কেউ বেতন পান ৫০০, কেউবা দেড় হাজার—এভাবেই চলছে অর্ধলাখ শিক্ষকের জীবন

শ্রেণিকক্ষে শিক্ষক
শ্রেণিকক্ষে শিক্ষক  © এ আই দিয়ে তৈরি

নেত্রকোনার মদনের বালালি বাগমারা শাহজাহান কলেজের শিক্ষক মো. হাফিজ প্রায় ১৫ বছর ধরে এই প্রতিষ্ঠানে শিক্ষকতা করছেন। কিন্তু প্রতিষ্ঠানটি নন-এমপিও হওয়ায় তিনি নিয়মিত কোনো বেতন পান না। কোনো মাসে পান মাত্র ৫০০ টাকা, কোনো মাসে দেড় হাজার, আর প্রতিষ্ঠানের আয় ভালো হলে সর্বোচ্চ তিন হাজার টাকা পেয়েছেন চাকরিজীবনে। এত সামান্য আয়ে সংসার চালানো সম্ভব না হওয়ায় তিনি খণ্ডকালীন কাজ করেন, যদিও আত্মসম্মানের কারণে সেই কাজের ধরন প্রকাশ করতে চান না।

মামুন দ্য ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, ‘শিক্ষা বোর্ডের স্বীকৃতি পাওয়ার পর আমাদের প্রতিষ্ঠান পাঠদানের অনুমতি পায়। এমপিওভুক্তির আশায় আমি এই চাকরিতে প্রবেশ করেছিলাম। কিন্তু দীর্ঘদিন পার হলেও এখনো সরকার আমাদের প্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্ত করেনি। ফলে আমরা এক অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দিকে এগিয়ে যাচ্ছি। কবে এমপিওভুক্ত হবো, তা জানি না। সন্তানদের ঈদে কিছু কিনে দিতে পারি না। মাঝে মাঝে এত কষ্ট হয় যে আত্মহত্যার কথা মনে আসে, কিন্তু পরিবারের কথা ভেবে সে সিদ্ধান্ত নিতে পারি না।’

রংপুরের গুবরধানপুর নিম্নমাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক মো. রমজান বলেন, ‘পাঁচ ব্ছর ধরে চাকরি করছেন তিনি। তবে কোনো বেতন পান না। সংসার চালাতে কখনো দিনমজুর, আবার কখনো দোকানে খন্ডকালীন চাকরি করেন। সেখান থেকে যা আয় হয়, তাই দিয়ে সংসার চালান। সরকারের পক্ষ থেকে এমপিওভুক্তির আশ্বাস পেলেও সেটি বাস্তবায়ন না হওয়ায় হতাশাগ্রস্ত হয়ে পড়েছেন রমজান। এ অবস্থায় পেশা বদলের কথা ভাবছেন এ শিক্ষক।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, একটি দেশের মানসম্পন্ন শিক্ষা ব্যবস্থার জন্য শিক্ষকদের আর্থিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করা অপরিহার্য। অথচ নন-এমপিও শিক্ষকদের এই অবহেলার চিত্র শিক্ষা খাতে বৈষম্যের প্রতিচ্ছবি হয়ে উঠেছে। তাদের মতে নন-এমপিও প্রতিষ্ঠানে কর্মরতদের বড় অংশই প্রান্তিক অঞ্চলের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে কর্মরত। সরকার যদি দ্রুত এই শিক্ষকদের এমপিওভুক্ত না করে, তাহলে ভবিষ্যতে শিক্ষাক্ষেত্রে বড় ধরনের সংকট তৈরি হতে পারে।

শুধু হাফিজ কিংবা রমজানই নন; বেসরকারি নন-এমপিও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে কর্মরত অর্ধ লাখ শিক্ষকের অবস্থা একই। সরকারের কাছ থেকে কোনো বেতন না পাওয়ায় অত্যন্ত মানবেতর জীবনযাপন করছেন তারা। স্বীকৃতপ্রাপ্ত সব নন-এমপিও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্তির দাবি জানিয়েছেন তারা। 

নন-এমপিও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্তির বিষয়ে জানতে চাইলে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের উপসচিব (বেসরকারি মাধ্যমিক ১ ও ৩) সাইয়েদ এ. জেড. মোরশেদ আলী দ্য ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, ‘নন-এমপিও প্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্তি নিয়ে কাজ চলছে। এর বেশি কিছু বলা সম্ভব নয়।’

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সারা দেশে স্কুল-কলেজ, মাদ্রাসা ও কারিগরি মিলিয়ে প্রায় সাড়ে তিন হাজার স্বীকৃতিপ্রাপ্ত নন-এমপিও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান রয়েছে। এসব প্রতিষ্ঠান নিম্নমাধ্যমিক, মাধ্যমিক, উচ্চমাধ্যমিক, ডিগ্রি এবং অনার্স-মাস্টার্স পর্যায়ে পাঠাদানের সঙ্গে যুক্ত। প্রতিটি প্রতিষ্ঠানে শিক্ষক-কর্মচারী মিলিয়ে অন্তত ২০ জন নন-এমপিও হিসেবে কর্মরত রয়েছেন। এদের মধ্যে চারজন কর্মচারী, অবশিষ্ট ১৬ জন শিক্ষক।

নন-এমপিও শিক্ষকরা বলছেন, তারা বছরের পর বছর ধরে নিজ নিজ প্রতিষ্ঠানে পাঠদানে নিযুক্ত থাকলেও জীবিকা নির্বাহ করার মতো কোনো আর্থিক সুবিধা পান না। ফলে, তাদের অনেকেই খন্ডকালীন চাকরি, প্রাইভেট টিউশন এমনকি কৃষিকাজ কিংবা অন্য শ্রমনির্ভর পেশার ওপর নির্ভর করতে হচ্ছে।

নন-এমপিও শিক্ষকদের বিভিন্ন সংগঠন এমপিওভুক্তির দাবিতে দীর্ঘদিন ধরে আন্দোলন করে আসছেন। বিভিন্ন সময়ে সরকার প্রতিশ্রুতি দিলেও সেই আশ্বাসের বাস্তবায়নের দেখা মেলেনি। ফলে অনেকেই হতাশ হয়ে পড়েছেন। অনেকেই পেশা বদলের চিন্তা করছেন। 

ঢাকার উপকণ্ঠে একটি বেসরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ের নন-এমপিও শিক্ষক মো. আমিনুল ইসলাম বলেন, ‘আমি ৮ বছর ধরে এই স্কুলে পড়াই। মাসে পাই ১২০০ টাকা। এতে কি নিজের খরচ চলে, না পরিবারের? সরকারি চাকরিজীবীদের বেতন বাড়ে, অথচ আমরা বেতনই পাই না। দেশের শিক্ষার উন্নয়ন হবে কীভাবে?’

জানতে চাইলে বাংলাদেশ নন-এমপিও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান পরিষদের সভাপতি মো. জমির উদ্দিন চৌধুরী দ্য ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, ‘স্বীকৃতিপ্রাপ্ত নন-এমপিও প্রতিষ্ঠানকে স্বীকৃতি দেওয়ার পূর্বে জায়গা, শিক্ষকসহ নানা বিষয় দেখা হয়। এর পর অনুমোদন দেওয়া হয়। আমরা সব প্রক্রিয়া অনুসরণ করে স্বীকৃতি পেয়েছি। অথছ আমাদের এমপিওভুক্ত করা হচ্ছে না। টাকার অভাবে নন-এমপিও শিক্ষকরা দিনমজুরের কাজ করছে। অনেকে দোকানে কর্মচারীর কাজ করছে। অথচ তারা দেশ গড়ার কারিগর।’

প্রবীণ এ শিক্ষক নেতা আরও বলেন, ‘অর্ধলাখ শিক্ষককে অভুক্ত রেখে অন্তর্বর্তী সরকার কীভাবে বিশ্ব শিক্ষক দিবস উদযাপন করতে পারে তা আমার বোধগম্য নয়। বিশ্ব শিক্ষক দিবসে সরকারের কাছে আমাদের চাওয়া হলো-অবিলম্বে নন-এমপিও প্রতিষ্ঠানগুলো এমপিওভুক্ত করা হোক। পেটের খুদা না মিটলে শিক্ষকরা শ্রেণিকক্ষে মনোযোগী হতে পারবেন না। শিক্ষকদের অভুক্ত রেখে শিক্ষার উন্নয়নও সম্ভব হবে না।’

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, একটি দেশের মানসম্পন্ন শিক্ষা ব্যবস্থার জন্য শিক্ষকদের আর্থিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করা অপরিহার্য। অথচ নন-এমপিও শিক্ষকদের এই অবহেলার চিত্র শিক্ষা খাতে বৈষম্যের প্রতিচ্ছবি হয়ে উঠেছে। তাদের মতে নন-এমপিও প্রতিষ্ঠানে কর্মরতদের বড় অংশই প্রান্তিক অঞ্চলের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে কর্মরত। সরকার যদি দ্রুত এই শিক্ষকদের এমপিওভুক্ত না করে, তাহলে ভবিষ্যতে শিক্ষাক্ষেত্রে বড় ধরনের সংকট তৈরি হতে পারে।


সর্বশেষ সংবাদ