বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি কোচিংয়ে ঢাকায় একজন শিক্ষার্থীর খরচ কত?
- নবাব আব্দুর রহিম
- প্রকাশ: ৩০ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ১০:৫২ AM , আপডেট: ৩০ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ১১:২৭ AM
এইচএসসি পরীক্ষা শেষ হতেই উচ্চশিক্ষার স্বপ্ন চোখে নিয়ে রাজধানীমুখী হচ্ছেন দেশের বিভিন্ন প্রান্তের ভর্তিচ্ছু শিক্ষার্থীরা। বিশ্ববিদ্যালয়ে সুযোগ পাওয়ার আশায় ঢাকার কোচিং সেন্টারগুলোতে শুরু হয়ে গেছে ভর্তি প্রস্তুতির জোর প্রস্তুতি। চলতি সেপ্টেম্বরের শুরুতেই ফার্মগেটসহ প্রধান এলাকাগুলোর প্রায় সব কোচিংয়ে চালু হয়েছে ক্লাস। উচ্চশিক্ষায় প্রবেশের স্বপ্নে বিভোর শিক্ষার্থীদের ভর্তি কোচিংয়ে পা রাখতেই গুনতে হচ্ছে বড় অঙ্কের টাকা। তবে এখানেই থেমে থাকছে না খরচের হিসাব। পরীক্ষার দিন পর্যন্ত প্রতিনিয়ত আবাসন, খাবার, যাতায়াত, বইপত্রসহ নানা খাতে বাড়ছে ব্যয়। সবমিলিয়ে একজন শিক্ষার্থীর গড় খরচ গিয়ে ঠেকছে ৬০ থেকে ৭৫ হাজার টাকার ঘরে।
জানা গেছে, গত ২১ থেকে ৩১ আগস্ট পর্যন্ত ব্যবহারিক পরীক্ষার মধ্য দিয়ে শেষ হয় এইচএসসির চূড়ান্ত পরীক্ষা। এরপর থেকেই ঢাকামুখী হতে থাকেন ভর্তিচ্ছু শিক্ষার্থীরা। ৬ সেপ্টেম্বর থেকেই রাজধানীর প্রায় সব কোচিং সেন্টারে ক্লাস শুরু হয়। শিক্ষার্থীরা বলছেন, ভর্তি পরীক্ষার সময় নির্ধারিত না থাকায় কেউ কেউ দীর্ঘদিন কোচিংয়ে থাকতে বাধ্য হচ্ছেন, ফলে খরচও বাড়ছে।
চলতি বছর মেডিকেল কলেজের এমবিবিএস ভর্তি পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়েছে ১৭ জানুয়ারি এবং বিডিএস পরীক্ষা ২৮ জানুয়ারি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষাও সাধারণত জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারিতে অনুষ্ঠিত হয়। আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনের শিডিউল ফেব্রুয়ারিতে পড়ায় এবার মেডিকেল ভর্তি পরীক্ষা ডিসেম্বরেই হতে পারে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে। তবে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষার দিন এখনও চূড়ান্ত হয়নি। নির্বাচনের কারণে তা এগিয়ে আসা বা পিছিয়ে যাওয়ার সম্ভাবনাও রয়েছে।
ভর্তি প্রস্তুতির সবচেয়ে বড় দুটি খরচের খাত হলো কোচিং ফি ও আবাসন। পাশাপাশি বইপত্র, ফটোকপি, যাতায়াত, পরীক্ষা ফি ও নানা আনুষঙ্গিক খরচ যুক্ত হলে খরচের পরিমাণ অনেক বেশি দাঁড়ায়।

রাজধানীর ফার্মগেট এলাকার সরেজমিনে বিভিন্ন কোচিং সেন্টার ঘুরে জানা গেছে, শিক্ষার্থীরা একাধিক ব্যাচে কোচিংয়ে ভর্তি হয়েছেন। কোচিংগুলোতে নির্ধারিত কোর্স ফি ছাড়াও কিছু ক্ষেত্রে বিশেষ ছাড়ে শিক্ষার্থী ভর্তি নেওয়া হচ্ছে।
ইউসিসি কোচিংয়ের পরিচালক মো. কামাল উদ্দিন পাটওয়ারী দ্য ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, অনলাইনে কোচিং সুবিধা সহজলভ্য হওয়ায় ঢাকামুখী শিক্ষার্থীর সংখ্যা আগের তুলনায় কমেছে। এছাড়া এইচএসসির কিছু বিষয়ের প্রশ্নপত্র কঠিন হওয়ায় আত্মবিশ্বাস হারিয়ে অনেক শিক্ষার্থী এখনও ভর্তি প্রস্তুতি শুরু করেননি। ইউসিসিতে বিজ্ঞান, ব্যবসায় শিক্ষা ও মানবিক শাখায় কোর্স ফি ধরা হয়েছে ১৮ হাজার টাকা, তবে প্রায় ৩ হাজার টাকা ছাড়ে ১৫ হাজার টাকায়ও ভর্তি নিচ্ছে প্রতিষ্ঠানটি।
রাজধানীর প্যারাগন কোচিং সেন্টারে মানবিক শাখায় ভর্তি কোর্স ফি নির্ধারণ করা হয়েছে ১৬ হাজার ৫০০ টাকা এবং ব্যবসায় শিক্ষা শাখায় ১৮ হাজার ৫০০ টাকা। তবে প্রতিষ্ঠানটি প্রায় তিন থেকে চার হাজার টাকা পর্যন্ত ছাড়ে শিক্ষার্থী ভর্তি নিচ্ছে। আর্থিকভাবে অস্বচ্ছল শিক্ষার্থীদের জন্য বরাদ্দ রাখা হয়েছে বিশেষ ডিসকাউন্ট।
অন্যদিকে স্কলার্স কোচিং সেন্টারে ব্যবসায় শিক্ষা শাখায় কোর্স ফি ধরা হয়েছে ২০ হাজার এবং মানবিক শাখায় ১৬ হাজার টাকা। তবে এখানেও রয়েছে উল্লেখযোগ্য ছাড়—ব্যবসায় শিক্ষা বিভাগে সর্বোচ্চ ৮ হাজার এবং মানবিক বিভাগে সর্বোচ্চ ৬ হাজার টাকা পর্যন্ত ডিসকাউন্ট দিচ্ছে প্রতিষ্ঠানটি।
এদিকে ইউনিএইড কোচিং সেন্টারে ব্যবসায় শিক্ষা শাখার কোর্স ফি ৮ হাজার এবং মানবিক শাখায় ৭ হাজার টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে। প্রতিষ্ঠানটির দাবি, ভর্তি হওয়া শিক্ষার্থীদের বড় একটি অংশই ডিসকাউন্ট মূল্যে কোর্সে অংশ নিচ্ছেন।
বিজ্ঞান শাখাভিত্তিক কোচিংয়ের মধ্যে উদ্ভাস ও বন্দি পাঠশালায় শুধুমাত্র বিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থীদের ভর্তি নেওয়া হচ্ছে। উদ্ভাস কোচিংয়ে সাধারণ বিজ্ঞান কোর্সের ফি ধরা হয়েছে ২২ হাজার টাকা, তবে ডিসকাউন্টের সুবিধা দিয়ে শিক্ষার্থী ভর্তি নেওয়া হচ্ছে। ইঞ্জিনিয়ারিং কোর্সের জন্য উদ্ভাসে কোর্স ফি ২৪ হাজার টাকা নির্ধারণ করা হলেও, ৪ হাজার টাকা পর্যন্ত ছাড়ে ভর্তি নেওয়া হচ্ছে। মেডিকেল কোচিংয়ে উদ্ভাসের সহ-প্রতিষ্ঠান উন্মেষেও একই ধরনের ব্যবস্থা রয়েছে; কোর্স ফি ২৪ হাজার, তবে শিক্ষার্থীরা ডিসকাউন্টে ভর্তি হচ্ছেন।

রেটিনা কোচিংয়ে মেডিকেল প্রস্তুতির জন্য কোর্স ফি ২৫ হাজার টাকা নির্ধারণ করা হলেও, প্রায় ১৫০০ টাকা ছাড়ে ভর্তি নেওয়া যাচ্ছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রস্তুতি কোচিংসহ একজন শিক্ষার্থীর মোট কোর্স ফি দাঁড়ায় ৩৩ হাজার টাকা, তবে বিশেষ ছাড়ে এটি কমে ৩২ হাজার টাকায় পড়ছে।
নার্সিং কোচিংয়ে কর্নিয়া কোচিংয়ে বিএসসি ইন নার্সিং কোর্সের ফি ধরা হয়েছে ১৭ হাজার, আর ডিপ্লোমা ইন নার্সিং ও মিডওয়াইফারি কোর্সের জন্য ১৬ হাজার টাকা। নিউরন কোচিংয়ে বিএসসি কোর্সের ফি ১৮ হাজার এবং ডিপ্লোমা কোর্সে ১৭ হাজার টাকা। এই প্রতিষ্ঠানগুলোতেও প্রায় ৩ হাজার টাকার ডিসকাউন্টে শিক্ষার্থী ভর্তি হচ্ছেন।
এই হিসাবে, ঢাকার কোচিং সেন্টারে মানবিক শাখার গড় কোর্স ফি ১০ থেকে ১৮ হাজার, ব্যবসায় শিক্ষা শাখায় ১২ থেকে ১৮ হাজার এবং বিজ্ঞান শাখায় ১৮ থেকে ২২ হাজার টাকা। মেডিকেল ও ইঞ্জিনিয়ারিং কোর্সের জন্য কোচিং ফি ২০ থেকে ২৪ হাজার টাকা এবং নার্সিং কোর্সের কোচিং ফি ১৫ থেকে ১৮ হাজার টাকার মধ্যে রয়েছে।
কোচিং ফির বাইরে সবচেয়ে বড় খরচের খাত হলো আবাসন ও খাবার। সাধারণত ফার্মগেট এলাকার শিক্ষার্থীরা পান্থপথ, পূর্ব ও পশ্চিম রাজাবাজার, তেজতুরি বাজার এবং তেজকুনিপাড়ায় বাসা বা হোস্টেল ভাড়া নিয়ে থাকেন। বিশেষ করে ভর্তি সময়ের (‘এডমিশন টাইমে’) বাড়িওয়ালা ও হোস্টেল মালিকরা ভাড়া স্বাভাবিক সময়ের তুলনায় বাড়িয়ে দেন।
অনেক শিক্ষার্থী জানান, মেস পদ্ধতিতে সিট ভাড়া শুরু হয় সাড়ে তিন হাজার টাকা থেকে। সার্ভিস চার্জ, ইউটিলিটি বিল ও অন্যান্য খরচ মিলিয়ে মাসে একজন শিক্ষার্থীর খরচ হয় সাড়ে ৪ থেকে ৫ হাজার টাকা। তিন বেলার খাবারের জন্য মাসে আরও ৩,৫০০ থেকে ৪,০০০ টাকা পর্যন্ত গুনতে হয়। সব মিলিয়ে থাকা-খাওয়ার খরচ গড়ে ৯ থেকে ১০ হাজার টাকার মধ্যে।
হোস্টেলে থাকা শিক্ষার্থীদের খরচও প্রায় একই। এক শিক্ষার্থী জানান, হোস্টেলের তিন সিটের একটি রুমে খাবার ও অন্যান্য খরচসহ তার সিটভাড়া মাসে ৯ হাজার টাকা।

ঢাকায় পরিবারের সঙ্গে বসবাস করা শহীদ রমিজ ক্যান্টনমেন্ট কলেজের শিক্ষার্থী জান্নাতুল ফোয়ারা তুষ্টি দ্য ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, আমি একটি কোচিং সেন্টারে ১৫ হাজার টাকায় ভর্তি হয়েছি। আমার থাকার জন্য আলাদা হোস্টেল বা বাসার খরচ না থাকলেও কোচিংয়ে সরবরাহকৃত লেকচার শিটের বাইরে বইপত্র ও পড়াশোনার অন্যান্য প্রয়োজনীয় সামগ্রীর জন্য আমাকে আলাদা ২ হাজার টাকার বাজেট রাখতে হয়েছে।
ফোয়ারা তুষ্টি আরও বলেন, এসব খরচ সামলানো অনেকটা সহজ হলেও ভর্তি পরীক্ষার আগে এই ধরনের ছোটখাটো খরচও মিলিয়ে একজন শিক্ষার্থীর সামগ্রিক বাজেটের উপর প্রভাব ফেলে, যা পড়াশোনার পাশাপাশি পরিকল্পনা এবং আর্থিক ব্যবস্থাপনার গুরুত্ব আরও বাড়িয়ে দেয়।
এদিকে নীলফামারী থেকে ঢাকায় কোচিং করতে আসা শিক্ষার্থী আকাশ মজুমদার বলেন, ফার্মগেটের একটি কোচিং সেন্টারে আমি ২২ হাজার টাকায় ভর্তি হয়েছি। মাসিক বাসাভাড়া ও খাবার খরচ মিলিয়ে ৪ থেকে ৫ মাসে প্রায় ৪০-৫০ হাজার টাকা খরচ হতে পারে। সবমিলিয়ে ৭০ থেকে ৮০ হাজার টাকা বাজেট রেখেছি কোচিং শেষ করতে।
নোয়াখালী থেকে ঢাকায় ভর্তি কোচিং করতে আসা শিক্ষার্থী আব্দুল ওয়াহিদ দ্য ডেইলি ক্যাম্পাসকে, আমি ডিসকাউন্টে ১৬ হাজার টাকায় একটি কোচিংয়ে ভর্তি হয়েছেন। পান্থপথ এলাকায় একটি বাসায় মাসিক ৭ হাজার টাকার খরচে থাকছি আমি। কোচিং ফি ও বাসাভাড়া মিলিয়ে আমার মোট খরচ বর্তমানে ৪২ থেকে ৫০ হাজার টাকার মধ্যে পড়ছে। তবে যাতায়াত, ভর্তি পরীক্ষার ফি এবং অন্যান্য আনুষঙ্গিক খরচ যোগ করলে এটি বেড়ে ৬০ হাজার টাকার কাছাকাছি পৌঁছাতে পারে বলে জানিয়েছেন তিনি।
ভর্তি পরীক্ষার দিন পর্যন্ত এই শিক্ষার্থীদের প্রতিনিয়ত খরচ হচ্ছে নানা খাতে। কোচিংয়ের বাইরে লেকচার শিট, অতিরিক্ত বই, ফটোকপি, যাতায়াত, বাড়ি যাওয়া-আসার খরচসহ নানা অদৃশ্য খাতে একজন শিক্ষার্থীর আরও প্রায় ১০ হাজার টাকা ব্যয় হচ্ছে বলে জানিয়েছেন তারা।
সব মিলিয়ে কোচিং ফি, বাসাভাড়া, খাবার খরচ, বইপত্র, যাতায়াত ও অন্যান্য খরচ ধরা হলে একজন শিক্ষার্থীর খরচ দাঁড়াচ্ছে ৬০ থেকে ৭৫ হাজার টাকা পর্যন্ত। এই ব্যয় অনেক পরিবারের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ হলেও ভর্তির প্রতিযোগিতায় ভালো ফলাফলের আশায় হাজারো শিক্ষার্থী ঢাকামুখী হচ্ছেন।