এসএসসির পর ম্যাটসে ৩ বছর কাটিয়ে ফের এইচএসসি, সাগরের ক্যাডার হওয়ার গল্প বেশিই অন্যরকম!

সাগর হোসেন
সাগর হোসেন  © সংগৃহীত

সাগর হোসেন। এসএসসি পাসের পর তিন বছর ম্যাটসে ক্লাস করে পরবারকে না জানিয়ে ভর্তি হন উচ্চ মাধ্যমিকে। ৬ মাসের প্রস্তুতিতে এইচএসসিতে জিপিএ- ৪.৫০ পেয়ে উত্তীর্ণ হন তিনি। পরবর্তীতে উচ্চ শিক্ষার জন্য ভর্তির সুযোগ পান ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের (ইবি) অর্থনীতি বিভাগে। শুধু তাই নয় ৪৪তম বিসিএসে শিক্ষা ক্যাডারে সুপারিশপ্রাপ্ত হয়েছেন তিনি। সম্প্রতি নিজের সাফল্য, সংগ্রাম ও বিসিএস প্রত্যাশীদের জন্য কিছু গুরুত্বপূর্ণ পরামর্শ  নিয়ে মুখোমুখি হয়েছেন দ্য ডেইলি ক্যাম্পাসের। তার কথাগুলো শুনেছেন— ওয়াসিফ আল আবরার।      

নিজের সংগ্রামের কথা তুলে ধরে সাগর হোসেন বলেন, বাবার মৃত্যুর পর আমি শহরে এসে চাচার বাসায় উঠি এবং সেখানে ম্যাটস কলেজে ভর্তি হই। ম্যাটসের তৃতীয় বর্ষে ওঠার পর আমি উপলব্ধি করলাম যে, এখানে আমার ভবিষ্যৎ নেই এবং আমি গ্রাজুয়েশন শেষ করব। এরপর আমি উচ্চ মাধ্যমিকে ভর্তি হতে আগ্রহী হয়ে খোঁজ-খবর নেওয়া শুরু করি। ভর্তির জন্য কুষ্টিয়া সরকারি কলেজে গেলে তারা জানায় আমি নিয়মিত শিক্ষার্থী হিসেবে ভর্তি হতে পারব না, আমাকে প্রাইভেট প্রোগ্রামে ভর্তি হতে হবে। এরপর ২০১৩ সালের অক্টোবর মাসে আমি ভর্তি হলাম। পরীক্ষার আগে সময় পেয়েছি ৬ মাসের মতো। পাশাপাশি ম্যাটসেও ভর্তি থাকায় চাপেই ছিলাম। তখনও আমার অ্যাডমিশন নিয়ে কোনো পরিকল্পনা ছিল না।   

তিনি আরও বলেন, এর মধ্যে ম্যাটস ফাইনাল পরীক্ষায় এক কোর্সে ফেল করি। এই ব্যর্থতাই আমার জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দেয়। ফেল করা কোর্সে আবার পরীক্ষা দিতে হবে ৬ মাস পরে। এই সুযোগেই এইচএসসি পরীক্ষার প্রস্তুতি নেওয়া শুরু করি। ছয় মাসের প্রস্তুতিতে  জিপিএ-৪.৫০ পেয়ে এইচএসসি পাস করি। এরপর আমার বোনের হাউজ টিউটর তুষার রায়ের পরামর্শে এডমিশনের জন্য প্রস্তুতি শুরু করি।

তিনি আরও বলেন, আমি কোচিংয়ে ভর্তি হওয়ার এক সপ্তাহ পরেই কোচিং বন্ধ হয়ে যায়। তারপর পরিচিত এক ভাইয়ের থেকে সাজেশন নিয়ে বই কিনেছিলাম। কিন্তু যে আগ্রহ নিয়ে শুরু করেছিলাম সেই উৎসাহ, আগ্রহ হারিয়ে যায়। শুধু ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় আর রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে (রাবি) আবেদন করেছিলাম। কিন্তু রাবিতে চান্স পেলাম না। ইবির পরীক্ষা আসার আগে আমার এক বন্ধু বললো তুই অ্যাসুরেন্স এর প্রশ্নব্যাংকটা দেখ। পরীক্ষার ৩দিন আগে আমি বইটা কিনে পড়ে পরীক্ষার হলে বসলাম। অপ্রত্যাশিতভাবে ফলাফলে দেখলাম আমি সি ইউনিটে ২৬তম হয়েছি। আল্লাহ যা করেন ভালোর জন্য করেন। সেদিন যদি ম্যাটসে ফেইল না করতাম তাহলে এইচএসসিও দিতাম না, ইবিতে চান্সও পেতাম না  আর আজকের অবস্থানেও আসতাম না। 

বিসিএসের প্রস্তুতি সম্পর্কে জানতে চাইলে সাগর বলেন, আমার পরিবারের আশা ছিল ম্যাটস থেকে পাস করে বেরিয়ে আমি চাকরিতে জয়েন করবো। কিন্তু আমি যেহেতু তা করতে পারিনি তাই আমার মধ্যে একটা দায়বদ্ধতা ছিলো। সেই দায়বদ্ধতা থেকেই বিসিএসের প্রস্তুতি নেওয়া শুরু করেছিলাম। ২০২১ সালের অক্টোবরে ঢাকায় আসলাম। অক্টোবরের ২৭ তারিখ বিসিএসের প্রিলিমিনারি পরীক্ষা ছিল। আমি এই ২৭ দিনকে ২৭ মাসে রূপান্তর করেছিলাম। গোসল খাওয়া বাদে সকাল ৮টা থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত পড়তাম। ঘুমানোর আগে দেশী, বিদেশি সংবাদপত্র পড়তাম। 

তিনি আরও বলেন, আমি সেন্ট্রাল লাইব্রেরিতে না বসে বিভাগের সেমিনার লাইব্রেরিতে বেশি বসতাম। কিন্তু আমাদের যে লাইব্রেরিয়ান মামা ছিলেন তিনি আমাকে ঠেলে বের করে দিতেন। বই চুরি হবে সেই অজুহাত দিতেন। কারণ আমি ছাড়া আর কেউ তেমন থাকতো না। আমি চলে গেলে তিনিও সব বন্ধ করে চলে যেতে পারবেন। কিন্তু আমি তাকে বলতাম যে প্রয়োজনে চাবি আমাকে দিয়ে যান, একটা বই হারালে আমি তার দায় নেব কিন্তু আমাকে পড়তে দিতে হবে। এরপর উনি মাঝেমাঝে আমাকে চাবি দিয়ে যেত, আমি পড়া শেষে তালা দিয়ে চলে যেতাম। সফল হতে হলে লাইব্রেরি ওয়ার্ক খুবই জরুরি।

বিসিএস ক্যাডার হওয়ার অনুভূতি ব্যক্ত করতে গিয়ে সাগর বলেন, ক্যাডার হওয়ার পর দুজন মানুষের ছবি আমার মনে ভেসেছে। একজন আমার বাবা আর একজন আমার দাদি। ফলাফল দেখার পর আমার মনে হয়েছে সন্তান হিসেবে আমি আমার বাবার জন্য কিছু করতে পেরেছি। আমার জন্য আমার বাবার নাম উজ্জ্বল হয়েছে। এটাই আমার অন্যতম সেরা একটি প্রাপ্তি।  


সর্বশেষ সংবাদ