ঢাবির আওয়ামীপন্থি সেই ৭১ শিক্ষকের একজনের বহিষ্কার চান নিজ বিভাগের শিক্ষার্থীরা

অধ্যাপক ড. রফিকুল ইসলাম (রফিক শাহরিয়ার)
অধ্যাপক ড. রফিকুল ইসলাম (রফিক শাহরিয়ার)  © সংগৃহীত ও সম্পাদিত

চব্বিশের জুলাই আন্দোলনে শিক্ষার্থীদের বিরুদ্ধে অবস্থান নেওয়া এবং অভ্যুত্থানের পরও ফ্যাসিবাদের পক্ষে সক্রিয় কার্যকলাপ অব্যাহত রাখার অভিযোগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) শান্তি ও সংঘর্ষ অধ্যয়ন বিভাগের অধ্যাপক ড. রফিকুল ইসলামকে (রফিক শাহরিয়ার) বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্থায়ীভাবে বহিষ্কার ও সব ধরনের শ্রেণী-কার্যক্রম থেকে অব্যাহতির দাবি জানিয়েছেন বিভাগটির শিক্ষার্থীরা। এর আগে, গত ৭ জুলাই ‘মব সন্ত্রাসের’ বিরুদ্ধে আওয়ামীপন্থি ৭১ শিক্ষকের দেওয়া বিবৃতির প্রথম স্বাক্ষরকারী ছিলেন এই শিক্ষক। আগামী ১ সপ্তাহের মধ্যে দাবি না মানলে বিভাগের সব ধরনের শিক্ষা-কার্যক্রম থেকে বিরত থাকার পাশাপাশি চূড়ান্ত আন্দোলনের হুঁশিয়ারি দিয়েছেন শিক্ষার্থীরা। 

এ বিষয়ে ৩ দফা দাবি জানিয়ে সোমবার (১৮ আগস্ট) বিভাগের সব ব্যাচের শিক্ষার্থীদের একটি প্রতিনিধিদল বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. নিয়াজ আহমদ খান বরাবর একটি স্মারকলিপি দিয়েছে। এ স্মারকলিপির অনুলিপি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য (প্রশাসন), উপ-উপাচার্য (শিক্ষা), সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের ডিন ও প্রক্টরকেও দেন তারা। 

স্মারকলিপিতে শিক্ষার্থীরা তিন দফা দাবি জানান। সেগুলো হল- অধ্যাপক রফিক শাহরিয়ারকে স্থায়ীভাবে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিষ্কার ও সব ধরনের শ্রেণী-কার্যক্রম থেকে অব্যাহতি দিতে হবে; ইতোমধ্যে যে সকল শিক্ষার্থীরা আন্দোলনের পর তার সাথে শ্রেণী-কার্যক্রমে অংশগ্রহণ করেছে, তারাও এই দাবিগুলোর পক্ষে তাদের অধিকাংশের মতামত ব্যক্ত করেছে। উক্ত শিক্ষার্থীদের যেন কোনো প্রকারের হেনস্থার স্বীকার না হতে হয়, তা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকে নিশ্চিত করতে হবে এবং জরুরি ভিত্তিতে পরীক্ষার খাতা মূল্যায়ন থেকে অব্যাহতি দিতে হবে। 

অধ্যাপক রফিকের বহিষ্কারের দাবিতে দেওয়া স্মারকলিপি গ্রহণ করছেন
ঢাবি ভিসির একান্ত সচিব আব্দুর রহমান (নিশাত)

শিক্ষার্থীরা বলেন, বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন আমাদের দাবিগুলো আগামী ১ সপ্তাহের (২৪ আগস্ট) মধ্যে বাস্তবায়ন না করলে বিভাগের সব ধরনের শিক্ষা-কার্যক্রম থেকে বিরত থাকার পাশাপাশি চূড়ান্ত আন্দোলনের পথ বেছে নিতে বাধ্য হবো। দেশের সহস্রাধিক ছাত্র-জনতার মৃত্যুর বিপরীতেও যাদের বিবেক জাগ্রত না হয়, রাষ্ট্রের জনগণের অর্থে তারা সুযোগ-সুবিধা ভোগ করবে এবং গণহত্যাকারী ফ্যাসিবাদের কাজকে বৈধতা দিবে, ইহা মেনে নেয়া আমাদের পক্ষে সম্ভব নয়।

তারা আরও বলেন, অধ্যাপক ড. রফিক শাহরিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়ের আওয়ামীপন্থি নীল দলের শিক্ষকদের প্রথম সারির নেতা। চব্বিশের অভ্যুত্থানের সময় তিনি স্যার এএফ রহমান হলের প্রাধ্যক্ষ ছিলেন। অন্যান্য আওয়ামীপন্থি শিক্ষকদের মতো তিনিও বছরের পর বছর আওয়ামী লীগের অন্যায়, অত্যাচার ও অবিচারের শাসনব্যবস্থাকে প্রত্যক্ষভাবে সমর্থন দিয়ে গেছেন, বিনিময়ে পেয়েছেন বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রাতিষ্ঠানিক সুযোগ-সুবিধা। চব্বিশের জুলাই অভ্যুত্থানের সময়ও তার অবস্থান ছিল আওয়ামী লীগের পক্ষে। আমাদের পক্ষে বিভাগে ফ্যাসিবাদপন্থী এই শিক্ষকের সাথে সহাবস্থান আর সম্ভব নয়।

কর্তৃপক্ষকে দেওয়া শিক্ষার্থীদের স্মারকলিপির ভাষ্য অনুযায়ী অভিযুক্ত শিক্ষক অধ্যাপক রফিক শাহরিয়ারের কার্যকলাপ:  

১। আন্দোলনে শান্তি ও সংঘর্ষ অধ্যয়ন বিভাগের দুইজন শিক্ষার্থীকে ৩১শে জুলাই, ২০২৪ তারিখে পুলিশ তাদের নিজ জেলা থেকে গ্রেফতার করে। উল্লেখ্য তারা উভয়ই স্যার এ.এফ. রহমান হলের আবাসিক শিক্ষার্থী। রফিক শাহরিয়ার তখন উক্ত হলের প্রাধ্যক্ষের দায়িত্বে ছিলেন। তারা গ্রেফতার হওয়ার পর বিভাগের শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা তাদের ছাড়ানোর জন্য সর্বাত্মক চেষ্টা করলে পুলিশ হল প্রাধ্যক্ষের সুপারিশ চায়। তার বিরুদ্ধে অভিযোগ আছে তিনি তাদের ছাড়ানোর ব্যাপারে অপারগতা প্রকাশ করেন এবং ব্যক্তিগত আক্রোশ থেকে (যা তিনি বিভাগের এক শিক্ষার্থীকে জানিয়েছেন) তাদের দুইজনের মধ্যে একজনকে না ছাড়ানোর মানসিকতা প্রকাশ করেন। তার এহেন কার্যকলাপের কারণে উভয় শিক্ষার্থীকে রাতভর থানায় পুলিশ কর্তৃক মানসিক চাপ ও বিস্ফোরক আইনে মামলার হুমকির মধ্য দিয়ে যেতে হয়। উক্ত ঘটনায় তাদের পরিবারের সদস্যরাও মানসিক চাপের মধ্য দিয়ে যায় এবং অসুস্থ হওয়ার মত ঘটনা ঘটে। পরবর্তীতে তাদের মধ্যে একজন শিক্ষার্থী তাকে এই ব্যাপারে প্রশ্ন করলে তিনি সেই শিক্ষার্থীকে বলেন, “আমি তোমাকে চিনতে পারিনি।” 

২। নিজেদের সহপাঠী গ্রেফতার হওয়ার পর বিভাগের সামগ্রিক শিক্ষার্থীরা তাদের ছাড়ানোর জন্য উদগ্রীব হয়ে পড়ে। তারা সকলে সামাজিক মাধ্যমে সক্রিয় থাকার পাশাপাশি বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন থেকে সাহায্য চায় এবং কিছুক্ষেত্রে চাপ প্রয়োগ করে। এই ঘটনার প্রেক্ষিতে অধ্যাপক রফিক শাহরিয়ার বিভাগের সামাজিক মাধ্যমে ‘Please don’t spread hate speech. We want reconciliation. Remember, we have to sit in the same classroom.’ এই লেখাটি পোস্ট করেন। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে একজন আওয়ামীপন্থি শিক্ষকের এই ধরনের লেখা স্পষ্টতই আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের প্রতি একটি হুমকি। 

৩। আন্দোলনের পর শিক্ষার্থীরা প্রমাণ পেয়েছে তিনি বিভাগের যে সকল শিক্ষক ফ্যাসিবাদী সরকারের বিপক্ষে গিয়ে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের পাশে দাঁড়িয়েছেন, তিনি তাদের তথ্য আওয়ামীপন্থীদের ‘BLUE FSS 2023-24’ নামক একটি হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে সরবরাহ করতেন এবং তাদের চিহ্নিত করে দিতেন। জুলাই আন্দোলনে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর তার বিরুদ্ধে শিক্ষার্থীরা সক্রিয়ভাবে আন্দোলন গড়ে তোলে এবং তাকে বয়কটের ডাক দেয়। শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের প্রেক্ষিতে তাকে একদিন শিক্ষার্থীদের মুখোমুখি করা হয় এবং সেখানে তিনি হাত জোড় করে তার কৃতকর্মের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করেন এবং ভবিষ্যতে ফ্যাসিবাদ পন্থা থেকে বিরত থাকার আশ্বাস দেন। শিক্ষার্থীরা এই আশ্বাসকে নিশ্চয়তা হিসেবে ধরে তার বিরুদ্ধে আন্দোলনকে প্রশমিত করে এবং তাকে তৎকালীন আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের ক্লাস নেয়া থেকে বিরত রাখা হয়। পরবর্তীতে শিক্ষক সংকটের কারণে বিভাগ অধ্যাপক রফিক শাহরিয়ারকে আন্দোলনের পর নবাগত ব্যাচগুলোর ক্লাস নিতে দেয়। ফ্যাসিবাদী কার্যক্রমে অংশগ্রহণ না করার আশ্বাস দেয়ায় শিক্ষার্থীরা তার পুনরায় ক্লাস কার্যক্রমে অংশগ্রহণ করা নিয়ে কোনো আপত্তি জানায়নি। কিন্তু সময়ের সাথে তিনি সোশ্যাল মিডিয়ায় এবং পত্রিকায় তার লেখালেখি এবং পক্ষপাতদুষ্ট বিশ্লেষণের মাধ্যমে আন্দোলনকে শিক্ষার্থীদের একটি ভুল এবং আমেরিকার মদদপুষ্ট হিসেবে আখ্যা দেয়ার পাশাপাশি বিভিন্ন ফ্যাসিবাদী মতামতকে বৈধতা প্রদানের চেষ্টা করতে থাকেন।

তিনি ‘মব সন্ত্রাসের’ বিরুদ্ধে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ৭১ জন শিক্ষকের একটি বিবৃতিতে প্রথম স্বাক্ষর করেন। উল্লেখ্য এই ৭১ জন স্বাক্ষরকারীর প্রত্যেকেই আওয়ামী লীগ শাসনামলে ফ্যাসিবাদের বৈধতা প্রদানকারী এবং জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে ছাত্র-জনতার দাবির বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগ সরকারের হত্যা, নির্যাতন, নিপীড়নের পক্ষে অবস্থান নিয়েছিলেন। তার পক্ষপাতদুষ্ট লেখনিতে বিভাগের একজন সাবেক শিক্ষার্থী তাকে নিরপেক্ষ বিশ্লেষণের আহ্বান জানালে উক্ত আহ্বানের জবাবে তিনি সেই শিক্ষার্থীকে ‘I am not, even not the son of anti-liberation force. I believe you have understood my language. And, don’t prolong your argument, just stop here. OK.’ এই মন্তব্য করেন। সেখানে তিনি সরাসরি নিজের উদাহরণ দিয়ে সেই শিক্ষার্থীকে son of anti-liberation force / স্বাধীনতাবিরোধী / রাজাকার ট্যাগিং করেন। এই ধরনের ট্যাগিং সংস্কৃতি আমরা ফ্যাসিবাদ আমলে শেখ হাসিনার কাছে শুনেছি এবং এর বিরুদ্ধে কঠোর আন্দোলন গড়ে তুলেছিলাম। গন-অভুত্থানের এক বছর পরও তিনি ফ্যাসিবাদের সেই সংস্কৃতি নিজের মধ্যে লালন করে রেখেছেন। 

 


সর্বশেষ সংবাদ

X
APPLY
NOW!