ছাত্রলীগের সাবেক শীর্ষ নেতৃত্ব

৫৭ জনের মধ্যে ১৭ জনই দলছুট

ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি-সাধারণ সম্পাক
ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি-সাধারণ সম্পাক

৭৫ বছরে পা দিয়েছে বাংলাদেশ ছাত্রলীগ। ১৯৪৮ সালের আজকের দিনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফজলুল হক মুসলিম হলে সংগঠনটির প্রতিষ্ঠা করেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। প্রতিষ্ঠার পর থেকে এখন পর্যন্ত ৫৭ জন ছাত্রলীগের শীর্ষ পদে দায়িত্ব পালন করেছেন। এদের মধ্যে পরবর্তীতে ১৭ জন সাবেক শীর্ষ নেতা আদর্শচ্যুত হয়ে ভিন্ন দলে যোগ দিয়েছেন। কেউ কেউ অভিমানে দূরে সরেছেন রাজনীতি থেকে।  

ছাত্রলীগের প্রথম কমিটির আহ্বায়ক নঈমউদ্দিন আহমদ শৃঙ্খলা ভঙ্গের দায়ে সংগঠন থেকে বহিষ্কার হন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীদের ধর্মঘটে সমর্থন করায় বঙ্গবন্ধুসহ অন্যদের সঙ্গে নঈমউদ্দিনও বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের শাস্তির মুখোমুখি হন। কিন্তু নইমউদ্দিন জরিমানা ও বন্ড সই দিয়ে ছাত্রত্ব ফেরত নিলে সংগঠনের স্বার্থ পরিপন্থী কাজের অভিযোগে ছাত্রলীগের আহ্বায়কের পদ থেকে বহিষ্কার করা হয়। পরে অবশ্য যুক্তফ্রন্টের ব্যানারে পূর্ব পাকিস্তান প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য (এমএলএ) নির্বাচিত হলেও আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে নিজেকে ধরে রাখতে পারেননি।

ছাত্রলীগের প্রথম সভাপতি দবিরুল ইসলামও ছাত্র রাজনীতি শেষ করার পর ৫৪’র নির্বাচনে আওয়ামী লীগ থেকে এমএলএ নির্বাচিত হন। তবে ‍যুক্তফ্রন্ট ভেঙ্গে যাওয়ার পর তিনি বঙ্গবন্ধুর পক্ষ ত্যাগ করে আবু হোসেনের কৃষক শ্রমিক পার্টির সরকারের প্রতিমন্ত্রী হন। যার কারণে শৃঙ্খলা ভঙ্গের অভিযোগে আওয়ামী লীগ থেকে বহিষ্কার হন।

আরও পড়ুন- ছাত্রলীগ নেতাকর্মীদের মন ভালো নেই

একই কারণে বহিষ্কার হন ছাত্রলীগের প্রথম সাধারণ সম্পাদক ও যুক্তফ্রন্টের এমএলএ খালেক নেওয়াজ খান। যুক্তফ্রন্ট ভেঙ্গে যাওয়ার পর তিনি শেরেবাংলার পার্লামেন্টারি সচিবের পদ গ্রহণ করেন।

১৯৫৩-৫৭ সালে ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক এমএ আউয়াল জাসদে যোগ দিয়ে প্রভাবশালী হয়ে ওঠেন। ’৭৩ সালের প্রথম সংসদ নির্বাচনে বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে প্রার্থী হয়ে জামানত হারান। 

১৯৬০-৬৩ সালে ছাত্রলীগের সভাপতির দায়িত্বে থাকা শাহ মোয়াজ্জেম হোসেন প্রথম সংসদের চিফ হুইপ ছিলেন। আওয়ামী লীগের মনোনয়নে ‘৭০ ও ‘৭৩ সালের নির্বাচনে সংসদ সদস্য হন। বঙ্গবন্ধু হত্যার পর তিনি মোশতাক সরকারের প্রতিমন্ত্রী এবং তার সঙ্গে মিলে ডেমোক্র্যাটিক লীগ গঠন করেন। জাতীয় চার নেতা হত্যা মামলার অন্যতম আসামি শাহ মোয়াজ্জেম পরবর্তী সময়ে জেনারেল এরশাদের দলে যোগ দিয়ে উপপ্রধানমন্ত্রী হন। জাতীয় পার্টির মহাসচিব হওয়া শাহ মোয়াজ্জেম এরশাদকে ত্যাগ করে পাল্টা জাতীয় পার্টি গঠন করেন এবং সর্বশেষ বিএনপিতে যোগ দেন। তিনি বর্তমানে বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান।

১৯৬৩-৬৫ সালে ছাত্রলীগের সভাপতি কেএম ওবায়দুর রহমান বঙ্গবন্ধু সরকারের প্রতিমন্ত্রী ছিলেন। বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর তিনি মোশতাক সরকারের প্রতিমন্ত্রী হন। জেনারেল জিয়ার আমলে মন্ত্রী এবং পরে খালেদা জিয়ার আমলে বিএনপির মহাসচিব পদ থেকে বহিষ্কৃত হন। ‘জনতা দল’ নামে একটি রাজনৈতিক দল গঠন করলেও ১৯৯৬ সালে আবারও বিএনপিতে ফেরত আসেন। প্রয়াত এই নেতার মেয়ে  বর্তমানে বিএনপির রাজনীতিতে জড়িত।

কে এম ওবায়দুরের নেতৃত্বাধীন ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক সিরাজুল আলম খান স্বাধীনতা পর জাসদ গঠনে নেপথ্য ভূমিকা পালন করেন। বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের প্রবক্তা সিরাজুল আলম খানের অনুপ্রেরণায় শাজাহান সিরাজের নেতৃত্বাধীন ছাত্রলীগের একাংশ পাল্টা ছাত্রলীগ গঠন করে। যারা জাসদ ছাত্রলীগ নামে পরিচিতি লাভ করে। সিরাজুল আলম খান পরবর্তী সময়ে প্রত্যক্ষ রাজনীতি থেকে অদৃশ্য হয়ে যান। বর্তমানে তিনি রাজনীতি থেকে পুরোপুরি নির্বাসনে রয়েছেন।

১৯৬৭-৬৮ সালে ছাত্রলীগের সভাপতি ফেরদৌস আহমেদ কোরেশী আওয়ামী লীগের রাজনীতি থেকে দূরে সরে পড়েন স্বাধীনতার আগেই। জিয়ার শাসনামলে বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব হলেও লাইমলাইটে আসতে পারেননি। ২০০৪ সালে তিনি বাংলাদেশের ‘গ্রিন পার্টি’ গঠন করেন। ওয়ান-ইলেভেনের সময় তিনি কিং পার্টিখ্যাত প্রগতিশীল গণতান্ত্রিক পার্টি (পিডিপি) গঠন করে নির্বাচন কমিশনের নিবন্ধনও পান।

১৯৬৮-৬৯ সালে ছাত্রলীগের সভাপতি আব্দুর রউফ। তিনি সভাপতির পদ থেকে এক পর্যায়ে বহিষ্কারও হন। প্রথম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তিনি আওয়ামী লীগের এমপি হন। বঙ্গবন্ধু নিহত হওয়ার পর খুনি মোশতাকের আমলে সংসদে চিফ হুইপ হন। অবশ্য তার পরিবারের দাবি— মোশতাক তাকে চিফ হুইপ করলেও তিনি ওই পদের দায়িত্ব নেননি। পরে  আওয়ামী লীগে ফিরে ১৯৮৬ ও ১৯৯১ সালে আওয়ামী লীগের মনোনয়নে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। পরে তিনি ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বাধীন গণফোরামে যুক্ত হন। তিনি গণফোরামের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য থাকা অবস্থায় ২০১১ সালে মারা যান।

আরও পড়ুন- নেতাকর্মীদের এড়িয়ে চলছেন ছাত্রলীগের জয়-লেখক

১৯৬৯-৭০ মেয়াদে ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক আ স ম আব্দুর রব স্বাধীনতার পর সিরাজুল আলম খানের বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের পক্ষে অবস্থান নেন এবং ছাত্রলীগের পাল্টা নেতৃত্ব সৃষ্টি করেন। তিনি জাসদের প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদক। ১৯৮৮ সালে এরশাদের ভোটারবিহীন নির্বাচনে গিয়ে বিরোধীদলের নেতা হন। ১৯৯৬ সালে শেখ হাসিনার ঐকমত্যের সরকারের মন্ত্রী হন। বর্তমানে নিজের প্রতিষ্ঠিত জেএসডি নিয়ে তিনি সরকারবিরোধী জোট ঐক্যফ্রন্টে রয়েছেন।

১৯৭০-৭২ মেয়াদে মুক্তিযুদ্ধের সময় ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় সভাপতি ছিলেন নূরে আলম সিদ্দিকী। স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধু তাকে যুবলীগের প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব দেন। তবে তিনি ছিলেন বাকশালবিরোধী। প্রথম সংসদের এমপি নূরে আলম বাকশালে যোগ না দিয়ে রাজনীতি থেকে নিষ্ক্রীয় হয়ে যান। পরে অবশ্য আওয়ামী লীগে ফিরে এসে ১৯৯৬ ও ২০০১ সালে নির্বাচন করে পরাজিত হন। এরপর থেকে তিনি রাজনীতিতে নিষ্ক্রীয় রয়েছেন। তবে ‘সাবেক ছাত্রলীগ ফাউন্ডেশন’ নামে একটি সংগঠন প্রতিষ্ঠা করেছেন। তার ছেলে তাহজীব আলম সিদ্দিকী বর্তমানে আওয়ামী লীগের এমপি।

নূরে আলম সিদ্দিকীর সময়ে সাধারণ সম্পাদক ছিলেন শাজাহান সিরাজ। দেশ স্বাধীন হওয়ার ৬ মাসের মাথায় ছাত্রলীগে ভাঙন দেখা দেয়। এ সময় ‘মুজিববাদী’ হিসেবে পরিচিত অংশের নেতৃত্ব দেন নূরে আলম সিদ্দিকী। আর শাজাহান সিরাজের অংশটি ‘বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রী’ হিসেবে পরিচিত হয়। এই অংশটি পরবর্তী সময়ে জাসদ সমর্থিত ছাত্রলীগ নামে আত্মপ্রকাশ করে। শাজাহান সিরাজ জাসদের টিকিটে তিন বার সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। এরপর তিনি বিএনপিতে যোগ দিয়ে মন্ত্রীসভার সদস্য হন।

১৯৭২-৭৩ সালে ছাত্রলীগের সভাপতি হন শেখ শহীদুল ইসলাম। শেখ শহীদ বঙ্গবন্ধু হত্যার পর রাজনীতি থেকে সরে দাঁড়ান। পরে জেনারেল এরশাদের মন্ত্রী হন। বর্তমানে তিনি আনোয়ার হোসেন মঞ্জুর নেতৃত্বাধীন জেপির মহাসচিব।

১৯৭৩-৭৪ মেয়াদে ছাত্রলীগের সম্মেলনে নির্বাচিত সভাপতি মনিরুল হক চৌধুরী এরশাদের জাতীয় পার্টির চিফ হুইপ ছিলেন। ২০০১ সালে তিনি বিএনপি থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। বর্তমানে বিএনপির নেতা।

ওই কমিটির সাধারণ সম্পাদক শফিউল আলম প্রধান সেভেন মার্ডারের দায়ে ছাত্রলীগ থেকে বহিষ্কৃত হন এবং ১৪ বছর সাজা লাভ করেন। জেনারেল জিয়ার আমলে মুক্তি পেয়ে ‘জাগপা’ নামে দল গঠন করেন। মৃত্যু পর্যন্ত তিনি তার দল নিয়ে বিএনপি জোটে ছিলেন।

আরও পড়ুন- বাসায় নিঃসঙ্গ থাকছেন শোভন-রাব্বানী

১৯৮৫-৮৮ সাল পর্যন্ত ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় সভাপতি ছিলেন সুলতান মোহাম্মদ মনসুর আহমেদ। মুক্তিযুদ্ধের পর ডাকসু নির্বাচনে ছাত্রলীগের প্যানেল থেকে তিনিই প্রথম ভিপি নির্বাচিত হন। এর আগে আওয়ামী লীগ থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হলেও একাদশ সংসদ নির্বাচনে গণফোরামের মনোনয়ন পেলে ঐক্যফ্রন্ট থেকে ধানের শীষ প্রতীকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন।

১৯৮৮-৯২ সাল পর্যন্ত ছাত্রলীগের সভাপতি ছিলেন হাবিবুর রহমান হাবিব। পরে ছাত্রলীগের রাজনীতি ছেড়ে যোগ দেন বিএনপিতে। তিনি বর্তমানে বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতা।


সর্বশেষ সংবাদ