বুয়েটের শ্রীশান্তের সাথে ঢাবির তিন শিক্ষার্থীর জড়িত থাকার অভিযোগ, বহিষ্কার দাবি

ধর্ম অবমাননা ও হিজাবধারীদের কটূক্তি

প্রক্টর কার্যালয়ের সামনে বিক্ষোভ করেন শিক্ষার্থীরা
প্রক্টর কার্যালয়ের সামনে বিক্ষোভ করেন শিক্ষার্থীরা  © সংগৃহীত

ধর্ষণ ও সাইবার সুরক্ষা অধ্যাদেশের মামলায় কারাগারে থাকা বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট) ছাত্র শ্রীশান্ত রায়ের সঙ্গে ধর্ম অবমাননা ও হিজাব পরা নারীদের প্রতি যৌন ইঙ্গিতপূর্ণ মন্তব্যে জড়িত থাকার অভিযোগ উঠেছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) তিন শিক্ষার্থীর বিরুদ্ধে। এর মধ্যে ব্যবসায় প্রশাসন ইনস্টিটিউটের (আইবিএ) দুই শিক্ষার্থীর বিরুদ্ধে ৫ সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করেছে আইবিএ প্রশাসন। আগামীকাল বুধবার (২৮ অক্টোবর) প্রতিবেদন জমা দেওয়ার কথা রয়েছে।

অভিযুক্ত শিক্ষার্থীরা হলেন আইবিএর বিবিএ-৩০ ব্যাচের শিক্ষার্থী মেহতাজুর রহমান ও তাসনিয়া ইসলাম এবং কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং (সিএসই) শিক্ষার্থী বিভাগের আবরার ফাইয়াজ। অভিযুক্তদের মধ্যে দুইজনের বিরুদ্ধে গত ২৩ অক্টোবর লিখিত অভিযোগ দিয়েছিলেন আইবিএর শিক্ষার্থীরা। তারা অভিযোগ, অভিযুক্ত দুই শিক্ষার্থীকে বাঁচাতে চায় আইবিএ প্রশাসন। শিক্ষার্থীদের চাপ কমে গেলে শাস্তি নিশ্চিত না করেই অভিযুক্তদের নিশ্চিন্তে ক্লাস-পরীক্ষায় ফেরানোর পরিকল্পনা করছেন সংশ্লিষ্টরা।

গত ২১ অক্টোবর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম রেডিটে বুয়েট শিক্ষার্থী শ্রীশান্ত রায়ের বেশ কিছু বক্তব্যের স্ক্রিনশট ছড়িয়ে পড়ে, যেখানে তার বিরুদ্ধে ছাত্রীকে ধর্ষণের অভিযোগ ওঠে। একই সাথে ইসলাম অবমাননা, মুসলিম নারীদের প্রতি যৌন ইঙ্গিতপূর্ণ বক্তব্য এবং এসবে জড়িত থাকার দম্ভপূর্ণ স্বীকারোক্তির অভিযোগ আনা হয়। এতে ওই শিক্ষার্থীর শাস্তির দাবিতে উত্তাল হয়ে উঠে বুয়েট। পরে তাকে আটক করে সাইবার সুরক্ষা অধ্যাদেশ আইনে আদালতে পাঠালে তাকে কারাগারে প্রেরণের আদেশ দেওয়া হয়। একই সাথে তাকে সাময়িক বহিষ্কার করে বুয়েট প্রশাসন।

পরে শ্রীশান্তের একটি ম্যাসেঞ্জার গ্রুপের স্ক্রিনশটও ভাইরাল হয়, যেখানে ইসলাম অবমাননা, মুসলিমদের নিপীড়নের সম্মতি উৎপাদন এবং মুসলিম নারীদের যৌন ইঙ্গিতপূর্ণ মন্তব্য করা হত। ওই গ্রুপের সঙ্গে জড়িত ছিলেন আইবিএর অভিযুক্ত দুই শিক্ষার্থী। একই সঙ্গে নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যবসায় প্রশাসনের (বিবিএ) নাফিউর আব্দুল্লাহ রোহান নামে এক শিক্ষার্থীও জড়িত থাকায় তাকে ১ বছরের জন্য বহিষ্কার করে প্রশাসন। কিন্তু ঢাবির তিন শিক্ষার্থীর বিরুদ্ধে কোনো শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।

এ ঘটনায় আইবিএ প্রশাসনের কাছে লিখিত অভিযোগ জমা দেওয়ার পর আজ প্রক্টর কার্যালয়ের সামনেও বিক্ষোভ করেন শিক্ষার্থীরা। প্রায় ২ ঘন্টা তারা প্রক্টর কার্যালয়ের সামনে অবস্থান করেন। প্রক্টর বরাবর লিখিত অভিযোগও দায়ের করা হয়। এ সময় শিক্ষার্থীরা বলেন, ঢাকা বিষয়বিদ্যালয়ের মতো জায়গায় এই ধরণের ইসলাম এবং মুসলিম নারীদের নিয়ে জঘন্য রকম কথা বার্তা বলা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। বুয়েট প্রশাসন, নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ব্যবস্থা গ্রহণ করলেও ঢাবি প্রশাসন এখনো নিশ্চুপ।

আইবিএর দুই শিক্ষার্থীর বিরুদ্ধে অভিযোগের বিষয়ে তাদের সহপাঠীরা দ্য ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, গত ২১ অক্টোবর বুয়েট শিক্ষার্থী শ্রীশান্তের সাথে ইসলামবিদ্বেষ, রাসুলকে (স) গালিগালাজ ও মুসলিম নারীদের নিয়ে শ্লীলতাহানির সঙ্গে যুক্ত একটি গ্রুপের স্ক্রিনশট ভাইরাল হয়। ওই গ্রুপে যুক্ত ছিল আইবিএর মেহতাজুর রহমান ও তাসনিয়া ইসলাম। তাদের বিরুদ্ধে আইবিএর শিক্ষার্থীরা লিখিত অভিযোগ দাখিল করে। একটি লোক দেখানো কমিটি করা হলেও এখনো অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি।

তারা বলছেন,  গ্রুপের চ্যাট ভাইরাল হওয়ার পর নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ এক ছাত্রকে ১ বছর বহিষ্কার করেছে। গ্রেপ্তার হয়েছেন বুয়েট শিক্ষার্থী শ্রীশান্তও। অন্যদের সঙ্গে শিক্ষার্থীরা ক্লাস না করার ঘোষণা দিয়েছে। কিন্তু আইবিএ একেবারে নির্বিকার। কমিটির কার্যকম দেখে মনে হচ্ছে আইবিএ প্রশাসন তাদেরকে সেইফ এক্সিট দিতে চাচ্ছে। শিক্ষার্থীদের চাপ কমে গেলে তাদেরকে কোনো শাস্তির আওতায় না নিয়েই ক্লাস করতে দেওয়া হবে।

গত বৃহস্পতিবার আইবিএ পরিচালক অধ্যাপক শাকিল হুদার কাছে ইংরেজি ভাষায় দেওয়া শিক্ষার্থীদের অভিযোগপত্রে বলা হয়, ‘আমাদের ব্যাচের দুইজন শিক্ষার্থী, তাসনিয়া ইসলাম এবং মেহতাজুর রহমানের সঙ্গে সম্পর্কিত একটি অত্যন্ত উদ্বেগজনক ও সংবেদনশীল বিষয়ে আমরা আপনার দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাই। উভয় শিক্ষার্থী এমন একটি গ্রুপ চ্যাটের সদস্য হিসাবে পাওয়া গেছে, যেখানে স্পষ্টভাবে ইসলামফোবিক এবং নারীবিদ্বেষী বিষয়বস্তু প্রচারিত হয়। গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো, একই গ্রুপ চ্যাটে অন্তর্ভুক্ত ছিলেন কুখ্যাত অভিযুক্ত ধর্ষক শ্রীশান্ত রায়, বর্তমানে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট) কর্তৃপক্ষ কর্তৃক যার ছাত্রত্ব বাতিল করা হয়েছে। এই চ্যাটে বহু পোস্ট শেয়ার করা হয়েছে, যা মুসলিমদেরকে অবমাননা করেছে, ইসলামী ব্যক্তিত্বকে নিয়ে ঠাট্টা করেছে এবং হিজাব পরা নারীদের সেক্সুয়ালাইজ ও অবমাননা করেছে।’

গ্রুপচ্যাটের প্রায় ১০ হাজারেরও বেশি ম্যাসেজ থেকে প্যাটার্ন বের করে নির্দিষ্ট অভিযোগ আকারে তুলে ধরা হয়েছে অভিযোগপত্রে। এতে ইসলামোফোবিক কন্টেন্টে উপস্থিতি ও অংশগ্রহণ, অভিযুক্ত ধর্ষক ও ঘৃণা ছড়ানো শ্রীশান্তের সঙ্গে সম্পর্ক, হিজাব পরা নারীদের সেক্সুয়ালাইজেশন ও অবমাননা, ইসলাম ধর্মাবলম্বীদের অবমাননা ও সহিংসতাকে বৈধতা প্রদানের অভিযোগ আনা হয়েছে।

অভিযোগপত্রে বলা হয়, গ্রুপটি স্পষ্টভাবে ইসলামফোবিক এবং নারীবিদ্বেষী হলেও উভয় শিক্ষার্থী সেখানে নিয়মিত ছিলেন। তাসনিয়া ইসলাম গ্রুপচ্যাটে অংশগ্রহণ বা তার মন্তব্য সম্পর্কে কোনো ব্যাখ্যা প্রদান করেননি। অন্যদিকে মেহতাজুর রহমান জানিয়েছেন যে তিনি ২০২১ সালে অল্প সময়ের জন্য ধর্মবিরোধী পর্যায়ে প্রবেশ করেছিলেন। কিন্তু ২০২৪ সালেও তার টেক্সট চ্যাটে পাওয়া গেছে।

এ ছাড়া গ্রুপটি ইসলামফোবিক, নারীবিদ্বেষী এবং ধর্মীয় অবমাননাকর কন্টেন্ট শেয়ার করার জন্য বিশেষভাবে তৈরি করা হয়েছিল উল্লেখ করে এতে বলা হয়, এটি কোনো সাধারণ বা একাডেমিক গ্রুপ ছিল না। মেহতাজুর রহমান এই ধরনের মতামতে অংশগ্রহণ করার কথা স্বীকার করেছেন, কিন্তু অভিযুক্ত ধর্ষকের (শ্রীশান্ত) উপস্থিতির প্রতি তিনি অবহিত ছিলেন না বলে উল্লেখ করেছেন। সমস্যা কেবল অপরাধীর উপস্থিতিতে থাকা নয়, বরং এমন ঘৃণাপূর্ণ গ্রুপে অংশগ্রহণ করা-যেখানে নারীর অবমাননা ও সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ স্বাভাবিকীকৃত। এমনকি অভিযুক্ত শ্রীশান্ত রায়ের অপরাধ প্রকাশের পর তাসনিয়া ইসলাম ম্যাসেজ এবং ডিজিটাল ট্রেস মুছে ফেলার উপায় নিয়ে আলোচনা করছিলেন। আমরা তাদের কদর্যের কেবল একটি অংশই দেখছি।

এতে আরও বলা হয়, গ্রুপ চ্যাটে হিজাবধারী নারীদের সবচেয়ে অবমাননাকরভাবে যৌনায়ন ও অবমাননা করা হয়েছে। এটি হয়রানি এবং যৌন সহিংসতার ‘যৌক্তিককরণ’ প্রচার করেছে। এই ধরনের কন্টেন্টে অংশগ্রহণ বা সহনশীলতা আইবিএর শিক্ষার্থীদের জন্য গভীর উদ্বেগের বিষয়। এটি প্রতিষ্ঠানের লিঙ্গ সংবেদনশীলতা, অন্তর্ভুক্তি ও সম্মানের নীতির সঙ্গে বিরোধী। এ ছাড়া চ্যাটে মুসলিমদের বিরুদ্ধে অবমাননা এবং সহিংসতাকে ন্যায়সঙ্গত হিসেবে দেখানোর কথাও ছিল। মেহতাজুর রহমান বাবরি মসজিদের ধ্বংস নিয়ে কৌতুক করতেন।

অভিযোগপত্রে শিক্ষার্থীরা বলেন, আইবিএ সবসময় বুদ্ধিবৃত্তিক সততা, সমতা এবং ধর্মীয় বিশ্বাসের প্রতি সম্মানের প্রতীক হিসেবে দাঁড়িয়েছে। এই ধরনের ঘৃণাপূর্ণ গ্রুপে অংশগ্রহণ করা শিক্ষার্থীর উপস্থিতি সেই মানসিক পরিবেশের জন্য হুমকি। মুসলিম শিক্ষার্থীরা, বিশেষ করে নারীরা এখন নিরাপদ ও সম্মানিত অনুভব করছেন না। এসব কারণে আমরা প্রশাসনকে অনুরোধ করছি অভিযুক্তদের উপস্থিতি ও অংশগ্রহণ নিশ্চিতকারী প্রমাণ (স্ক্রিনশট ও ডিজিটাল রেকর্ড) যাচাই করার জন্য। একই সাথে আইবিএর আচরণবিধি অনুযায়ী যথাযথ শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করার দাবিও জানাচ্ছি।

অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে আইবিএ পরিচালক অধ্যাপক শাকিল হুদা দ্য ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, বৃহস্পতিবার রাতে অভিযোগ পাওয়ার পরই আমরা ৫ সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেছি। কমিটি কাল প্রতিবেদন জমা দিবে। প্রতিবেদন পেলে তা আমরা প্রক্টর কার্যালয়ে পাঠিয়ে দিব। তদন্তে প্রমাণ পেলে সিন্ডিকেট এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিবে।

দুই পক্ষে শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তা প্রসঙ্গে জানতে চাইলে তিনি বলেন, নিরাপত্তা বলতে অভিযুক্ত শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তা নিয়ে আমি শঙ্কিত। আবেগের বশে কেউ তাদের আক্রমণ করে বসে কিনা। আপাতত তাদেরকে ক্যাম্পাসে আসতে নিষেধ করেছি।

তদন্ত কমিটির প্রধান অধ্যাপক ড. মো. মহিউদ্দিনের কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমরা তদন্ত করেছি, আগামীকাল প্রতিবেদন জমা দিব। এরপর কী ব্যবস্থা নেওয়া হবে তা আইবিএ প্রশাসনের বিষয়।

এ বিষয়ে জানতে বিশ্ববিদ্যালয় প্রক্টর সাইফুদ্দিন আহমেদের মুঠোফোনে একাধিকবার কল দেওয়া হলেও তিনি রিসিভ করেননি।


সর্বশেষ সংবাদ