ইউরোপের দেশ লিথুয়ানিয়ায় উচ্চশিক্ষা: কেন যাবেন, কী কী সুবিধা রয়েছে জেনে নিন

ইউরোপের দেশ লিথুয়ানিয়ায় উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করতে চাইলে জেনে নিন নানা বিষয়ে
ইউরোপের দেশ লিথুয়ানিয়ায় উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করতে চাইলে জেনে নিন নানা বিষয়ে  © সংগৃহীত

উচ্চশিক্ষার জন্য যেসব শিক্ষার্থী ইউরোপকে গন্তব্য হিসেবে বিবেচনা করেন, তাদের জন্য লিথুয়ানিয়া হতে পারে এক ব্যতিক্রমী ও সম্ভাবনাময় পছন্দ। ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও শেনজেনভুক্ত দেশ লিথুয়ানিয়া শুধু তার প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের জন্যই বিখ্যাত নয়, বরং আধুনিক শিক্ষাব্যবস্থা, আন্তর্জাতিক মানের বিশ্ববিদ্যালয় ও তুলনামূলকভাবে কম খরচে জীবনযাত্রার কারণে দেশটি শিক্ষার্থীদের জন্য ক্রমেই জনপ্রিয় হয়ে উঠছে।

বাল্টিক সাগরের পূর্ব উপকূলে অবস্থিত এই দেশটি সুইডেনের ঠিক বিপরীতে, যার রাজধানী ভিলনিয়াস এবং জনসংখ্যা প্রায় ২.৮ মিলিয়ন। ইউরোপের অন্যান্য দেশের তুলনায় লিথুয়ানিয়ায় জীবনযাত্রার ব্যয় অনেকটাই কম। স্নাতক ও স্নাতকোত্তর স্তরে ইংরেজি মাধ্যমে পড়াশোনার সুযোগ, শিক্ষার মান, ভাষাগত সুবিধা ও সাশ্রয়ী খরচের সমন্বয়ে আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থীদের জন্য লিথুয়ানিয়া হয়ে উঠেছে একটি আদর্শ শিক্ষাগন্তব্য।

কেন যাবেন লিথুয়ানিয়ায়

উচ্চ শিক্ষার ক্ষেত্রে ইউরোপের অন্যান্য দেশের তুলনায় লিথুয়ানিয়ার জীবনযাত্রার ব্যয় অনেক কম। এ দেশে রয়েছে অনেক সরকারি ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়। ইউরোপের অন্যান্য দেশে যেমন স্নাতক প্রোগ্রামে পড়তে গেলে সে দেশের ভাষায় পড়তে হয়, সে তুলনায় লিথুয়ানিয়াতে স্নাতক লেভেলে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে ইংরেজি মাধ্যমে পড়ানো হয়ে থাকে, যা আমাদের দেশের শিক্ষার্থীদের জন্য অনেক সুবিধাজনক। এসব দিক বিবেচনায় লিথুয়ানিয়া হতে পারে আপনার উচ্চ শিক্ষার গন্তব্য।

আরও পড়ুন: বিদেশে উচ্চশিক্ষা: জেনে নিন ইতালির সেরা পাঁচ স্কলারশিপ সম্পর্কে

ভর্তির সেশন 

অন্যান্য সব দেশের মত লিথুয়ানিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতেও দুই সেমিস্টারে পড়াশোনা ও ভর্তিপ্রক্রিয়া পরিচালিত হয়ে থাকে। প্রতিবছর সাধারণত সেপ্টেম্বর ও জানুয়ারি মাসেই ভর্তিপ্রক্রিয়া সম্পন্ন হয়। তবে বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই সেপ্টেম্বরে বেশি সাবজেক্টে ভর্তির সুযোগ থাকে।

টিউশন ফি

লিথুয়ানিয়াতে প্রতিষ্ঠানভিত্তিক টিউশন ফি’র পার্থক্য হয়ে থাকে। যেমন: 

*স্নাতক প্রোগ্রাম: সাধারণত প্রতিবছর ১,৩০০ ইউরো থেকে শুরু হয়;

*স্নাতকোত্তর প্রোগ্রাম: প্রতিবছর ২,৩০০ ইউরো থেকে শুরু হয়;

*পিএইচডি প্রোগ্রাম: প্রতিবছর ৮,৪০০ ইউরো থেকে শুরু হয়;

আরও পড়ুন: জেনে রাখুন বিশ্বসেরা ২৯ স্কলারশিপের অফিশিয়াল ওয়েবসাইট

জীবনযাত্রার খরচ

লিথুয়ানিয়ায় আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থীদের জন্য মাসিক জীবনযাত্রার খরচ সাধারণত ৩৫০ থেকে ৭৫০ ইউরোর মধ্যে থাকে, যা পশ্চিম ইউরোপের দেশগুলোর তুলনায় সাশ্রয়ী।

আবেদন ফি

লিথুয়ানিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে আবেদন করতে আপনাকে ৫০ থেকে ১০০ ইউরো গুনতে হতে পারে। যা আবেদনপত্র জমা দেওয়ার আগেই জমা দিতে হবে এবং তা অফেরতযোগ্য। বিশ্ববিদ্যালয়ভেদে আবেদন ফি আলাদা হয়ে থাকে। 

আর্থিক স্বচ্ছলতার প্রমাণ

লিথুয়ানিয়ায় স্টুডেন্ট ভিসার জন্য আবেদনকারীদের মাসিক ৩০৪ ইউরো হিসেবে বার্ষিক ৩,৬৪৮ ইউরো এবং অতিরিক্ত ৫৫৫ ইউরো ভ্রমণ খরচসহ মোট ৪,২০৩ ইউরো ব্যাংক ব্যালেন্স দেখাতে হয়। এর পাশাপাশি যিনি টাকা স্পন্সর করবেন তার আয়ের উৎস দেখাতে হবে। আর ব্যবসায়ী হলে ট্রেডিং লাইসেন্স দেখাতে হবে।

যেভাবে ভর্তিপ্রক্রিয়া সম্পূর্ণ করবেন

প্রথমত, আপনার শেষকৃত ডিগ্রির সব মার্কশিট ও সার্টিফিকেট শিক্ষা বোর্ড থেকে সত্যায়িত করে নিতে হবে। এরপর শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে, সবশেষে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে সত্যায়িত করে নিতে হবে। এর পাশাপাশি পাসপোর্টের ফটোকপি নোটারি করে তারপর আইন মন্ত্রণালয় ও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে সত্যায়িত করতে হবে এবং সব কাগজপত্র ন্যূনতম ৩/৪ কপি সত্যায়িত করে নিতে হবে। কাগজপত্র সব সত্যায়িত করে ভারতীয় ভিসার জন্য আবেদন করতে হবে, যাতে অফার লেটার হাতে আসার আগেই আপনার ভারতীয় ভিসা হয়ে যায়।

দ্বিতীয়ত, লিথুয়ানিয়ায় যে কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ভর্তি হতে গেলে প্রথমে আপনাকে এস কে ভি সি থেকে কোয়ালিটি অ্যাসেসমেন্ট সার্টিফিকেট নিতে হবে। সে জন্য ওয়েবসাইট থেকে ফরম ডাউনলোড করে তা পুরণ করে ১ কপি করে সত্যায়িত করা অ্যাকাডেমিক ডকুমেন্টস আর পাসপোর্টের কপিসহ নিম্নবর্ণিত ঠিকানায় ডাকযোগে প্রেরণ করতে হবে। ঠিকানা: To the Centre for Quality Assessment in Higher Education (A. Goštauto g. 12, LT-01108 Vilnius, Lithuania)
ফরম ডাউনলোডের লিঙ্ক: এখানে ক্লিক করে ফরম ডাউনলোড করতে পারবেন।

কাগজপত্র যাচাই-বাছাই করে সার্টিফিকেট প্রদান করতে মোটামুটি ২০-২৫ দিনের মত সময় নেবে। এই সার্টিফিকেট অন্যান্য কাগজপত্রের সঙ্গে ভর্তির জন্য আপনাকে বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রেরণ করতে হবে। এটি আপনি সম্পূর্ণ ফ্রি-তে করতে পারবেন।

তৃতীয়ত, ভর্তির জন্য প্রয়োজনীয় কাগজপত্র নির্ধারিত বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রেরণ করতে হতে পারে। অনেক ক্ষেত্রে অনলাইনের অ্যাডমিশন পোর্টালে আপলোড করতে হবে।

*ছবি ৩৫/৪৫; 

*আবেদনপত্র; 

*পাসপোর্টের সত্যায়িত কপি; 

*অ্যাকাডেমিক সব ডকুমেন্টসের সত্যায়িত কপি;

*হাউজিং ফরম;

*মোটিভেশন লেটার; 

*ইংরেজি দক্ষতার সার্টিফিকেট: আইইএলটিএস স্কোর ন্যূনতম ৬ দশমিক ৫ বা টোফেল স্কোর ৮১; 

*আবেদন ফি প্রদানের প্রমাণপত্র;

*জীবনবৃত্তান্ত (সিভি);

*জীবনযাত্রার খরচ বহন করার জন্য পর্যাপ্ত তহবিলের প্রমাণস্বরূপ ব্যাংক স্টেটমেন্ট;

সবকিছু পাঠানোর পর ৫ থেকে ৭ দিনের মধ্যে আপনি কন্ডিশনাল অফার লেটার পাবেন। এটি হাতে পাওয়ার পর আপনাকে এক বছরের টিউশন ফি প্রদান করতে হবে। টিউশন ফি পাঠানোর ৩/৪ দিনের মধ্যেই আপনি ফাইনাল অফার লেটার পাবেন সঙ্গে ভিসা আবেদনের প্রয়োজনীয় কাগজপত্রসহ।

আরও পড়ুন: বিদেশে উচ্চশিক্ষা: সাশ্রয়ী খরচ ও সহজে ভিসা সুবিধা প্রাপ্তিতে আদর্শ ৮ দেশ

ভিসা আবেদন

বাংলাদেশের লিথুয়ানিয়া কনস্যুলেটে সাধারণত কোনো ধরনের ভিসা কার্যক্রম পরিচালনা করা হয় না। তাই প্রার্থীদের সাধারণত ভারতে যেতে হয়। এ ছাড়াও বিকল্প হিসেবে থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া এবং সিঙ্গাপুর থেকেও লিথুয়ানিয়ার ভিসা করা যায়। ন্যাশনাল ভিসা ফি ১৪০ ইউরো, যা প্রায় ১৮ হাজার ৪০ টাকার (১ ইউরো=১২৮ দশমিক ৮৬ বাংলাদেশি টাকা) সমান।

প্রয়োজনীয় কাগজপত্র

*ন্যশনাল ডি ভিসা আবেদনপত্র;

*পাসপোর্ট;

*২ কপি ছবি ৩৫/৪৫;

*অফার লেটার, মেডিয়েশন লেটার;

*অ্যাকমোডেশন কনফার্মেশন;

*এফিডেভিট অব ফিন্যান্সিয়াল সাপোর্ট;

*সর্বশেষ ৩ মাসের ব্যাংক স্টেটমেন্ট। ন্যূনতম ৪/৫ লক্ষ টাকা ব্যালেন্স থাকতে হবে;

*ব্যাংক সলভেন্সি সার্টিফিকেট;

*হেলথ ইনস্যুরেন্স ১২ মাসের (২৯০০০ টাকা);

*কনফার্ম ওয়ান ওয়ে এয়ার টিকেট;

ভারত যাওয়ার আগে অ্যাম্বেসির ওয়েবসাইট থেকে ভিসা ইন্টারভিউয়ের অ্যাপয়েন্টমেন্ট নিতে হবে। ইন্টারভিউয়ের পর ভিসা প্রসেসিংয়ের জন্য ১৪ দিন সময় লাগে, তবে অনেক সময় তা ৭-১০ দিনের মধ্যেই হয়ে যায়। ভিসা ইস্যু করা হয় ১ বছরের জন্য এবং এই ভিসার মাধ্যমে আপনি সেনজেনভুক্ত ২৫টি দেশে ভ্রমণ করতে পারবেন।

আরও পড়ুন: বিদেশে উচ্চশিক্ষা: রেফারেন্স লেটার কী

লিথুয়ানিয়ায় স্কলারশিপের সুবিধা

লিথুয়ানিয়ায় আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থীদের জন্য রয়েছে বিভিন্ন স্কলারশিপের সুযোগ। Lithuanian State Scholarship ফুল-টাইম মাস্টার্স শিক্ষার্থীদের জন্য পুরো টিউশন ফি এবং প্রতি মাসে ৮২৫ ইউরো ভাতা প্রদান করে। এতে স্বাস্থ্যবিমা ও ফ্লাইট খরচও অন্তর্ভুক্ত থাকে। এ ছাড়া Erasmus Mundus Joint Masters Program-এর আওতায় শিক্ষার্থীরা টিউশন ফি, ল্যাব, লাইব্রেরি, স্বাস্থ্যবিমা ও মাসিক ভাতা পেয়ে থাকেন। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর নিজস্ব স্কলারশিপও আছে। যেমন: Vilnius University সেমিস্টার ফি ছাড় দেয় এবং Vytautas Magnus University বিভিন্ন পর্যায়ে শিক্ষার্থীদের পড়াশোনার খরচ বহন করে।

লিথুয়ানিয়ায় পড়াশোনার পাশাপাশি খণ্ডকালীন চাকরির সুযোগ

লিথুয়ানিয়ায় আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থীরা পড়াশোনার পাশাপাশি কাজ করার সুযোগ পান। ইউরোপের বাইরের শিক্ষার্থীরা সপ্তাহে ২০ ঘণ্টা পর্যন্ত খণ্ডকালীন কাজ করতে পারেন। তবে, পিএইচডির শিক্ষার্থীরা ফুল-টাইম জব করার অনুমতি পান। যাদের অস্থায়ী বসবাসের অনুমতি রয়েছে, তারা অতিরিক্ত ওয়ার্ক পারমিট ছাড়াই কাজ করতে পারেন। এমনকি স্নাতক ডিগ্রি শেষ করার পর শিক্ষার্থীদের আরও তিন মাস ফুল-টাইম কাজের অনুমতি দেওয়া হয়।

আরও পড়ুন: বিদেশে উচ্চশিক্ষা: চীনের সেরা ১০ বিশ্ববিদ্যালয় সম্পর্কে জেনে নিন

ইউরোপজুড়ে স্বনামধন্য লিথুয়ানিয়ার কয়েকটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের তালিকা

*ভিলনিয়াস ইউনিভার্সিটি;

*কওনাস ইউনিভার্সিটি অব টেকনোলজি;

*ভিল্নিয়াস গ্যাডিমিনাস টেকনিক্যাল ইউনিভার্সিটি;

*ভিতওতাস ম্যাগ্নাস ইউনিভার্সিটি;

*মিকলাস রমেরিস ইউনিভার্সিটি;

*লিথুয়ানিয়ান ইউনিভার্সিটি অব হেলথ সায়েন্সেস;

বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে অধ্যয়নের জন্য জনপ্রিয় কয়েকটি বিষয়ের তালিকা:

*মেডিসিন;

*অ্যাকাউন্টিং এবং অডিট;

*ফ্যাশন ইঞ্জিনিয়ারিং;

*স্থাপত্য;

*ব্যবসা এবং জনপ্রশাসন;

*আইন;

*পারফর্মিং আর্টস;

*প্রকৌশল বিজ্ঞান।


সর্বশেষ সংবাদ