নিয়মের তোয়াক্কা না করে দেড় কোটি টাকায় কুবি ভিসির গাড়িবিলাস

অধ্যাপক ড. এ এফ এম আব্দুল মঈন ও তাঁর ব্যবহার করা নতুন ও পুরাতন দুটি গাড়ি
অধ্যাপক ড. এ এফ এম আব্দুল মঈন ও তাঁর ব্যবহার করা নতুন ও পুরাতন দুটি গাড়ি  © টিডিসি ফটো

ব্যক্তিগত ব্যবহারের জন্য নিয়মের তোয়াক্কা না করে প্রায় দেড় কোটি টাকা মূল্যের নতুন গাড়ি ক্রয়ের অভিযোগ উঠেছে কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ে (কুবি) উপাচার্য অধ্যাপক ড. এ এফ এম আব্দুল মঈনের বিরুদ্ধে। বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশনের (ইউজিসি) অনুমোদিত অর্থের বেশি খরচ, নতুন গাড়ি ক্রয় নির্দেশনা ভঙ্গ, পুরাতন গাড়ি অকেজো ঘোষণাকরণ নীতিমালা অমান্যের অভিযোগ উঠেছে তাঁর বিরুদ্ধে। অপরদিকে নিয়োগের ২ বছরেও বিশ্ববিদ্যালয় থেকে উপ-উপাচার্যের জন্য ক্রয় করা হয়নি কোনো গাড়ি। সম্প্রতি দুর্নীতির পক্ষে সাফাই গেয়ে বেশ সমালোচিত হয়েছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এই অধ্যাপক।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সম্প্রতি দেশের উচ্চশিক্ষার তদারক সংস্থা ইউজিসি ২০২২-২৩ অর্থ বছরের বরাদ্দ থেকে কুবি উপাচার্য এবং উপ-উপাচার্যের জন্য নতুন গাড়ি ক্রয়ে ১ কোটি ৮৮ লাখ টাকা বরাদ্দ দেয়। নিয়ম অনুসারে সে অর্থে উপাচার্য এবং উপ-উপাচার্যের জন্য দুটি নতুন গাড়ি ক্রয়ের বিধান থাকলেও তার কোনো তোয়াক্কা না করে শুধুমাত্র উপাচার্যের জন্য ১ কোটি ৪৭ লাখ টাকা মূল্যের গাড়ি কেনা হয়।

এছাড়াও বরাদ্দ থেকে উপ-উপাচার্যেরের জন্য কেনা হয়নি কোনো গাড়ি। আর এসব কাজে উপাচার্য তার পুরাতন গাড়িটি অকেজো ঘোষণা কিংবা নতুন গাড়ির বরাদ্দ বৃদ্ধির ক্ষেত্রে ইউজিসির কোন অনুমোদন নেননি। অপরদিকে কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্যের জন্য তাঁর নিয়োগের পর কোনো গাড়ি ক্রয় করা হয়নি। বর্তমানে তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রকল্প পরিচালকের একটি গাড়ি ব্যবহার করেন। যার মডেল মিতসুবিসি আউটল্যান্ডার।

গাড়ি ক্রয়ের বিষয়ে কথা বলতে চাইলে উপ-উপাচার্য অধ্যাপক ড. মো. হুমায়ুন কবির বলেন, উপাচার্য এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। আমি এ নিয়ে কোনো মন্তব্য করতে চাই না।

আরও পড়ুন: শিক্ষক নিয়োগে উপাচার্যের ‘স্বেচ্ছাচারিতায়’ বাদ পড়েছেন যোগ্যরা

এর আগে গত ৭ জুন ইউজিসি সচিব বরাবর নতুন ভার্সনের দুটি মিতসুবিসি পাজেরো স্পোর্টস কিউএক্স সমমান জিপ গাড়ি ক্রয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার স্বাক্ষরিত পত্রে অনুমোদনের জন্য আবেদন করা হয়। পরবর্তীতে আবেদনের প্রেক্ষিতে গত ১৩ জুন কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের ২০২২-২৩ অর্থবছরের বাজেটে সংশ্লিষ্ট খাতের বরাদ্দ হতে শর্তসাপেক্ষে উপাচার্য এবং উপ-উপাচার্যেরের দাপ্তরিক কাজে ব্যবহারের জন্য ২টি জিপ গাড়ি ক্রয়ের অনুমোদন দেয় ইউজিসি।

এতে দুটি গাড়ির অনুমোদনের জন্য আবেদন করা হলেও শুধুমাত্র উপাচার্যের জন্য বরাদ্দের চেয়ে বেশি অর্থ খরচ করে ক্রয় করা হয় একটি গাড়ি। যদিও চলতি বছরেই উপাচার্যের পুরাতন গাড়িটির মেরামতে প্রায় ৫ লাখ টাকা ব্যয় করা হয়। ফলে বর্তমানে উপাচার্য নতুন এবং পুরাতন দুটি গাড়িই ব্যবহার করছেন।

ভিসি ও প্রো-ভিসির জন্য দুটি গাড়ি ক্রয়ে বরাদ্দ ১ কোটি ৮৮ লাখ টাকা হলেও বিশ্ববিদ্যালয়ের শুধু ভিসির গাড়ি ক্রয়ে ব্যয় করা হয়েছে প্রায় ১ কোটি ৪৬ লাখ ৮৪ হাজার ৫০০ টাকা। নিয়োগের ২ বছরেও বিশ্ববিদ্যালয় থেকে উপ-উপাচার্যের জন্য কোনো গাড়ি ক্রয় করা হয়নি।

দেশের উচ্চশিক্ষার তদারক সংস্থা ইউজিসির অনুমোদনের শর্ত অনুযায়ী, বরাদ্দকৃত অর্থের বেশি ব্যয় করতে পারবে না বিশ্ববিদ্যালয়গুলো। একই সাথে অনুসরণ করতে হবে সরকারি গাড়ি ক্রয় নীতিমালা। এছাড়াও কারের অকেজো ঘোষণাকরণ নীতিমালা অনুসরণ করে পুরাতন গাড়িটি (প্রযোজ্য ক্ষেত্রে) অকেজো ঘোষণা করতে হবে এবং প্রযোজ্য ক্ষেত্রে ক্রয়কৃত গাড়ি যথাযথ প্রক্রিয়া অনুসরণ করে বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্গানোগ্রামে অন্তর্ভুক্ত করার মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো সুস্পটভাবে রয়েছে গড়ি ক্রয়ের শর্তে। এসব নিয়মের কোনো পরিপালন করেননি ‍কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য।

দুটি গাড়ি ক্রয়ে বরাদ্দ ১ কোটি ৮৮ লাখ টাকা হলেও বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থ ও হিসাব দপ্তরের তথ্য অনুযায়ী শুধু উপাচার্যের গাড়ি ক্রয়ে ব্যয় করা হয়েছে প্রায় ১ কোটি ৪৬ লাখ ৮৪ হাজার ৫০০ টাকা। পুরাতন গাড়ির মেয়াদের প্রায় ৬ বছর ৮ মাসের মাথায় আবারও নতুন গাড়িটি কেনা হয়। যদিও অর্থ মন্ত্রণালয়ের এক পরিপত্রে ১০ বছরের অধিক পুরোনো মোটরযান প্রতিস্থাপনের ক্ষেত্রে অর্থ বিভাগের অনুমোদনক্রমে ব্যয় নির্বাহ করার কথা জানানো হয়। এক্ষেত্রেও নির্দেশনা ভঙ্গ করেছে কুবি প্রশাসন।

আরও পড়ুন: ‘রাজনৈতিক নিয়োগে বেপরোয়া হয়ে উঠেছেন উপাচার্যরা’

অন্যদিকে নতুন গাড়ি কেনার বিষয়টি এখনো অগোচরে রয়েছে ইউজিসির। সংস্থাটির অর্থ ও হিসাব বিভাগের পরিচালক (অতিরিক্ত দায়িত্ব) মো. রেজাউল করিম হাওলাদার জানান, উপাচার্য গাড়ি কিনেছেন, বিষয়টি আমরা জানি না। আমাদের নথিতে এ রকম কোনো তথ্য নেই। আমার জানামতে গাড়ি ক্রয়ে বর্তমানে নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। নিষেধাজ্ঞার ফলে অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ে গাড়ির সংকট রয়েছে। বিষয়টি আমার জানা নেই।

যদিও নতুন গাড়ি ক্রয়ের ক্ষেত্রে ইউজিসির অনুমোদন পত্রে সরকারের অকেজো ঘোষণাকরণ নীতিমালা অনুসরণ করে পুরাতন গাড়িটি (প্রযোজ্য ক্ষেত্রে) অকেজো ঘোষণা করার কথা বলা হলেও মানা হয়নি সেই নির্দেশনাও। বর্তমানে বিষয়টি নিয়ে সমালোচনার সৃষ্টি হয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়পাড়ায়।

এ নিয়ে নাম প্রকাশ না করার শর্তে বিশ্ববিদ্যালয়ের এক জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা জানান, আমরা বিশ্ববিদ্যালয়কে সেবা দেই। উপাচার্য আমাদের নিয়ন্ত্রণ করেন। তিনি যেভাবে বলবেন আমাদের সেভাবেই কাজ করতে হবে। গাড়ি ক্রয়ের বিষয়ে কোনো মন্তব্য করতে পারব না।

আরও পড়ুন: দেশে দুর্নীতি হচ্ছে বলেই উন্নতি হচ্ছে: কুবি উপাচার্য

এ ঘটনায় বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ড. কাজী মোহাম্মদ কামাল উদ্দিন ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, উপাচার্য ব্যয় কমানোর কথা বলে বৃহস্পতিবারে শিক্ষার্থীদের বাস বন্ধ করে দিয়েছেন। অথচ নিজে দুটি গাড়ি ব্যবহার করছেন। গাড়ি ক্রয়ের নির্দেশনা হচ্ছে সুনির্দিষ্ট নিয়ম মেনে পুরাতন গাড়ি অকেজো ঘোষণা করে নতুন গাড়ি ক্রয় করবেন। সেটিও অমান্য করেছেন তিনি। 

গাড়ি ব্যবহারের অনুপযোগী হলে সেক্ষেত্রে অকেজো ঘোষণা করে নতুন গাড়ি ক্রয় করতে হয়। এক্ষেত্রে সুনির্দিষ্ট নিয়ম রয়েছে। সেটি অনুসরণ করতে হয়৷ আর কেউ যদি বরাদ্দের বেশি অর্থ খরচ করেন তাহলে সেটি অডিট আপত্তিতে পড়ে যাবে-ইউজিসি চেয়ারম্যান

তিনি বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যই যদি নিয়মের ব্যত্যয় করেন, তাহলে অন্য যারা আছেন তাদের অবস্থাটা কি হবে। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হিসেবে আমি প্রত্যাশা করি উপাচার্য সকল বিষয়ে সরকারি ও ইউজিসির নির্দেশনা পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে মেনে বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনা করবেন।

জানতে চাইলে ইউজিসির পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় ম্যানেজমেন্ট বিভাগের পরিচালক মোহাম্মদ জামিনুর রহমান জানান, পুরাতন গাড়ি অকেজো ঘোষণা করেই নতুন গাড়ি কিনতে হবে। একইভাবে ৯৪ লাখ টাকা বরাদ্দ হলে এর ভেতরেই গাড়ি ক্রয় করতে হবে। বেশি খরচ করা যাবে না। এক্ষেত্রে আমরা অনুমোদন পত্রে শর্তসমূহ উল্লেখ করেছি। শর্ত না মানা হলে পরবর্তীতে অভিযোগের প্রেক্ষিতে আমরা ব্যবস্থা নেব।

ইউজিসির চেয়ারম্যান (অতিরিক্ত দায়িত্ব) অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ আলমগীর জানান, গাড়ি ব্যবহারের অনুপযোগী হলে সেক্ষেত্রে অকেজো ঘোষণা করে নতুন গাড়ি ক্রয় করতে হয়। এক্ষেত্রে সুনির্দিষ্ট নিয়ম রয়েছে। সেটি অনুসরণ করতে হয়৷ আর কেউ যদি বরাদ্দের বেশি অর্থ খরচ করেন তাহলে সেটি অডিট আপত্তিতে পড়ে যাবে।

তবে এসব অনিয়মের বিষয়ে উপাচার্য অধ্যাপক ড. এ এফ এম আব্দুল মঈনের বক্তব্যের জন্য তার কার্যালয়ে গেলে তিনি ব্যস্ততার কথা বলে প্রতিবেদকের সাথে কোনো ধরনের সাক্ষাৎ করেননি। পরবর্তীতে মুঠোফোন ও ক্ষুদে বার্তাসহ একাধিক মাধ্যমে তার বক্তব্য নেওয়ার চেষ্টা করেও তার কোনো বক্তব্য পাওয়া সম্ভব হয়নি।


সর্বশেষ সংবাদ