ইবিতে ফোন কেড়ে নিয়ে সাংবাদিককে মারধর, ইস্যু তৈরি করে ধামাচাপার চেষ্টা
- ইবি প্রদায়ক
- প্রকাশ: ১২ জুলাই ২০২৫, ০৯:২৪ PM , আপডেট: ১৪ জুলাই ২০২৫, ০৯:৩৩ AM
ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে (ইবি) আন্তঃসেশন খেলাকে কেন্দ্র করে মারামারিতে জড়ান অর্থনীতি বিভাগের শিক্ষার্থীরা। এসময় তাদের মারামারির ভিডিও করতে গেলে সাংবাদিকের মোবাইল কেড়ে নিয়ে মারধর করা হয়। শনিবার (১২ জুলাই) বিকেল পাঁচটার দিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় ফুটবল মাঠে এই ঘটনা ঘটে।
ঘটনায় অভিযুক্ত শিক্ষার্থীরা হলেন, অর্থনীতি বিভাগের ২০২০-২১ শিক্ষাবর্ষের নাহিদ হাসান, সাব্বির, আফসানা পারভিন তিনা, মিনহাজ, সৌরভ দত্ত ও পান্না এবং একই বিভাগের ২০২২-২৩ শিক্ষাবর্ষের অজিল, সাইফুল, রাকিব, মশিউর রহমান রিয়ন ও হৃদয়।
অন্যদিকে ভুক্তভোগী সাংবাদিকরা হলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন ও ভূমি ব্যবস্থাপনা বিভাগের ২০২১-২২ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থী ও জাতীয় দৈনিক আমাদের বার্তার বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিবেদক আরিফ বিল্লাহ এবং একই বিভাগের একই সেশনের শিক্ষার্থী ও জাতীয় দৈনিক আজকালের খবরের বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিনিধি রবিউল আলম এবং একই সেশনের সাংকবাদিকতা বিভাগের শিক্ষার্থী ও বার্তা২৪- বিশ্ববিবিদ্যালয় প্রতিনিধি নুর ই আলম।
ক্যাম্পাস সূত্রে জানা যায়, বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় ফুটবল মাঠে অর্থনীতি বিভাগের আন্তঃসেশন খেলাকে কেন্দ্র করে নিজেদের ভিতরে হাতাহাতিতে জড়ান বিভাগটির সিনিয়র ও জুনিয়ররা। এসময় তাদের মারামারির ভিডিও করতে গেলে আরিফ বিল্লাহ’র (সাংবাদিক) মোবাইল কেড়ে নেন তাদের এক সহপাঠী আফসানা পারভিন তিনা। একইসময় দলবেঁধে তেড়ে এসে সেই সাংবাদিককে এলোপাতাড়ি মারধর শুরু করেন বিভাগটির অন্য শিক্ষার্থীরা। এসময় আশেপাশের কয়েকজন ঠেকাতে গেলেও দফায় দফায় মারধর ও ঘিরে ফেলেন তারা।
একইভাবে আরেক সাংবাদিক নুর ই আলম মারধরের ভিডিও করতে গেলে তাকেও মারধর করেন তারা। পরবর্তীতে একইভাবে আরেক সাংবাদিক রবিউল আলমের উপরেও ঝাঁপিয়ে পড়েন তারা। এভাবে পরপর তিনজন সাংবাদিককে দফায় দফায় মারধর করা হয়। ঘটনার পরবর্তীতে সেখানে অন্য সাংবাদিকরা সমাধানের জন্য গেলে তাদের সাথেও বাকবিতণ্ডার সৃষ্টি হয়। এক পর্যায়ে কয়েকজন সাংবাদিক উত্তেজিত অবস্থায় তাদের দিকে গেলে তাদেরকেও মারধর করা হয়।
এদিকে এই ঘটনার পর বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মরত সাংবাদিকরা, প্রক্টর ও বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক মাঠে উপস্থিত হন। ভুক্তভোগীরা জানান, পেশাগত দায়িত্ব পালনকালে এ ধরনের হামলা এবং হুমকির আলোকে আমরা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের কাছে সুষ্ঠু বিচার এবং নিরাপত্তা নিশ্চিত করার দাবি জানাই। এছাড়াও এ ঘটনায় প্রায় ৩ ঘণ্টা পার হয়ে গেলেও আরিফ বিল্লাহর মোবাইল ফোনটি উদ্ধার করা যায়নি।
ঘটনাস্থলে উপস্থিত ছিলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের সমন্বয়ক এস এম সুইট, রোভার খন্দকার সায়েম এবং ডিবিসি প্রতিনিধি নাজমুল হোসেন। তারা জানান, তাদের সামনেই আরিফ বিল্লাহকে ফের মারধর করা হয়। পরে সবাই মিলে আহতদের উদ্ধার করে নিরাপদ স্থানে নিয়ে যান।
এদিকে বিষয়টিকে ধামাচাপা দিতে নতুন ইস্যু তৈরির চেষ্টা করছে বিভাগটির শিক্ষার্থীরা। তারা অভিযোগ করছেন, প্রক্টরের সামনে তাদের বিভাগের বান্ধবী আফসানাকে সাংবাদিক মারধর করেছে। এই ঘটনায় বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিকেল সেন্টারে ভর্তি করা হয়েছে ওই ছাত্রীকে।
তবে প্রত্যক্ষদর্শীরা জানিয়েছেন, ওই ছাত্রীকে মারধরের মতো কোন ঘটনা ঘটেনি।
এদিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিকেল সেন্টারের দায়িত্বরত চিকিৎসক ডা. সাহেদ আহম্মেদ বলেন, ছাত্রীর গায়ে কোন আঘাত লাগার চিহ্ন পাওয়া যায়নি। তবে আতঙ্কগ্রস্ত বা প্যানিক অ্যাটাকে এমন হতে পারে।
এ ছাড়া মেডিকেল সেন্টারের একাধিক সূত্র জানায়, মেয়েটিকে স্বাভাবিকই মনে হয়েছে। আক্রান্ত না হয়েও সে আক্রান্তের অভিনয় করছে বলে মনে হচ্ছে।
এই বিষয়ে প্রক্টর অধ্যাপক ড. শাহিনুজ্জামান বলেন, আমি ঘটনাটি শোনার পর ঘটনাস্থলে গিয়ে সবাইকে নিবৃত করি। লিখিত অভিযোগ করা হলে ব্যবস্থা নেবো।
আপনার সামনে মেয়েকে মারধর করা হয়েছে কি না জানতে চাইলে প্রক্টর বলেন, আমি এই বিষয়ে কিছু জানিনা।
প্রত্যক্ষদর্শী শিক্ষার্থী ইশতিয়াক ফেরদৌস ইমন বলেন, আমি হট্টগোলের আওয়াজ শুনে মাঠের দিকে এগিয়ে যায়। গিয়ে দেখি কয়েকজন মিলে একজন সাংবাদিককে মারধর করছে। তার পাশে আরেক সাংবাদিক ভিডিও করতে গেলে তাকেও ভিডিও বন্ধ করতে বলা হয়। ভিডিও বন্ধ না করায় তাকে এসে লাথি মারা হয়।
ভুক্তভোগী শিক্ষার্থী ও সাংবাদিক নুর ই আলম বলেন, আজকে ফুটবল মাঠে ইকোনোমিকস বিভাগের আন্তঃসেশন খেলায় মারামারির ঘটনা ঘটলে আমার ই এক সহকর্মী আরিফ বিল্লাহ সংবাদ সংগ্রহ করতে গেলে মারধরের শিকার হয়। তখন আমি ক্যামেরা নিয়ে ভিডিও করতে গেলে আনুমানিক ১৫-২০ জন এগিয়ে এসে আমাকে ক্যামেরা বন্ধ করতে বলে মারধর করে। এসময় কয়েকজন এসে আমাকে উদ্ধার করে। এর কিছুক্ষণ পরে অন্য সাংবাদিকরা ঘটনাস্থলে আসলে তাদের ওপর ফের হামলা চালায় তারা। আমি হামলাকারীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি করছি।
ভুক্তভোগী আরেক শিক্ষার্থী ও সাংবাদিক আরিফ বিল্লাহ বলেন, বিকেল ৫ টার দিকে আমি রাস্তা দিয়ে যাওয়ার পথে দেখি ফুটবল মাঠে দুই পক্ষের হাতাহাতি ও মারামারি চলছে। ঘটনা দেখে আমি সংবাদের সংগ্রহের জন্য মোবাইল নিয়ে ভিডিও করা শুরু করি। হঠাৎ এক মেয়ে এসে আমার মোবাইল ছিনিয়ে নেয়। আমি মোবাইল কেড়ে নেওয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে সাথে সাথে ৮/১০ টা ছেলে এসে আমাকে ঘিরে ধরে চর, থাপ্পড়, ঘুসি মারা শুরু করে। সাথে সাথে সাংবাদিক নুর এসে আমাকে মারার ভিডিও করলে তাকেও ২০/২৫ টা ছেলে মারধর করে। এসময় কয়েকজন আমাকে উদ্ধার করতে আসলে তাদের সামনে আমাকে ফের মারধর করে। আমি কোনোরকম ছুটে এসে সাংবাদিক রবিউলকে ডেকে নেই। রবিউল ঘটনাস্থলে যাওয়ার সাথে সাথে রবিউলকে চড় থাপ্পড় ঘুসি ও লাথি মারা শুরু করে। এতে রবিউল মাটিতে পড়ে যায়। পরে কয়েকজন ওদের হাত থেকে উদ্ধার করে নিরাপদে নিয়ে আসে। ওরা আমার ফোন এখনো ফেরত দেয় নি। এর কিছুক্ষণ পরে অন্য সাংবাদিকরা ঘটনাস্থলে আসলে ফের তারা হামলা চালায়।
এদিকে ঘটনার চার ঘণ্টা পেরিয়ে গেলেও ভুক্তভোগী সাংবাদিক ফোন ফেরত পাননি। এদিকে ওই ছাত্রীকে একাধিকবার মোবাইল ফোনে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও ফোনটি বন্ধ পাওয়া যায়।
এ বিষয়ে অভিযুক্তদের একজন অর্থনীতি বিভাগের ২০২০-২১ শিক্ষাবর্ষের নাহিদ হাসান বলেন, আমাদের বিভাগের আন্তঃসেশন খেলা হচ্ছিল। তখন বল আউট হওয়া না হওয়া নিয়ে নিজেদের মধ্যে ঝামেলা হয়। জুনিয়র একজন স্যরি বলে সমাধান করা হয়। এসময় আমি সাংবাদিক কাউকে মারিনি। আমার গলা ধরছে তখন আমি কি করব। এ কথা বলেই তিনি উত্তেজিত হয়ে প্রতিবেদকের কল কেটে দেন।
অর্থনীতি বিভাগের সভাপতি ড. পার্থ সারথি লস্কর বলেন, আজকে অর্থনীতি বিভাগের আন্তঃশিক্ষাবর্ষ খেলা ছিল। সেখানে ২০১৯-২০,২০২০-২১, ২০২১-২২, ২০২২-২৩ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থীদের খেলা ছিল। শুনেছি মারামারি ঘটনা ঘটেছে। তবে সেখানে ঠিক কী হয়েছে জানি না। বিষয়টি নিয়ে বসে পরবর্তী সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।
উপাচার্য অধ্যাপক ড. নকীব মোহাম্মদ নসরুল্লাহ বলেন, আমি ক্যাম্পাসের বাইরে। ঘটনা এখনো শুনিনি। প্রক্টরের কাছে শুনবো কি হয়েছে। আমি আগামীকাল রবিবার ক্যাম্পাসে আসবো৷ তারপর দেখি কী করা যায়।