শহীদ ছেলের লাশ খুঁজে পেতে দেরি, চাকরি গেছে বাবা সবুজ বেপারীর

পারভেজ বেপারি
পারভেজ বেপারি   © সংগৃহীত

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনে রাজধানীর উত্তর বাড্ডায় নাকে ও কপালে গুলিবিদ্ধ হয়ে শহীদ হন মো. পারভেজ বেপারি। এটি ছিল ১৯ জুলাইয়ের ঘটনা; কিন্তু তার পরিবার জানতে পারে ২১ জুলাই। ছেলের নিহত হওয়ার খবর পেয়ে তাকে খুঁজতে ঢাকায় যান বাবা। ছেলের লাশের সন্ধান পেতে পেতে পেরিয়ে যায় প্রায় ১৫ দিন। এরই মধ্যে চাকরিটিও চলে যায় পারভেজের বাবা সবুজ বেপারির।

শহীদ পারভেজ (২৩) চাঁদপুরের মতলব উত্তর উপজেলার ফতেপুর পূর্ব ইউনিয়নের বারহাতিয়া গ্রামের বেপারিবাড়ির মো. সবুজ বেপারি (৫০) ও শামছুন্নাহার (৪৫) দম্পতির একমাত্র পুত্রসন্তান। চার ভাই-বোনের মধ্যে পারভেজ বড়। বাবার আয় যৎসামান্য। তাই কাঠমিস্ত্রি পারভেজের আয়ের টাকায় সংসারের পাশাপাশি তিন বোনের পড়ালেখার খরচও চলতো।

সরেজমিনে শহীদ পারভেজের বাড়িতে গিয়ে কথা হয় তার মা ও বোনদের সঙ্গে। দরিদ্র পরিবারে জন্ম পারভেজের। বাবা সবুজ বেপারি ঢাকা-চাঁদপুর রুটে চলাচলকারী এমভি সোনারতরী-১ লঞ্চের খাবারের ক্যান্টিনে কাজ করতেন। ছেলের খোঁজ করতে গিয়ে কাজে যেতে না পারায় চাকরি হারিয়েছেন সবুজ বেপারি। মা শামছুন্নাহার গৃহিণী। 

একমাত্র ছেলে পারভেজ ভাই-বোনদের মধ্যে বড়। তার তিন বোনের মধ্যে বড় বোন নূপুর আক্তার (১৮) এ বছর এইচএসসি পরীক্ষা দিয়ে ৩.৫৩ পেয়ে উত্তীর্ণ হয়েছে। দ্বিতীয় বোন ঝুমুর আক্তার (১৫) দশম শ্রেণিতে এবং ছোট বোন খাদিজা আক্তার (১২) ৬ষ্ঠ শ্রেণিতে অধ্যয়নরত।

শহীদ পারভেজের চাচাতো ভাই মমিন জানান, পারভেজ উত্তর বাড্ডার পূর্বাচল রোডে ফার্নিচারের দোকানের মিস্ত্রি ছিলেন। সেখান থেকে ১৯ জুলাই সন্ধ্যায় তার সহকর্মী রাকিবসহ কয়েকজন উত্তর বাড্ডায় ছাত্র-জনতার আন্দোলনে যোগ দেন। এ সময়ে গুলিবিদ্ধ হলে উত্তর বাড্ডার একটি হাসপাতালে চিকিৎসা নেন। সেখান থেকে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ তাকে উন্নত চিকিৎসার জন্য ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে পাঠায়। ঢাকা মেডিক্যালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় পারভেজ মারা যান।

তবে প্রথমে তার সন্ধান না পাওয়া গেলেও ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ মৃত ব্যক্তিদের তালিকা প্রকাশ করে ২৮ জুলাই। সেখানে পারভেজের নাম ছিল। ওই তালিকার সূত্র ধরেই পরিবারের লোকরা তার মরদেহের ছবি শনাক্ত করেন।

পারভেজের বাবা সবুজ বেপারী বলেন, ২১ জুলাই আমার ছেলের অফিসের লোকজন বাড়িতে খবর দেয় পারভেজ নিখোঁজ। পরে লোকজন নিয়ে তাৎক্ষণিক ঢাকায় চলে যাই। ওই দিন রাত ১০টায় ঢাকা মেডিকেলে গিয়ে খোঁজ নেই। সেখানে তার সন্ধান পাইনি। সেখানে মৃতদের তালিকায়ও তার কোন নাম পাইনি। এরপর চিন্তা করলাম যদি পুলিশ ধরে নিয়ে যায় তাহলে থানাগুলোতে নাম থাকবে। যে কারণে বাড্ডা, রামপুরা ও হাতিরঝিল থানায় যাই। সেখানেও তার কোন খোঁজ পাইনি। অনেকটা ছেলের খোঁজ পাওয়ার আশা ছেড়ে দেই।

তিনি আরো বলেন, ঢাকা থেকে বাড়িতে চলে আসার পর ৮ আগস্ট আমাদের এলাকার বাসিন্দা মাসুদ সরকার ফোনে জানান তিনি একটি তালিকায় পারভেজের নাম দেখেছেন। ওইদিনই ঢাকায় চলে যাই এবং ঢাকা মেডিকেল কলেজ মর্গে খোঁজ নেই। সেখানকার একজন পরিচ্ছন্নতা কর্মীর সাথে কথা হয় মর্গে থাকা লোকজন সম্পর্কে। সেখানে সে আমাকে দুইজনের ছবি দেখায়। প্রথম ছবিই আমার ছেলের। ওই সময় আমার মর্গে থাকা লোকজনের সাথে কথা কাটাকাটি হয়। 

কারণ এর আগেও আমি তাদের কাছে এসে সন্ধান করি। তখন তারা আমাকে কোন সহযোগিতা করেনি।  তাদের কাছেই জানতে পারি, আমার ছেলের লাশ আঞ্জুমানে মফিদুল ইসলামে হস্তান্তর করা হয়েছে। একই সাথে অজ্ঞাতনামা ৮জনের মরদেহ ছিলো। তাদের কোথায় দাফন করা হয়েছে জানার জন্য আঞ্জুমানে মফিদুল ইসলামের কাকরাইল ও মুগদা অফিসে যাই। তারা সঠিকভাবে বলতে না পারলেও ধারণা করেছেন জুরাইন গনকবরস্থানে দাফন করা হয়েছে।

সবুজ বেপারী জানান, পারভেজের মরদেহ খুঁজে না পেয়ে মর্গে থাকা ছবি শনাক্ত করে তিনি বাড়িতে চলে আসেন। গত ৯ আগস্ট বিকেলে তাদের বাড়ির কাছে সরকার বাড়ি জামে মসজিদের সামনে গায়েবানা নামাজে জানাজা পড়া হয়। সেখানে স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও গণমাধ্যম কর্মীরা উপস্থিত ছিলেন। পারভেজের মা শামছুন্নাহার আক্ষেপ করে বলেন, ‘ছেলে আমার শহীদ হলেও একবার নিজ হাতে ছুঁয়ে দেখতে পারিনি। জন্মস্থানের মাটিও কপালে হয়নি আমার ছেলের।’

পারভেজের বোনদের মধ্যে বড় নুপুর আক্তার বলেন, ভাইয়ের সাথে আমার সর্বশেষ কথা হয় ১৬ জুলাই। এরপর ইন্টারনেট বন্ধ ছিলো। এজন্য শেষের তিনদিন কথা হয়নি। সব সময় পড়ালেখার খোঁজ খবর নিতেন। ভাইয়ের কাছে কোন কিছুর আবদার করলে তা দেয়ার জন্য চেষ্টা করতেন। আমার ভাইকে যারা গুলি করে মেরেছে তাদের বিচার চাই। ভাইয়ের অবর্তমানে আমাদের সংসার চালানোর মত কেউ নেই। তাই এবার আমি এইচএসসি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হলেও ভবিষ্যতের পড়াশুনা আমার অনিশ্চিত।

পারভেজের মা শামছুন্নাহার বলেন, সংসারের অভাব অনটনের কারণে ছেলে আমার পড়ালেখা বেশি করতে পারেনি। স্থানীয় রসূলপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে মাত্র তৃতীয় শ্রেণীতে পর্যন্ত পড়েছে। এরপর এলাকায় কাঠমিস্ত্রির কাজ শেখে। তারপর ছোট বয়সেই ঢাকায় চলে যায়। ঢাকায় গিয়ে গত প্রায় ৮ বছর কাজ করে। সবশেষ বাড্ডা পূর্বাচল রোডে এ+ এন ফার্নিচারের দোকানে কাজ করতো। 

ওই প্রতিষ্ঠানির মালিক মো. আলী আহম্মদ তাকে অনেক আদর করতো। ছেলের আয় দিয়ে আমাদের সংসারের অধিকাংশ খরচ মিটত। মেয়েদের পড়ার খরচও আমার ছেলেই যুগিয়েছে। এখন ছেলেকে হারিয়ে আমাদের সংসারের আয় রোজগারও বন্ধ।  ছেলের বাবার চাকরিটা চলে যাওয়ায় আমরা আরো বিপদে পড়েছি। আমরা এখন কি করবো? কি করে চলবে সংসার ও মেয়েদের পড়াশুনা?

পারভেজের সাথে শেষ দেখার স্মৃতিচারণ করে সবুজ মিয়া বলেন, গত কোরবানির ঈদের ১৫দিন পরে আমি বাড়িতে আসলে ছেলের সাথে দেখা হয়। এরপর আর কথা হয়নি। ছেলের খোঁজ করতে গিয়ে আমার চাকরি চলে  গেছে। আমি যে লঞ্চের খাবার কেন্টিনে কাজ করতাম,  দেড় মাস আগে তার মালিকের সাথে যোগাযোগ করলে চাকরিতে যোগ দিতে নিষেধ করেন।

তিনি জানান, পারভেজের শোকাহত পরিবারকে সান্তনা দিতে স্থানীয় রাজনৈতিক দলের লোকজন বাড়িতে এসে খোঁজ খবর নিলেও এখনও পর্যন্ত সাহায্য আসেনি। তবে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা লোকজন দিয়ে ১০ হাজার টাকা এবং কিছু ফল পাঠিয়েছেন। এ অবস্থায় প্রশাসনের কাছে নিজের এবং তার এইচএসসি পাশ বড় মেয়ের জন্য চাকরির ব্যবস্থা করার অনুরোধ জানান তিনি।

সূত্র: বাসস


সর্বশেষ সংবাদ

×
  • Application Deadline
  • December 17, 2025
  • Admission Test
  • December 19, 2025
APPLY
NOW!
GRADUATE ADMISSION
SPRING 2026!
NORTH SOUTH UNIVERSITY
Center of Excellence