ঢাবিতে ২২ হাজার ছাত্রের জন্য ১৩ হল, ২০ হাজার ছাত্রীর জন্য পাঁচটি কেন?

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কার্জন হল
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কার্জন হল  © সংগৃহীত

দেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে (ঢাবি) বর্তমানে অধ্যয়নরত রয়েছেন প্রায় ৪১ হাজারেরও বেশি শিক্ষার্থী। এই বিপুল সংখ্যক শিক্ষার্থীর জন্য রয়েছে তীব্র আবাসন সংকট। তাদের বিরাট অংশকে হলের বাইরে বাসা বা মেস ভাড়া করে থাকতে হয়। আর সংখ্যায় কাছাকাছি হলেও ছাত্রীদের চেয়ে ছাত্র হল বেশি আটটি।   

সংশ্লিষ্ট সূত্রে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে মোট হলে সংখ্যা ১৯টি। ২১ হাজার ৮৩০ জন ছাত্রের জন্য বরাদ্দ রয়েছে ১৩টি হল। অথচ ১৯ হাজার ৭৮৭ জন ছাত্রীর জন্য মাত্র পাঁচটি ছাত্রী হল রয়েছে। পাশাপাশি বিদেশি শিক্ষার্থীদের জন্য রয়েছে একটি আন্তর্জাতিক হল। বর্তমানে ছাত্রী হলগুলোয় থাকছেন প্রায় ৮ হাজার ছাত্রী। আর ছাত্রদের হলগুলোতে থাকছেন প্রায় ১৪ হাজার ছাত্র। হলগুলোতে সিট পেয়েছেন অর্ধেকেরও কম শিক্ষার্থী। 

ছাত্রী হলের আবাসন সংকট 

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রীদের জন্য বরাদ্দকৃত সবচেয়ে বড় আবাসিক হল বেগম রোকেয়া। হলটিতে থাকছেন প্রায় ৩ হাজার ছাত্রী, যেখানে সিট সংখ্যা মাত্র ২ হাজার। কিন্তু হলটিতে আবাসিক ও অনাবাসিক ছাত্রীর সংখ্যা প্রায় সাড়ে ৭ হাজার। আবাসন সুবিধার দিক দিয়ে এরপরই রয়েছে কবি সুফিয়া কামাল হল। হলটিতে এক হাজার সিটের বিপরীতে রয়েছেন দেড় হাজারের ও বেশি ছাত্রী। অনাবাসিক ছাত্রীর সংখ্যা ২ হাজার। 

শামসুন নাহার, বাংলাদেশ-কুয়েত মৈত্রী, ফজিলাতুন্নেছা মুজিব হলেরও একই অবস্থা। হলের সিটের চেয়ে অধিক ছাত্রী আবাসন দেয়া সত্ত্বেও অর্ধেকের বেশি শিক্ষার্থীকে হলের বাইরে থাকছেন। সিটের চেয়ে অধিক শিক্ষার্থীকে আবাসন দেওয়ার ফলে হলের শিক্ষার্থীদের ও গাদাগাদি করে থাকতে হচ্ছে। ফলে তাদেরকেও নানা সমস্যার সম্মুখীন হতে হচ্ছে। 

ছাত্র হলের আবাসন সংকট 

ছাত্রদের হলগুলোয় গত বছরের আগস্টের আগ পর্যন্ত গেস্টরুম কর্মসূচি অব্যাহত ছিল। সে সময়ে ছাত্রদের ১৩টি হলে অন্তত ৮৫টি গণরুম ছিল বলে তথ্য পাওয়া যায়, যেখানে প্রায় দেড় হাজারেরও বেশি ছাত্র থাকতেন। বর্তমানে হল প্রশাসনের নিয়ন্ত্রণে রুমগুলো ছাত্রদের নামে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। বর্তমানে ছাত্র হলগুলো সবই প্রশাসনের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে।

এ কারণে প্রথমবর্ষ থেকেই ছাত্ররা বৈধভাবে হলে ওঠার সুযোগ পাচ্ছে। তবু সকলের আবাসন সংকট মেটানো সম্ভব হচ্ছে না। এছাড়াও এই বছর ‘জুলাই শহিদ স্মৃতি ভবন’-এর ২৫২টি কক্ষে ১ হাজার ৮ জন শিক্ষার্থীর আবাসনের ব্যবস্থা করা হয়েছে।

হল সংকটে শিক্ষার্থীদের ভোগান্তি 

হল সংকট নিয়ে আবাসিক এবং অনাবাসিক উভয় শিক্ষার্থীকেই অনেক সমস্যার সম্মুখীন হতে হচ্ছে। এ বিষয়ে কুয়েত মৈত্রী হলের অনাবাসিক এক শিক্ষার্থী সাইয়্যিদা রেজা বলেন, ‘অনাবাসিক শিক্ষার্থীরা ক্লাসের মাঝে বিরতির সময়টাতে যদি রেস্টের জন্য বান্ধবীর রুমে গিয়ে কিছু সময় থাকতে চায়, তারা সেই সুযোগ কখনোই পায় না। কারণ অনাবাসিক শিক্ষার্থীদের থাকার অনুমতি নেই কোনো হলে, এমনকি নিজের হলেও নেই।’

ছেলেদের ক্ষেত্রে এ নিয়ম প্রযোজ্য না উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘কোনো হলভিত্তিক অনুষ্ঠানে অনাবাসিকদের কোনো অংশগ্রহণের সুযোগ রাখা হয় না। ফলশ্রুতিতে ডিবেটিং ক্লাব, কালচারাল ক্লাব গুলোয় আমাদের যুক্ত হওয়ার অনুমতি না থাকায় নেটওয়ার্কিং গড়ে ওঠে না। আমরা ক্যাম্পাসে থেকে হয়ে যাই আইসোলেটেড। তারা না আমাদের অধিকার নিশ্চিত করতে পারেন, না আমাদের পর্যাপ্ত সিট দিতে পারেন। এমনকি ইমার্জেন্সি কারণ বা পরীক্ষার আগেও আমরা হলে থাকার এক্সেস পাই না।’ 

শামসুন নাহার হলের আবাসিক শিক্ষার্থী জান্নাতুল বলেন, ‘সিটের তুলনায় অধিক শিক্ষার্থীদের আবাসন দেয়ার ফলে হলে রিডিং রুমে পড়ার জন্য সিট ফাঁকা পাওয়া যায় না অধিকাংশ সময়। আবার ছুটির দিনে ওয়াশরুমগুলোয় সকাল থেকে লম্বা সিরিয়াল থাকে। বাঙ্কার বেড দেয়ার ফলে রুমে পর্যাপ্ত আলো-বাতাস প্রবেশ করতে পারে না। রুমগুলো অনেক বেশি অন্ধকার লাগে, অল্প জায়গাতে অনেক বেশি গাদাগাদি করে থাকতে হচ্ছে। এ বিষয়ে হল কর্তৃপক্ষের দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়া উচিত।’

আরেক অনাবাসিক শিক্ষার্থী সাদিয়ার ভাষ্য, ‘বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিকাংশ শিক্ষার্থীই ঢাকার বাইরে থেকে এসেছে। তাই বাইরে বাসা ভাড়া করে থাকতে হচ্ছে। যেটা আমাদের অনেকের জন্য খুবই ব্যয়বহুল। সঙ্গে নিরাপত্তা নিয়ে তো অনিশ্চয়তা রয়েছেই।’ সম্প্রতি ঢাবির এক অনাবাসিক ছাত্রীকে মারধর করার ঘটনাও উল্লেখ করেন তিনি। 

আরের অনাবাসিক শিক্ষার্থী জানান, কোনোদিন দ্রুত ক্লাস শেষ হলেও বাসের জন্য অপেক্ষা করা লাগে। আবার শনিবারে পরীক্ষা থাকলে সেদিন তাদেরকে যানবাহন নিয়ে অনেক ভোগান্তি পোহাতে হয়। হলে না থাকাই হলের কোনো এক্টিভিটিসেও তারা যুক্ত হতে পারেন না।   

নতুন প্রকল্প

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, ছাত্রীদের আবাসন সংকট নিরসনের লক্ষ্যে ২ হাজার ৮৪১ কোটি ৮৬ লাখ টাকা প্রাক্কলিত ব্যয়ে ‘চারটি ছাত্রী হল ও ৫টি ছাত্র হলসহ বিভিন্ন ভবন নির্মাণ প্রকল্প’ অনুমোদনের জন্য সরকারের কাছে প্রেরণ করা হয়েছে। ফলে প্রায় ৩ হাজার ছাত্রী ও ৫ হাজার ১০০ ছাত্রের আবাসন সংকট দূর হবে। এছাড়া চীন সরকারের ২৪৪ কোটি টাকা আর্থিক সহযোগিতায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রীদের জন্য নতুন একটি হল করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে বলে বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়। হলটির প্রস্তাবিত নাম ‘বাংলাদেশ-চীন মৈত্রী হল’। 

আরও পড়ুন : চলতি সপ্তাহেই চূড়ান্ত হচ্ছে ঢাবি ভর্তি পরীক্ষার তারিখ, সর্বশেষ যা জানা যাচ্ছে

বিশ্ব ব্যাংকের এইচইএটি প্রজেক্টের (Higher Education Acceleration and Transformation Project) আওতায় শিক্ষার্থীদের আবাসন বৃত্তি দেওয়া হবে। বৃত্তির প্রকল্পটিও বর্তমানে প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। আগামী শিক্ষাবর্ষে আন্ডারগ্র্যাজুয়েট প্রোগ্রামে যারা ভর্তি হবেন, তারা এ বৃত্তির আওতায় আসবে বলে আশা করা যাচ্ছে। তবে কত টাকা দেওয়া হবে, সে বিষয়ে চূড়ান্ত কোনো তথ্য প্রকাশ করা হয়নি বিজ্ঞপ্তিতে। 

১৫১ কোটি ৫৩ লাখ টাকা ব্যয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অতি পুরোনো জরাজীর্ণ ভবনসমূহের সংস্কার, সংরক্ষণ ও সৌন্দর্যবর্ধনে ১৬৮টি ভবনের সংস্কার করা হবে বলে জানা গেছে।

প্রশাসনের অগ্রগতি

বিশ্ববিদ্যালয়ের তথ্যানুসারে, ২০১১ সালের পর থেকে শিক্ষক, কর্মকর্তা, কর্মচারীদের আবাসনের এ পর্যন্ত ১১টি ভবন নির্মাণ করা হয়েছে। ছাত্রদের জন্য সম্প্রতি জুলাই স্মৃতি ভবন উদ্বোধন করা হলেও মেয়েদের জন্য নতুন কোনো হল নির্মাণ এখনও হয়নি। ছাত্রী হলে বাঙ্ক বেডের ব্যবস্থা করা হলেও অর্ধেকের বেশি ছাত্রীদেরই আবাসন সংকট মেটানো সম্ভব হয়নি। তবে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ২০৩০ সালের মধ্যে নতুন প্রকল্প বাস্তবায়ন করবে বলে জানিয়েছে।


সর্বশেষ সংবাদ