এক বছরে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ১২ হাজার শিক্ষককে আইসিটি বিষয়ে প্রশিক্ষণের উদ্যোগ
- টিডিসি রিপোর্ট
- প্রকাশ: ১০ নভেম্বর ২০২৫, ১০:৫৯ PM
জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের আইসিটি কারিকুলাম বাস্তবায়ন বিষয়ে প্রশিক্ষকদের জন্য আয়োজিত ‘ট্রেইনার্স ট্রেনিং’ কর্মশালার সমাপনী অনুষ্ঠান আজ রাজধানীর তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি (আইসিটি) বিভাগে অনুষ্ঠিত হয়েছে। এসপায়ার টু ইনোভেট (এটুআই) প্রোগ্রাম ও ইউনিসেফ বাংলাদেশের কারিগরি সহায়তায় কর্মশালাটি আয়োজন করে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়। এতে বিশ্ববিদ্যালয়ের নির্বাচিত শিক্ষক ও আইসিটি বিশেষজ্ঞসহ প্রায় ৯০ জন মূল প্রশিক্ষক অংশ নেন।
আয়োজকরা জানায়, প্রশিক্ষণ কার্যক্রমের অংশ হিসেবে ৯০ জন মূল বা কোর ট্রেইনার প্রস্তুত করা হয়েছে। তারা এ বছরের মধ্যে আরও ৯০০ জন মাস্টার ট্রেইনারকে প্রশিক্ষণ দেবেন। পরে মাস্টার ট্রেইনারদের মাধ্যমে ২০২৬ সালের মধ্যে প্রায় ১২ হাজার শিক্ষককে আইসিটি বিষয়ে প্রশিক্ষণ দেওয়ার লক্ষ্য রয়েছে। এই প্রশিক্ষিত শিক্ষকরা জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত প্রায় আড়াই হাজার কলেজে অধ্যয়নরত শিক্ষার্থীদের বাধ্যতামূলক আইসিটি কোর্সে পাঠদান করবেন।
আয়োজকদের তথ্যমতে, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত ২ হাজার ২৫৭টি কলেজে প্রায় ৩৫ লাখ শিক্ষার্থী পড়াশোনা করছে। এই বিপুল শিক্ষার্থীকে প্রযুক্তিদক্ষ মানবসম্পদ হিসেবে গড়ে তুলতে ২০২৪–২৫ শিক্ষাবর্ষ থেকে স্নাতক (সম্মান) প্রথম বর্ষের সব বিষয়ের শিক্ষার্থীদের জন্য বাধ্যতামূলক আইসিটি কোর্স চালু করেছে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়। উচ্চশিক্ষায় শিক্ষার্থীদের আইসিটি দক্ষতা বাড়ানোর ক্ষেত্রে এটিকে একটি গুরুত্বপূর্ণ উদ্যোগ হিসেবে দেখা হচ্ছে।
এই কোর্স কার্যকরভাবে বাস্তবায়নের জন্য এটুআই-এর সহযোগিতায় জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় এ বছরের ৩ সেপ্টেম্বর আইসিটি কোর্স বাস্তবায়নের একটি গাইডলাইন প্রণয়ন করে। ইউনিসেফ বাংলাদেশের সহায়তায় অনলাইন ও সরাসরি শ্রেণিকক্ষ মিলিয়ে একটি মিশ্র (ব্লেন্ডেড) প্রশিক্ষণ পদ্ধতি তৈরি করা হয়েছে। এই মডেলের ভিত্তিতে জাতীয় পর্যায়ে মূল প্রশিক্ষকদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে। পরবর্তী ধাপে তাঁরা মাস্টার ট্রেইনার ও মাঠপর্যায়ের শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ দেবেন। ধাপে ধাপে এই প্রশিক্ষণ সারাদেশের কলেজে প্রসারিত হবে।
প্রশিক্ষণের মূল লক্ষ্য ছিল আইসিটি কারিকুলাম বাস্তবায়নের জন্য মূল প্রশিক্ষকদের প্রস্তুত করা, ব্লেন্ডেড পদ্ধতিতে ক্লাস নেওয়া, অনলাইন টুল ব্যবহার ও মূল্যায়ন কাঠামো সম্পর্কে অভিন্ন ধারণা তৈরি করা। একই সঙ্গে মাস্টার ট্রেইনার ও শিক্ষক পর্যায়ের পরবর্তী প্রশিক্ষণ আয়োজনের প্রস্তুতিও এই কর্মশালার মাধ্যমে সম্পন্ন হয়েছে।
সমাপনী অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ে মাননীয় প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী ফয়েজ আহমদ তৈয়্যব। অনুষ্ঠানের সভাপতিত্ব করেন আইসিটি বিভাগের সচিব শীষ হায়দার চৌধুরী। বিশেষ অতিথি হিসেবে বক্তব্য দেন পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের আর্থ–সামাজিক অবকাঠামো বিভাগের সদস্য (সচিব) ড. কাইয়ুম আরা বেগম এবং জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস-চ্যান্সেলর প্রফেসর ড. এএসএম আমানুল্লাহ।
এ ছাড়া বক্তব্য দেন মাননীয় প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব মোহাম্মদ শফিকুল আলম ও উপ-প্রেস সচিব মোহাম্মদ আবুল কালাম আজাদ মজুমদার, আইসিটি বিভাগের অতিরিক্ত সচিব (প্রশাসন অনুবিভাগ) মো. মামুনুর রশীদ ভূঞা, এটুআই প্রোগ্রামের প্রকল্প পরিচালক (যুগ্ম সচিব) মোহা. আব্দুর রফিক এবং ইউনিসেফ বাংলাদেশের ডেপুটি রিপ্রেজেন্টেটিভ দীপিকা শর্মা। অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তব্য দেন জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতকোত্তর শিক্ষা, প্রশিক্ষণ ও গবেষণা কেন্দ্রের ভারপ্রাপ্ত ডিন ড. মো. আবুদ্দারদা এবং প্রশিক্ষণ কার্যক্রমের সারসংক্ষেপ উপস্থাপন করেন এটুআই-এর প্রোগ্রাম ম্যানেজমেন্ট লিড আবদুল্লাহ আল ফাহিম।
ফয়েজ আহমদ তৈয়্যব বলেন, এই আইসিটি কোর্স ও প্রশিক্ষণ কর্মশালা জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিটি শিক্ষার্থীকে কোডিং, মেশিন লার্নিং, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, ক্লাউড ভেসড কম্পিউটিং, ডেটা ব্যবস্থাপনা, অনলাইন নিরাপত্তা ও বিভিন্ন ডিজিটাল টুল ব্যবহারে আত্মবিশ্বাসী করে তোলার এক গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক। আমরা চাই চতুর্থ শিল্প বিপ্লবকে সামনে রেখে আরও অধিকতর টেকনোলজি বিষয়ক দক্ষতা ও শিক্ষার জন্য শিক্ষার্থীদের সুযোগ তৈরি করতে।
শীষ হায়দার চৌধুরী বলেন, অনেক সময় প্রযুক্তি বিষয়ক পরিকল্পনা ক্লাসরুম পর্যন্ত পৌঁছায় না। এই প্রশিক্ষণের মাধ্যমে সেই দূরত্ব কমবে এবং প্রশিক্ষিত শিক্ষকদের মাধ্যমে প্রযুক্তি সরাসরি শিক্ষার্থীদের কাছে পৌঁছাবে।
ড. কাইয়ুম আরা বেগম বলেন, দেশের দীর্ঘমেয়াদি উন্নয়নের সঙ্গে তাল মিলিয়ে তরুণ জনগোষ্ঠীকে দক্ষ করে গড়ে তুলতে হবে। এই উদ্যোগের মাধ্যমে আমরা সেই লক্ষ্যের দিকে অনেকটা এগিয়ে যেতে পারব।
ড. এএসএম আমানুল্লাহ বলেন, “জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক শিক্ষার্থীই পরিবারের প্রথম প্রজন্মের উচ্চশিক্ষার্থী। আইসিটি দক্ষতা অর্জনের মাধ্যমে তারা নিজেদের পাশাপাশি পরিবার ও সমাজের আর্থসামাজিক উন্নয়নেও ভূমিকা রাখতে পারবে। চলতি শিক্ষাবর্ষে বাধ্যতামূলক আইসিটি কোর্সে অংশ নিচ্ছে প্রায় চার লাখ শিক্ষার্থী। আগামী শিক্ষাবর্ষে স্নাতক (পাশ) কোর্সেও এই পাঠ্যক্রম চালু হলে আরও প্রায় দুই লাখ শিক্ষার্থী যুক্ত হবে। পর্যায়ক্রমে স্নাতক (সম্মান) দ্বিতীয়, তৃতীয় ও চতুর্থ বর্ষে অ্যাডভান্স আইসিটি কোর্স চালুর পরিকল্পনা রয়েছে। আমাদের উদ্দেশ্য জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়কে একটি উন্নতমানের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করা।“
মোহাম্মদ শফিকুল আলম বলেন, আমরা এমন একটি সময়ে আছি। যখন পৃথিবী খুব দ্রুত পরিবর্তন হচ্ছে। আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স, রোবোটিকস এর কারণে আমাদের বর্তমানে যেই কাজ করছি তাতে দ্রুতই সুযোগ কমে আসছে। তাই আমাদের দেশের জনশক্তিকে কোনদিকে কাজে লাগানো যায় তা নিয়ে ভাবতে হবে। আমাদের শিক্ষার্থীদের অধিকতর পর্যায়ের আইসিটি ও ভাষা দক্ষতায় অনেক দক্ষ করে গড়ে তুলতে হবে। যাতে তারা বিশ্ব সম্পদ হিসেবে নিজের গড়ে তুলতে পারে। আর এর উপরই নির্ভর করছে বাংলাদেশ উচ্চ আয়ের দেশ হিসেবে রূপান্তরিত হবে কিনা।
মো. মামুনুর রশীদ ভূঞা বলেন, উন্নয়ন অভিযাত্রায় সবচেয়ে বড় শক্তি দক্ষ মানবসম্পদ। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের আইসিটি দক্ষ করে তোলা সেই লক্ষ্য অর্জনের একটি গুরুত্বপূর্ণ ধাপ। আমরা আমাদের বিদ্যমান সরকারি সম্পদ ল্যাব, প্রতিষ্ঠান, শিক্ষক ও আইসিটি কর্মকর্তাদের মাধ্যমে একত্রিত করে তা এই মহৎ উদ্দেশ্যে ব্যবহার করতে পারি কিনা তা নিয়ে আমরা ভাবতে পারি।
মোহা. আব্দুর রফিক বলেন, আইসিটি কারিকুলাম বাস্তবায়নের জন্য তৈরি গাইডলাইন ও প্রশিক্ষণ কাঠামো ভবিষ্যতে দেশের অন্যান্য উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানের জন্যও মডেল হিসেবে ব্যবহার করা যেতে পারে।
দীপিকা শর্মা বলেন, শহর থেকে প্রান্তিক এলাকা সব শিক্ষার্থীর জন্য সমানভাবে প্রযুক্তি শেখার সুযোগ নিশ্চিত করতে ভালোভাবে প্রশিক্ষিত শিক্ষক অপরিহার্য। তাই এই উদ্যোগকে তিনি দেশের এবং তরুণদের ভবিষ্যতের জন্য এক ধরনের বিনিয়োগ হিসেবে উল্লেখ করেন।
ড. মো. আবুদ্দারদা বলেন, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের কলেজগুলোতে পড়ুয়া লাখো শিক্ষার্থীই আমাদের জনশক্তি। শুরু থেকেই তাদের হাতে আইসিটি দক্ষতা তুলে দিতে পারলে দেশি ও বিদেশি শ্রমবাজারে তারা আরও প্রস্তুত ও প্রতিযোগিতামূলক হয়ে উঠবে।
আবদুল্লাহ আল ফাহিম প্রশিক্ষণ কার্যক্রমের সারসংক্ষেপ তুলে ধরে বলেন, প্রশিক্ষণ কার্যক্রমের অংশ হিসেবে ৯০ জন মূল বা কোর ট্রেইনার প্রস্তুত করা হয়েছে। তারা এ বছরের মধ্যে আরও ৯০০ জন মাস্টার ট্রেইনারকে প্রশিক্ষণ দেবেন। পরে মাস্টার ট্রেইনারদের মাধ্যমে ২০২৬ সালের মধ্যে প্রায় ১২ হাজার শিক্ষককে আইসিটি বিষয়ে প্রশিক্ষণ দেওয়ার লক্ষ্য রয়েছে। এই প্রশিক্ষিত শিক্ষকরা জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত প্রায় আড়াই হাজার কলেজে অধ্যয়নরত শিক্ষার্থীদের বাধ্যতামূলক আইসিটি কোর্সে পাঠদান করবেন।
অনুষ্ঠানের শেষে অংশগ্রহণকারী প্রশিক্ষকদের হাতে সনদ তুলে দেওয়া হয়। উপস্থিত শিক্ষকরা জানান, আইসিটি কোর্স বাস্তবায়ন গাইডলাইন, অনলাইন টুল ব্যবহার ও মূল্যায়ন পদ্ধতি সম্পর্কে এই প্রশিক্ষণ তাঁদের জন্য অত্যন্ত ব্যবহারিক ও সময়োপযোগী হয়েছে।