আমাকে একদিনও বেকার থাকতে হয়নি: ৪৩ বিসিএসে প্রশাসন ক্যাডার রুহুল আমিন

এ.টি.এম রুহুল আমিন
এ.টি.এম রুহুল আমিন  © টিডিসি ছবি

প্রথম চাকরি যখন হয় তখনও আমার মাস্টার্স পরীক্ষার ভাইভা শেষ হতে ২ দিন বাকি ছিল। অর্থাৎ আমাকে ১দিনও বেকার থাকতে হয়নি। তবে আমি শুধু বিসিএস কেন্দ্রিক পড়াশোনা করেছিলাম। খুব বেশি চাকরির পরীক্ষায় অ্যাটেন্ড করিনি। ৪টি বিসিএসসহ ১০টির মতো প্রিলিমিনারি পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করি। আলহামদুলিল্লাহ প্রায় সবগুলোতেই প্রিলি পাস করি। মোট ৫টি লিখিত পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করে ৫টি ভাইভায় অংশগ্রহণ করে বর্তমানে ৪র্থ চাকরির জন্য বিসিএস প্রশাসন ক্যাডারে সুপারিশপ্রাপ্ত হয়েছি। এভাবেই নিজের সফলতার গল্প দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসের কাছে তুলে ধরেন ৪৩ তম বিসিএসে প্রশাসন ক্যাডারে সুপারিশপ্রাপ্ত এ.টি.এম রুহুল আমিন। তিনি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অণুজীববিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী ছিলেন।

নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান রুহুল আমিনের গ্রামের বাড়ি নেত্রকোণা সদর উপজেলার বালুয়াকান্দিতে। বাবা মো: আমজাদ হোসেন অবসরপ্রাপ্ত সেরেস্তাদার। তিন বোনের এক ভাই রুহুল মাধ্যমিকে নেত্রকোনার আঞ্জুমান আদর্শ সরকারি উচ্চ বিদ্যালয় থেকে জিপিএ ৫ এবং উচ্চমাধ্যমিকে রাজধানীর নটরডেম কলেজ থেকে জিপিএ ৫ পেয়ে কৃতিত্বের স্বাক্ষর রেখেছিলেন। এছাড়াও ৫ম শ্রেণীর সমাপনী পরীক্ষায় নিজ ইউনিয়নে ১ম স্থান অর্জন এবং ৮ম শ্রেণীর বৃত্তি পরীক্ষায় ট্যালেন্টপুলে জেলায় ২য় স্থান এবং এসএসসিতে ফলাফলের উপর প্রকাশিত বৃত্তির ফলাফলে জেলা ট্যালেন্ট ক্যাটাগরিতে ১ম স্থান অর্জন করেছিলেন। ২০২২ সালের মে মাসে তিনি এজিএম (প্রশাসন/মানবসম্পদ) হিসেবে বাংলাদেশ পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ডের অধীন নিয়োগপ্রাপ্ত হয়ে বর্তমানে ময়মনসিংহ পল্লী বিদ্যুৎ সমিতি-১ এ কর্মরত আছেন।

"প্রথম চাকরি যখন হয় তখনও আমার মাস্টার্স পরীক্ষার ভাইভা শেষ হতে ২ দিন বাকি ছিল। অর্থাৎ আমাকে ১দিনও বেকার থাকতে হয়নি। তবে আমি শুধু বিসিএস কেন্দ্রিক পড়াশোনা করেছিলাম। খুব বেশি চাকরির পরীক্ষায় অ্যাটেন্ড করিনি। ৪টি বিসিএসসহ ১০টির মতো প্রিলিমিনারি পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করি-এ.টি.এম রুহুল আমিন

তবে শিক্ষাজীবনের বিভিন্ন স্তরে ভালো ফলাফল অর্জন করলেও সরকারি চাকুরে বাবার বেতনে চার বোনের পড়াশোনাসহ সংসারের অন্যান্য ব্যয় মেটানো কষ্টসাধ্য ছিল। তাতেই ছিল চাওয়া এবং পাওয়ার বিস্তর ফারাক। তবে এই আক্ষেপই রুহুল আমিনকে করেছে আরও বেশি আত্মনির্ভরশীল। জানান, ‘স্কুলে ভালো ছাত্র হিসেবে পরিচিতি থাকায় অষ্টম শ্রেণীতে থাকা অবস্থায়ই আমার টিউশনি জীবনের সূত্রপাত হয়। বলা যায় তখন থেকেই নিজের পড়াশোনার যাবতীয় খরচ নিজেই ম্যানেজ করতাম।’

সফলতার এই দীর্ঘ যাত্রার গল্পে পরিবারের প্রতিও দিতে হয় দায়িত্বশীল দৃষ্টি। তিনি জানান, ‘এসএসসি পরীক্ষার পরপরই পারিবারিকভাবে বড় ধরনের ঋণে পড়ে যাই। সেই সময়ে আত্মীয়স্বজনদের সহযোগিতা এবং কদর্য রূপ সবই দেখতে পাই। অনেক নেতিবাচক আচরণও সহ্য করতে হয়। নটরডেম কলেজ ভর্তির সুযোগ পেলে আমার ছোট চাচা তার বাসায় থেকে পড়াশোনা করার সুযোগ করে দেন। টিউশনি করেই আমি পড়ার খরচ জোগাড় করতাম। কলেজ জীবনের শেষ ৬ মাস এবং ভর্তি পরীক্ষার সময় আমার শ্রেষ্ঠ বন্ধু মো. মুস্তাকিম খানের বাসায় ছিলাম। আমার এই বন্ধু আমার জীবনে আল্লাহর তরফ থেকে আশীর্বাদস্বরূপ।’

তিনি আরও যোগ করেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয় জীবনেও প্রথম মাস থেকে পুনরায় টিউশন শুরু করি। প্রায় ছয় মাসের মধ্যেই দিনে গড়ে ৩ থেকে ৪টা টিউশন করতাম। শহরে থাকায় বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য সকাল ৭ টায় বের হতাম এবং টিউশন শেষ করে ফিরতে রাত ১১ টা থেকে সাড়ে ১১ টা বেজে যেত। চাকরির জন্য আলাদাভাবে পড়াশোনার সুযোগ ছিল না। আমার দায়িত্বও ছিল। টিউশনের আয় থেকে আমাদের ঋণ শোধের পাশাপাশি ছোট বোনদের বিয়ের জন্য বাবাকে সহায়তা করি।’

বিসিএস’র পরিকল্পনার বিষয়ে জানতে চাইলে রুহুল আমিন বলেন, ‘৩য় বর্ষে এসে বিসিএসের জন্য মনস্থির করি এবং টিউশন কিছুটা কমিয়ে দিই। যেটুকু সময় পেতাম পড়াশোনা করতাম, গুছিয়ে পড়ার চেষ্টা করতাম। গণিত, বিজ্ঞান এবং ইংরেজিতে বেসিক ভালো থাকায় এবং টিউশনি করানোয় বিসিএস আমার জন্য সহজ হয়ে যায়।’

করোনা মহামারির সময় কীভাবে কাটিয়েছিলেন জানতে চাইলে তিনি জানান, ‘কোভিড-১৯ সামগ্রিকভাবে মানবজাতির জন্য একটি বড় আঘাত হলেও আমার জন্য তা আশীর্বাদ ছিল। কোভিডে হঠাৎ সব টিউশন বন্ধ হয়ে যায়। ফলে ৪১ বিসিএসের লিখিত পরীক্ষার প্রিপারেশন নেয়ার জন্য আমি ভালো একটা সময় পাই। মূলত এই প্রিপারেশনের মাধ্যমেই ৪৩ বিসিএসসহ সবগুলো চাকরি হয়।’

"সোনার চামচ মুখে দিয়ে জন্মানোর মাধ্যমে নিজের কোনো গৌরব নাই। নিজ পরিশ্রমে অর্জিত রূপার চামচ দিয়ে খেতে পারাই পরম তৃপ্তির। কারো বক্তৃতা শুনে মোটিভেটেড হওয়া যায় কি না আমি জানি না, তবে নিজের বাবা মায়ের মুখে হাসি ফোটানোর চেষ্টার চেয়ে বড় মোটিভেশন আর কিছুই নেই-এ.টি.এম রুহুল আমিন

সফলতায় জীবনসঙ্গীর ভূমিকার বিষয়ে তিনি জানান, ‘আমার স্ত্রীর নাম ডা. আজমিতা হক কৃষ্টি। ২০২২ সালেই আমাদের বিয়ে হয়। ৪১ বিসিএসে লিখিত ভালো পরীক্ষা দিয়ে নন-ক্যাডারে সহকারী পরিচালক, জনশক্তি ও কর্মসংস্থান প্রশিক্ষণ ব্যুরোতে সুপারিশপ্রাপ্ত হয়ে কিছুটা হতাশ ছিলাম। এদিকে চাকরির ব্যস্ততার কারণে ৪৩ বিসিএসের লিখিত পরীক্ষা আশানুরূপ না হওয়ায় ভাইভা প্রস্তুতি নিয়ে তেমন আগ্রহ ছিল না। সেই সময় আমার স্ত্রী আমাকে মানসিক শক্তি যুগিয়েছিল। সারাদিনের অফিসে সুযোগ পেলে কিংবা সপ্তাহে ২ থেকে ৩ দিন তার কাছে ভাইভা প্র্যাকটিস করা হতো। আমার উপর আমার নিজের থেকে তার বিশ্বাস ছিল অনেক বেশি। যেটি আমাকে অনুপ্রাণিত করে।’

সফলতায় পরিবার কিংবা বন্ধুবান্ধবের অনুভূতি কেমন জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘প্রশাসন ক্যাডারে সুপারিশপ্রাপ্ত হওয়ার পর আত্মীয়-স্বজন, এলাকাবাসী, বন্ধু-বান্ধব সকলের খুশির কারণ হতে পেরে পরম তৃপ্তি পাচ্ছি। আপনজনদের হাসিমুখের চেয়ে দামি জিনিস এই পৃথিবীতে আর কিছু আছে বলে আমি মনে করি না।’

ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা নিয়ে তিনি দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, বর্তমানে আমার দুইটি চাওয়া আছে। প্রথমত পেশাগত জীবনে সর্বোচ্চ দক্ষতা অর্জনের চেষ্টা করা এবং একজন মানবিক রাষ্ট্রসেবক হওয়া। যেখানেই কাজ করার সুযোগ পাই সেখানেই রেখাপাত করতে চাই। রাষ্ট্রীয় সুবিধাদি প্রকৃত সুবিধাবঞ্চিতদের দোরগোড়ায় পৌঁছে দিতে চাই। দ্বিতীয়ত আমার মতো বা আমার চেয়েও কঠিন পথ পাড়ি দিয়ে যারা নিজের ক্যারিয়ার গঠনের জন্য সংগ্রাম করে যাচ্ছে বা যাবে, নিজের সীমিত জ্ঞান বা মেধার ব্যবহারে তাদের জন্য অনলাইন প্ল্যাটফর্মে চাকরিসংক্রান্ত বিভিন্ন বিষয়ে বিনামূল্যে ক্লাস নিতে চাই। বিষয়টা কষ্টসাধ্য তবে আমার দ্বারা একজন বেকার ভাইবোনেরও যদি উপকার হয় তাহলেই আমি তৃপ্ত।’

তরুণ শিক্ষার্থীদের উদ্দেশ্যে তিনি বলেন, ‘সোনার চামচ মুখে দিয়ে জন্মানোর মাধ্যমে নিজের কোনো গৌরব নাই। নিজ পরিশ্রমে অর্জিত রূপার চামচ দিয়ে খেতে পারাই পরম তৃপ্তির। কারো বক্তৃতা শুনে মোটিভেটেড হওয়া যায় কি না আমি জানি না, তবে নিজের বাবা মায়ের মুখে হাসি ফোটানোর চেষ্টার চেয়ে বড় মোটিভেশন আর কিছুই নেই।’


সর্বশেষ সংবাদ