন যে সুষ্ঠুভাবে হয়েছিল একথা আগেই বলেছি।
ছাত্রদের মধ্যে সংঘাত ও ডাকসু নির্বাচন স্থগিত ঘোষণা
প্রায় এক বছর যাবত শান্তির যে সুবাতাস বিশ্ববিদ্যালয় অঙ্গনে বইছিল তাতে ছেদ পড়ায় সন্দেহ নেই আমি কিছুটা চিন্তিত হই। অনেকের ধারণা ক্যাম্পাসের ঘটনা ঐ সময়ের জাতীয় রাজনীতি থেকে কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা ছিল না। কারণ যাই হোক তার রেশ কিন্তু চলতে থাকে বিভিন্নভাবে। আবার লক্ষ করা যায় যে ডাকসু নির্বাচনের সময় যতই এগিয়ে আসতে থাকল বিভিন্নরূপে সন্ত্রাস ততই বাড়তে থাকল। বিভিন্ন জনের মত থেকে এমন মনে করার যথেষ্ট কারণ ছিল যে যারা পরবর্তী ডাকসু নির্বাচনে জিতবে না ভাবছে তারাই ক্যাম্পাস পরিস্থিতি অশান্ত করে তুলছে। নির্বাচনের প্রাক্কালে সন্ত্রাস ভয়ংকর রূপ নেয়। ঐ সময়ে প্রক্টরের পুত্রকে প্রহার, উপাচার্য, উপ-উপাচার্য, ও নির্বাচন কমিশনারের কার্যালয় ভাঙচুর, শামসুন্নাহার হলের সামনে গুলি ও বোমাবর্ষণ, কয়েকদিন পর পুনরায় উপাচার্যের সেক্রেটারির অফিস ভাঙচুর, প্রভোস্ট, শিক্ষক, অফিসারদের বাসায় ও ছাত্রীদের হলে অস্ত্রধারীদের প্রবেশ ও ভীতি প্রদর্শন, বিডিআরের গাড়ির উপর আক্রমণ এবং সর্বোপরি দুটি ছাত্র সংগঠনের মধ্যে তিন ঘণ্টাব্যাপী গোলাগুলি হয়। এ পটভূমিতে ডাকসু নির্বাচন তো বন্ধ ঘোষণা করতে হলো এবং নিরুপায় হয়ে বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ ঘোষণা করতে হয়, যা উপাচার্য হিসেবে আমার জন্য সবসময়ে ছিল মর্মপীড়ার কারণ। আর সেই যে ডাকসু নির্বাচন বন্ধ হলো তা আজ পর্যন্ত (সেপ্টেম্বর ২০০৯) আর অনুষ্ঠিত হয়নি।
১৭ মার্চ বসুনিয়া তোরণ ও দেলোয়ার তোরণের মধ্যবর্তী নীলক্ষেত রোডে যে গোলাগুলি আরম্ভ হয় তার রেশ কিন্তু চলতে থাকে। আমি উপাচার্য পদে দায়িত্ব গ্রহণ করার পরের এক বছর ক্যাম্পাসে ছাত্র সংগঠনগুলোর মধ্যে কোনো অস্ত্রের সংঘাত হয়নি। কিন্তু এও ঠিক যে বিচারপতি শাহাবুদ্দীন আহমদের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের তিন মাস শাসনকাল ব্যতীত অন্য সব সময় সংগঠনগুলোর মধ্যে বৈরী ভাব বিরাজমান ছিল। ১৭ মার্চ-এর পর তাদের সম্পর্ক আবারও সংঘাতের দিকে এগোচ্ছিল। বিষয়টি আমি আঁচ করতে পারছিলাম। কিন্তু কি পদ্ধতি নিলে তা নিরসন করা যেতে পারে তা আমাকে চিন্তিত করছিল। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বিভিন্ন সময়ে ছাত্রদের গুলিবিদ্ধ হয়ে মৃত্যু চোখের সামনে অনেক দেখিছি। এসব সম্ভাবনাময় তরুণদের অপঘাতে জীবনাবসান আমাকে ভীষণ ব্যথিত করত। আমার সব সময় মনে হতো আমার স্কুল জীবনের আমাদের এক শিক্ষকের কথা, যিনি আমাদের রচনা লিখতে শিখাতেন। তিনি একদিন ছাত্র-ধর্মঘট বিষয়ে রচনা লিখতে বললেন। বিষয়টির বিভিন্ন দিক তিনি তুলে ধরছিলেন ক্লাসে। তিনি এক পর্যায়ে বললেন 'গাঁজা খায় অনেকে। কিন্তু গুলি খেতে পারে কেবল ছাত্ররাই'। এই গুলি খাওয়া আর গাঁজা-গুলির গুলির মধ্যে তফাত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হয়ে বুঝেছি। তাই একজন ছাত্রের গুলি খেয়ে মৃত্যু আমার কাছে ছিল ‘One death too many’ ভীষণ বেদনাদায়ক।
অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান মিঞা: শিক্ষাবিদ, সাবেক উপাচার্য, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়