কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়
ছাত্রলীগের নেতৃত্বে আসতে সক্রিয় হত্যা মামলার আসামিসহ বিতর্কিতরা
- ওমর হায়দার
- প্রকাশ: ০৮ অক্টোবর ২০২৩, ০৮:২২ PM , আপডেট: ০৯ অক্টোবর ২০২৩, ০৮:৫৩ AM
রাত পোহালেই কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয় (কুবি) শাখা ছাত্রলীগের কর্মীসভা। গত ৬ মার্চ কমিটি বিলুপ্তির প্রায় সাত মাস পর এ কর্মীসভা আহবান করে কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগ। এতে প্রায় অর্ধশতাধিক পদপ্রার্থীর মধ্যে আশার সঞ্চার হয়েছে। আবার কর্মীসভাকে কেন্দ্র করে সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক পদ প্রত্যাশীদের মধ্যে সোচ্চার হতে দেখা গিয়েছে হত্যা মামলার আসামী, ব্যবসায়ী, অছাত্র, বয়স্ক এবং বিতর্কিত নেতাকর্মীরা। অনেকেই ছাত্রত্ব টিকিয়ে রাখতে বিশ্ববিদ্যালয়ের উইকেন্ড কোর্সে ভর্তি আছেন। শাখা ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের আশা, অছাত্র এবং বিতর্কিতদের বাদ দিয়ে শাখা ছাত্রলীগের নেতা বাছাই করবে কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগ।
স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ার লক্ষ্যে ছাত্রসমাজ ও তরুণ প্রজন্মকে ঐক্যবদ্ধ করতে এবং সাংগঠনিক গতিশীলতা বৃদ্ধি করতে আগামীকাল সোমবার (৯ অক্টোবর) কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের কর্মীসভা আহ্বান করেছে কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগ।
আরও পড়ুন: নিয়মের তোয়াক্কা না করে দেড় কোটি টাকায় কুবি ভিসির গাড়িবিলাস
এরই মধ্যে গত ৫ অক্টোবর সুষ্ঠুভাবে কর্মীসভা আয়োজনের লক্ষ্যে দায়িত্বপ্রাপ্ত কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দ শাখা ছাত্রলীগের নেতাদের নিয়ে মতবিনিময় সভাও করেছেন। এতে অংশগ্রহণ করেন প্রায় অর্ধশত পদপ্রার্থী। সভাপতি-সম্পাদক পদে আসতে কেন্দ্রীয় ও স্থানীয় প্রভাবশালী নেতাদের দারস্থ হচ্ছেন অনেকে। তবে খোঁজে নিয়ে দেখা যায়, মাঠপর্যায়ের নেতা-কর্মীদের মধ্যে প্রাণচাঞ্চল্য ফিরলেও অবমূল্যায়িত হওয়ার শঙ্কায় রয়েছেন অনেকে।
পদ-প্রত্যশীদের মধ্যে রয়েছেন কাজী নজরুল ইসলাম হলের সভাপতি নাজমুল হাসান পলাশ, শহীদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত হলের সাধারণ সম্পাদক এনায়েত উল্লাহ, নওয়াব ফয়জুন্নেছা চৌধুরাণী হলের সভাপতি ইসরাত জাহান জেরিন, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হলের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি তাহারাতবির পাপন মিয়াজি, ২০১৭ সালে বিলুপ্ত তৎকালীন কমিটির সাধারণ সম্পাদক রেজা-ই-এলাহী, কাজী নজরুল ইসলাম হলের সাবেক সভাপতি ইমরান হোসেন, সাবেক সহসভাপতি মেহেদী হৃদয়, শাখা ছাত্রলীগের সাবেক যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক স্বজন বরণ বিশ্বাস, সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক মেজবাউল হক শান্ত, ইমাম হোসেন মাসুম ও আবু সাদাৎ মো. সায়েম, ব্যবসায় প্রশাসন অনুষদের সাধারণ সম্পাদক সালমান চৌধুরী, ইকবাল খান, মুমিন শুভসহ প্রায় অর্ধশত নেতা।
আরও পড়ুন: দেশে দুর্নীতি হচ্ছে বলেই উন্নতি হচ্ছে: কুবি উপাচার্য
ছাত্রলীগের গঠনতন্ত্র অনুযায়ী অনুর্ধ্ব-২৯ বয়সী বাংলাদেশের যেকোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ছাত্র বা ছাত্রী ছাত্রলীগের প্রাথমিক সদস্য হতে পারেন। তবে সদস্যপদ ঠিক রাখার মূল শর্ত হলো শিক্ষাজীবন অব্যাহত থাকা। কিন্তু কুবি ছাত্রলীগের পদপ্রত্যাশীদের মধ্যে অনেকেরই ছাত্রত্ব নেই এবং বয়স উত্তীর্ণ।
এর মধ্যে রয়েছেন বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক রেজা-ই-এলাহী। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, রেজা ২০১০-১১ শিক্ষাবর্ষে লোকপ্রশাসন বিভাগে ভর্তি হয়ে ২০১৬ সালে স্নাতক শেষ করেন। শিক্ষাগত যোগ্যতার সনদ অনুযায়ী রেজার বয়স বর্তমানে ৩২। ২০১৪ সালে ঘোষিত শাখা ছাত্রলীগের কমিটির সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। এরপর আরও একটি কমিটি দায়িত্ব পালন করেছে। ২০১৬ সালের আগস্ট মাসে দু’গ্রুপের সংঘর্ষে বিশ্ববিদ্যালয়ের মার্কেটিং বিভাগের ২০১২-১৩ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থী ও কাজী নজরুল ইসলাম হলের তৎকালীন সাংগঠনিক সম্পাদক খালিদ সাইফুল্লাহ নিহত হন। এ হত্যা মামলার এজাহারভুক্ত আসামি রেজা-ই-এলাহী। তার বিরুদ্ধে ২০২০ সালের ৮ মার্চ বরুড়ার তালুকপাড়া গ্রামের এক নারীকে ধর্ষণ চেষ্টা, ভাঙচুর, জালিয়াতি ও লুটতরাজের একটি মামলাও বিচারাধীন রয়েছে। এছাড়া তার বিরুদ্ধে বহিরাগত কর্তৃক ক্যাম্পাসে প্রতিপক্ষের উপর হামলাসহ নানা অভিযোগ রয়েছে।
বিশ্ববিদ্যালয় শাখার এক নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, কর্মীসভাকে কেন্দ্র করে হত্যা, ধর্ষণ, লুটতরাজের মামলার আসামীরা সোচ্চার রয়েছেন। পদপ্রত্যাশী রেজা-ই-এলাহীর বয়স ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের চেয়েও বেশি।
২০১৭ সালে বিলুপ্ত কমিটির সাধারণ সম্পাদক রেজা-ই-এলাহী বলেন, আমার ছাত্রত্ব বা বয়স আছে কি নেই এটা কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগ বিবেচনা করবে। কমিটি দেওয়ার ক্ষেত্রে তাঁরা অবশ্যই যোগ্যদেরকে বিবেচনা করবে। নেতৃত্বে আসতে পারলে সবসময় সাধারণ শিক্ষার্থীদের যৌক্তিক দাবিতে পাশে থাকবো।
আরেক প্রার্থী স্বজন বরণ বিশ্বাস নৃবিজ্ঞান বিভাগের স্নাতক ২০১২-১৩ সেশনের শিক্ষার্থী। তিনিও খালেদ সাইফুল্লাহ হত্যার ২ নম্বর চার্জশিটভুক্ত আসামি। এই মামলায় ৫৫ দিন জেলও খেটেছেন তিনি। এছাড়া তার বিরুদ্ধে মাদকসেবন ও চুরিসহ বিভিন্ন অভিযোগ রয়েছে। ২০১৮ সালে শৃঙ্খলাভঙ্গের অভিযোগে তাকে ছাত্রলীগ থেকে বহিষ্কারও করা হয়।
আরও পড়ুন: ‘রাজনৈতিক নিয়োগে বেপরোয়া হয়ে উঠেছেন উপাচার্যরা’
অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে স্বজন বরণ বিশ্বাস দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, আমাকে প্রতিহিংসার কারনে ছাত্রলীগ থেকে বহিষ্কার করা হয়। ২০১৯ সালে সেই বহিষ্কার উঠানো হয়। হত্যামামলার আসামী বিষয়ে জানতে চাইলে বলেন, খালেদ আমার বন্ধু ছিল। আমি তাকে হত্যা করতে যাবো কেন। এটাও প্রতিহিংসা করে তৎকালীন বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগ সভাপতি-সাধারণ সম্পাদক আমার নাম ডুকিয়েছে। সেই মামলা এখনো চলছে বলে তিনি জানান।
ইকবাল ফিন্যান্স অ্যান্ড ব্যাংকিং বিভাগের স্নাতক ২০১৪-১৫ সেশনের শিক্ষার্থী। তিনি শাখা ছাত্রলীগের কোনো পর্যায়ের কর্মী বা সমর্থক ছিলেন না এবং কোনো ধরনের সাংগঠনিক কার্যক্রমে সংযুক্ত ছিলেন না বলেও অভিযোগ রয়েছে। তার নেতৃত্বে ক্যাম্পাসে বহিরাগতদের মোটরবাইক শোডাউন ও বঙ্গবন্ধু হলে ভাঙচুরের ঘটনাও ঘটেছে।
জানতে চাইলে ইকবাল দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, বাইক দিয়ে শোডাউন দিয়েছে রেজা ভাই। আমি সাথে ছিলাম,কিন্তু কোনো ভাঙচুর করিনি। বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো পযায়ের কোনো পদে কেন ছিলেননা জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমরা আলিফ কমিটির অনুসারী থাকায় ইলিয়াস কমিটিতে পদায়ন হয়নি। তাই কোনো পদ নেই বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগে।
আরেক পদপ্রার্থী ফয়সাল। যিনি কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রই নন। একটি কলেজ থেকে ডিগ্রি শেষ করেছেন। বর্তমানে তিনি ব্যবসা করছেন। ছাত্রত্ব টিকিয়ে রাখতে বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যবস্থাপনা শিক্ষা বিভাগের সান্ধ্যকালীন কোর্সে ভর্তি আছেন।
জানতে চাইলে পদপ্রত্যাশী ফয়সাল দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, আমি কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের অরজিনাল ছাত্র না হলেও সান্ধ্যকালীন ভর্তি আছি। সেই সূত্রে আমি ছাত্র। আমি গত ৬ বছর ধরে কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের প্রোগ্রামে অংশগ্রহণ করছি।
লোক প্রশাসন বিভাগের ২০১৬-১৭ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থী মমিন শুভর ছাত্রত্ব থাকলেও তাকে সংগঠনের নীতি-আদর্শ পরিপন্থি কর্মকাণ্ডে জড়িত থাকায় ও দলীয় শৃঙ্খলাভঙ্গের দায়ে অব্যাহতি দেয় শাখা ছাত্রলীগ।
গেল বছরের ১৭ মার্চ ক্যাম্পাস সংলগ্ন একটি বেসরকারি ব্যাংকের এটিএম বুথের সামনে স্থানীয় স্থানীয় ২৪ নং ওয়ার্ড ছাত্রদল নেতা রনি মজুমদারকে মারধর করেন ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত হলের সাধারণ সম্পাদক এনায়েত উল্লাহ। ২০১৯ সালের জানুয়ারিতে সে সময়কার ডাইনিং ম্যানেজার লিপি আক্তারকে রুমে নিয়ে সাউন্ড বক্সে উচ্চ স্বরে গান বাজিয়ে মারধর করেন ছাত্রলীগ নেত্রী ইসরাত জাহান জেরিন। এছাড়া তার বিবাহিত হওয়ার গুঞ্জন রয়েছে। গেল বছরের ৯ ও ১০ সেপ্টেম্বর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হল ও কাজী নজরুল ইসলাম হল ছাত্রলীগের সংঘর্ষে এ দুই হলের নেতৃত্ব দেন নজরুল হল সভাপতি নাজমুল হাসান পলাশ ও বঙ্গবন্ধু হলের নেতা আবু সাদাৎ মো. সায়েম।
কাজী নজরুল ইসলাম হলের সাবেক সভাপতি ইমরান হোসেন, শাখা ছাত্রলীগের সাবেক সহসভাপতি মেহেদী হৃদয় ও প্রচার সম্পাদক মো. রকিবুল হাসান রকিরও ছাত্রত্ব নেই। ছাত্রলীগ নেতা ইমাম হোসেন মাসুমকে দুপক্ষের মারামারিতে দেশীয় অস্ত্রহাতে মোহড়া দিতে দেখা গিয়েছে। এছাড়া সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক মেজবাউল হক শান্ত বিবাহিত বলে ক্যাম্পাসে গুঞ্জন রয়েছে। এছাড়া ব্যবসায় প্রশাসন অনুষদের সাধারণ সম্পাদক সালমান চৌধুরী, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হলের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি তাহারাতবির পাপন মিয়াজিসহ প্রায় সব নেতা-কর্মী কিংবা তাদের অনুসারীদের বিরুদ্ধে বিভিন্ন সময় নিজ দলের নেতাকর্মী ও শিক্ষার্থীদের মারধরের অভিযোগ রয়েছে।
নতুন কমিটিতে শিক্ষার্থীবান্ধব, ক্লিন ইমেজ, সৎ, যোগ্য নেতৃত্ব আসুক এমনটাই চাওয়া সাধারণ শিক্ষার্থীসহ ছাত্রলীগ নেতাকর্মীদের। অযোগ্য কাউকে শীর্ষ পদে বসালে সিট বাণিজ্য, ভর্তি বাণিজ্য, টেন্ডারবাজি, চাঁদাবাজিসহ নিরাপত্তা শঙ্কায় থাকবে বিশ্ববিদ্যালয় পরিবার। তবে সবকিছু ছাপিয়ে কুবি শাখা ছাত্রলীগের নতুন নেতৃত্বে কারা আসছেন, সেদিকেই তাকিয়ে আছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের শাখা ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা।
বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের সাথে কথা বলে জানা যায় , শিক্ষার্থীদের জন্য কাজ করার মানসিকতা সম্পন্ন কেউ নেতৃত্বে আসুক। ব্যাবসায়িক উদ্দেশ্যে ছাত্ররাজনীতিকে ব্যবহার করার মানসিকতা নিয়ে কেউ নেতৃত্বে না আসুক। আমি নেতৃত্বে আসতে পারলে প্রথমেই নারীদের সার্বিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে এবং নারী নেতৃত্ব তৈরিতে কাজ করবো। নিয়মতান্ত্রিক উপায়ে সাধারণ শিক্ষার্থীদের সমস্যা চিহ্নিত করে সে সমস্যাগুলো সমাধানের ক্ষেত্রে সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়ে কাজ করবো।
কর্মীসভার সমন্বয়ক কোহিনূর আকতার রাখি বলেন, কোনো হত্যা মামলার আসামী বিতর্কিতরা পদায়িত হবেনা। কমিটি হলে গঠনতন্ত্র মেনে কমিটি হবে। এ বিষয়ে আমাদের কেন্দ্রীয় সভাপতি এবং সাধারণ সম্পাদক অবগত আছেন।
জানা যায়, ২০১৭ সালের ১৩ মে বার্ষিক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। ২৮ মে ইলিয়াস হোসেন সবুজকে সভাপতি ও রেজাউল ইসলাম মাজেদকে সাধারণ সম্পাদক করে ১১ সদস্যের কমিটি ঘোষণা করে কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগ। গত ৬ মার্চ কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ে (কুবি) শাখা ছাত্রলীগের কমিটি বিলুপ্তির প্রায় সাড়ে ৭ মাস পর কর্মীসভা আহ্বান করেছে কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগ।