ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়: আমরা যেমন দেখেছি
- শ্রীমতি কল্যাণী কর
- প্রকাশ: ১৫ জুলাই ২০২৫, ০৮:৪৪ PM , আপডেট: ০৯ আগস্ট ২০২৫, ০২:১৮ PM
[কল্যাণী কর সরকার ১৯৩৭-৩৮ শিক্ষাবর্ষে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি বিভাগে সম্মানের ছাত্রী হিসেবে ভর্তি হন। তার পিতার নাম তারানাথ সরকার এবং পৈত্রিক নিবাস ঢাকার নায়ায়ণগঞ্জে। তার অনুষঙ্গী বিষয় দুটি ছিল অর্থনীতি ও সংস্কৃত। এখানে তার স্মৃতিচারণায় উঠে এসেছে তৎকালীন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার অভিজ্ঞতা। এটি ২০০৯ সালে প্রকাশিত ‘সৌরভে গৌরবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়’ সংকলন থেকে সংগৃহীত।]
নবাগতার কণ্ঠী নিয়ে যেদিন প্রথম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রবেশ করেছিলাম সেদিনের কথা মনে পড়ে। মিনার-গম্বুজ শোভিত বিশাল ভবনের ভেতরে দীর্ঘ করিডোর পেরিয়ে যেতে দুরু দুরু করছিল বুক। একপ্রান্তে ছিল মেয়েদের কমনরুম রুদ্ধশ্বাসে পেরিয়ে এসে ঘরে ঢুকে যেন স্বস্তির নিশ্বাস ফেললাম। ক্লাসের ঘণ্টা যখন বাজল, আমরা বেরিয়ে এলাম কমনরুম ছেড়ে। অদূরে অধ্যাপক দাঁড়িয়ে। তার পেছন পেছন গিয়ে আমরা ক্লাসে ঢুকলাম।
একপাশে মেয়েদের জন্য নির্দিষ্ট সিটে বসলাম এবং ক্লাসের শেষে আবার অধ্যাপকের পেছনে বেরিয়ে এলাম। এই ছিল তখনকার রীতি। করিডরের প্রবেশ পথে ছিল প্রক্টর মহোদয়ের কড়া পাহারা। ছাত্র ও ছাত্রীদের পরস্পরের সঙ্গে কথা বলা নিষিদ্ধ ছিল। কেবল নির্বাচন ইত্যাদি ব্যাপারে ছাত্ররা ছাত্রীদের সঙ্গে কথা বলার সুযোগ পেত। তাও প্রক্টর মহাশয়কে স্লিপ দিয়ে প্রয়োজন জানিয়ে নির্দিষ্ট সময়ের জন্য কথা বলার অনুমতি লাভ করতে হতো। এমনই সব হাস্যকর ব্যবস্থা ছিল তখনকার দিনে। ঢাকার মতো প্রগতিশীল বিশ্ববিদ্যালয়েও এ রকম ব্যবস্থা তার থেকে তখনকার সমাজের অবস্থাটা অনুমান করা যায়।
১৯৩৭ সালে আমরা প্রায় ২০ জন ছাত্রী বিএ ক্লাসে ভর্তি হয়েছিলাম। তারপর থেকে প্রতিবছর ছাত্রী সংখ্যা বেড়ে চলেছিল। রমনার শান্ত জনবিরল পথ, ধারে ধারে দেবদারু, ঝাউ, কৃষ্ণচূড়া, বোগেনাভিলায় আবীর ছড়ানো। সে পথের একাধারে ছাত্রীনিবাস। আমাদের আগের বছর ৩/৪ জন ছাত্রী ছিল সেখানে সেখানে আমরা হলাম ৯/১০ জন। পরে ছাত্রী সংখ্যা আরও বেড়ে যাওয়াতে ছাত্রীনিবাস বদল করে আমরা 'চামেরী হাউসে' যাই। ছাত্রীনিবাসটি আমার কী রকম সরগরম করে তুলতাম আমাদের কলকাকলীতে, হাসিগানে, খেলাধুলায়- আমাদের নির্মল আনন্দ প্রকাশের সেই স্মৃতি এখনও আমাকে আনন্দ দেয়।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে যে কী নিবিড় সম্বন্ধ ছিল, তা বিশেষ করে বুঝতে পারি এখন। ঢাকার কোনো প্রাক্তন ছাত্রছাত্রীকে দেখলেই মনে হয় কত আপনজন, কত আত্মীয়তার বন্ধন তাদের সঙ্গে। আমরা ঢাকায় কিছু জ্বালাতনও করেছি কর্তৃপক্ষকে। তারই একটা ঘটনা মনে পড়তেই কৌতুকবোধ করছি। ছাত্রীনিবাসে যাওয়ার কিছুকাল পরেই ঘটনাটা ঘটেছিল। তখন কোন সিনেমা হলে ‘দিদি’ ছবিটি দেখানো হচ্ছে। শুনলাম ছবিটা খুব ভালো হয়েছে। যাওয়ার প্ল্যান করে আমরা হোস্টেল কর্তৃপক্ষের অনুমতি চাইলাম। কিন্তু তিনি অনুমতি দিতে রাজি হলেন না। কারণ, ওটাতে নাকি অশ্লীল কিছু রয়েছে। আমরা তো আশাভঙ্গে বিরস মুখে বসে আছি। নিজেদের অধিকার সম্বন্ধে সচেতন হইনি তখনও! কিন্তু সিনিয়র ছাত্রীরা বলল এটা আমাদের অপমান! আমাদের এখন ভালো-মন্দ বোঝার বয়স হয়েছে। আমরা এর প্রতিবাদ জানাতে চাই!
সবাই মিলে সিনেমায় যাবার জন্য তৈরি হলাম। যথারীতি দারোয়ানকে পাঠিয়ে ঘোড়ার গাড়ি ডাকা হলো। সিনিয়র ছাত্রীরা এগিয়ে গেল। দুম্মখের কাজের ভার পড়ল আমাদের ফার্স্ট ইয়ারের দুজনের ওপর। আমরা দুজন তো দুরু দুরু বুকে গেলাম। কারণ একটু নিরীহ গোবেচারী ছিলাম তখন। আমরা বলতেই সুপারিন্টেন্ডেন্টের মুখ আষাঢ়ের আকাশের মতো থমথমে হয়ে উঠল। তিনি বোধহয় এরকম আশঙ্কা করতে পারেন নি।
যাহোক ছবিটা যতক্ষণ দেখলাম বেশ আনন্দেই কাটল। অশ্লীল কি ছিল তাও মনে পড়ে, নায়িকা হোস্টেলের পাঁচিল ডিঙ্গিয়ে নায়কের সঙ্গে পালিয়ে গিয়েছিল। ফেরার পথে সবাই মনে মনে ভাবছি এরপর কী হবে? মুখ ফুটে অবশ্য কিছু বলিনি। সেদিন কিন্তু কিছুই হলো না। আমাদের অগোচরে যা হয়েছিল তা টের পেলাম পরদিন। ভাইস চ্যান্সেলরের চিঠি এলো আমাদের প্রত্যেকের নামে। অভিভাবকদের কাছে আমাদের শৃঙ্খলাভঙ্গের অপরাধ জানিয়ে চিঠি দেওয়া হচ্ছে। এ ব্যাপারে অবশ্য এখানেই শেষ।
আমি যখন ছাত্র ছিলাম, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তখন ছিল স্বর্ণযুগ। বহু খ্যাতনামা অধ্যাপকের সমাবেশে সমৃদ্ধ। আমাদের কৈশোরের অপরিণত মন কল্পনার মনীষীদের চোখের সামনে দেখে বিস্ময়ে অভিভূত হতো। আচার্য্য সত্যেন্দ্রনাথ বসু ও আচার্য্য জ্ঞানচন্দ্র ঘোষের মতো ব্যক্তিকে চোখের সামনে দেখার কল্পনাও করিনি কখনও। মনে হতো যারা এদের ছাত্র তারা কী ভাগ্যবান। ভাগ্যচক্রে আমার স্বামী ছিলেন তাদের দুজনেরই প্রিয় ছাত্র। তার কাছে শুনেছি এবং পরবর্তী জীবনে দেখেছি প্রাক্তন ছাত্রদের প্রতি তাঁদের কী গভীর স্নেহ। তখন তাঁদের কাছ থেকে দেখার সৌভাগ্য অনেকবারই হয়েছিল। এটা লিখতে লিখতেই দুঃসংবাদ পেলাম সত্যেন্দ্রনাথ বসু আর ইহলোকে নেই। তাঁর মৃত্যুতে বিজ্ঞানের কী ক্ষতি হয়েছে তার মূল্য নির্ণয় করবেন বিজ্ঞানীরা। কিন্তু আমার মনে হয় দেশ একজন মহামানবকে হারিয়েছে। হারিয়েছে একজন অসাধারণ দরদি মানুষকে।
আমাদের অধ্যাপকদের মধ্যে প্রথমেই মনে পড়ে শ্রদ্ধেয় প্রফুল্ল কুমার গুহর কথা। তিনি আমাদের ইংরেজি অনার্স ক্লাসে যখন ‘হ্যামলেট’ পড়াতেন, তখন মুগ্ধ হয়ে শুনতাম। গম্ভীর কণ্ঠস্বর, কী অর্থপূর্ণ অভিব্যক্তি। তার বর্ণনায় তাঁর বাচনভঙ্গীতে যেন নাটকের পরিবেশ সৃষ্টি করে তুলতেন ।
অনেক সময় তিনি রেকর্ড নিয়ে এসে ক্লাসে বাজিয়ে শোনাতেন, হয়ত হ্যামলেটের স্বগতোক্তি, হয়ত বা অন্যকিছু। তাতে মনের উপর গভীর রেখাপাত করত। বহুসংখ্যক ছাত্র সম্বলিত পাশ ক্লাসেও যখন তিনি পড়াতেন, শুনেছি ছাত্ররা অভিভূত হয়ে শুনত। তারপরেই মনে পড়ে সংস্কৃত ক্লাসের কথা। শ্রদ্ধেয় প্রবোধকুমার লাহিড়ীর ক্লাস। তিনি পড়াতেন ‘অভিজ্ঞান শকুন্তলম’। ইন্টারমিডিয়েট ক্লাসেও সংস্কৃত কাব্য কিছু কিছু পড়েছি। কিন্তু তিনি যেমনভাবে পড়াতেন তেমনভাবে তো কখনও পড়িনি। সংস্কৃত সাহিত্যের রসকে নিবিড়ভাবে উপলব্ধি করলাম তাঁরই ক্লাসে। তারই সাহিত্যালোচনার সরস ভঙ্গিতে সংস্কৃত সাহিত্যের প্রতি আমার যে অনুরাগ জন্মেছিল আজও অক্ষুণ্ন রয়েছে। তার উৎসাহে ও প্রেরণায় আমার ছাত্রজীবনের শেষেও আমি সংস্কৃত সাহিত্য নিয়ে আলোচনা করতে উৎসাহিত হয়েছি।
আমাদের সময়েই ছাত্রীসংঘ প্রথম বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের অনুমোদন লাভ করে। এবার আমাদের একটা মুখপত্র বের করার কথা হয়। কিন্তু ৭০/৭৫ জন ছাত্রীর মধ্যে থেকে একটা সাহিত্য পত্রিকা প্রকাশ করা সম্ভবপর হবে কিনা সে বিষয়ে যথেষ্ট সন্দেহ ছিল। তখন আমাদের উৎসাহের আতিশয্যে, যারা কিছুটা লিখতে পারতাম, তারা এক একজনই দুটো তিনটা লেখা দিয়ে বসলাম নামে-বেনামে। যাহোক, অধ্যাপকের কয়েকটা রচনা এবং আমাদের অপরিণত লেখনীর রচনা নিয়েই পত্রিকাটা প্রকাশ হলো।
কবি মোহিতলাল পত্রিকার নামকরণ করেন ‘সুপর্ণা’। ‘সুপর্ণা’ তৃতীয় সংখ্যা সম্পাদনার ভার পড়ে আমার উপর। সেই সময় শ্রদ্ধেয় মোহিতলাল মজুমদার, শ্রদ্ধেয় আশুতোষ ভট্টাচার্য, শ্রদ্ধেয় শ্রীশ দাস এদের অকুণ্ঠ সাহায্য পেয়েছিলাম। এরা রচনা নির্বাচন করে এবং নিজেদের রচনা দিয়ে ছাত্রছাত্রীদের পত্রিকা প্রকাশে সব সময়ই সাগ্রহ সাহায্য করতেন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বিদ্যাচর্চায় যে কোনো ত্রুটি ছিল না, তার প্রমাণ তখনকার ছাত্র, অধ্যাপক সকলেই অন্যত্র আজ সুপ্রতিষ্ঠিত। বহু যশঃসম্মানের অধিকারী হয়েছেন অনেকেই। কিন্তু এই শিক্ষা ও পরীক্ষার একঘেয়েমির ক্লান্তি দূর করে সেখানে সারাক্ষণ যেন উৎসবের বাঁশি বেজেই চলত। একের পর এক উৎসবে ছাত্রদের অফুরন্ত প্রাণশক্তি বিচিত্ররূপে বিশ্ববিদ্যালয়ের জীবনতকর শাখায় শাখায় রস সঞ্চার করত। সমস্ত ছাত্র ও অধ্যাপকদের এ যে সম্মিলিত আনন্দোৎসব তাতেই পরস্পরের নৈকট্য ও সৌহার্দ্য এনে দিত; আজ পর্যন্ত ঢাকার প্রাক্তন ছাত্রছাত্রীদের ও প্রাক্তন অধ্যাপকদের মধ্যে এ নিবিড় আত্মীয়তাবোধে তারই পরিচয় মেলে।
সুদীর্ঘকাল হলো ঢাকা ছেড়ে এসেছি। কিন্তু আমাদের যৌবনের স্মৃতি এখনও ঘুরে বেড়ায় রমনার শান্ত নির্জন পথে পথে, সবুজ ঘাসে, সুনীল আকাশের গায়ে; পাখির কাকলিতে, বৃষ্টির ঝরঝরানিতে বাজে পুরানো দিনের গান। বিশ্ববিদ্যালয়ের কক্ষে কক্ষে করিডোরে লাইব্রেরিতে আমাদের পুরানো দিনের স্বপ্ন কখনও কখনও পাখা ঝাপটে ওঠে। ওরা এখনও যেন আমাদের হাতছানি দিয়ে ডাকে। ইচ্ছে হয় একবার ফিরে যাই ওদের মাঝে। ওরা কি চিনতে পারবে না আমাদের? প্রীতিভরা নীরব সুরে কিছু বলে কি আহ্বান জানাবে না? থাক, স্বপ্ন তবে স্বপ্ন হয়েই থাক!
সূত্র: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় অ্যালামনাই অ্যাসোসিয়েশন কর্তৃক ২০০৯ সালে প্রকাশিত ‘সৌরভে গৌরবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়’ প্রথম খন্ড থেকে নেওয়া