দুদকের তদন্তের তালিকায় ২০ বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি
- জুবায়ের রহমান
- প্রকাশ: ২১ জুন ২০২৫, ০৭:৫৮ PM , আপডেট: ২৩ জুন ২০২৫, ০৫:২২ PM
আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে দায়িত্ব পালন করা অন্তত ২০ জন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের (ভিসি) বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগে তদন্ত বা অনুসন্ধান চালাচ্ছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। এই সাবেক উপাচার্যদের বিরুদ্ধে শিক্ষক ও কর্মচারী নিয়োগে অনিয়ম, ক্ষমতার অপব্যবহার, অর্থ আত্মসাৎ ও স্বজনপ্রীতির মতো গুরুতর অভিযোগ রয়েছে।
২০২৪ সালের ৫ আগস্ট ছাত্র আন্দোলনের মুখে আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর সাবেক উপাচার্যদের বিরুদ্ধে বিভিন্ন ধরনের দুর্নীতির অভিযোগ খতিয়ে দেখতে মাঠে নামে দুদক।
গত বুধবার দুদক বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের দুই সাবেক উপাচার্য— নজমুল আহসান কলিমুল্লাহ ও একেএম নূর-উন-নবীসহ পাঁচজনের বিরুদ্ধে ৪ কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগে মামলা করে। অভিযোগে বলা হয়, তারা একটি উন্নয়ন প্রকল্পের অর্থ আত্মসাৎ করেছেন।
এর আগে ১৬ জুন যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক আব্দুস সাত্তারকে সরকারি অর্থ আত্মসাৎ ও অবৈধ নিয়োগের দুর্নীতির মামলায় কারাগারে পাঠানো হয়।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক আব্দুস সোবহানও দুর্নীতির অভিযোগের মুখে রয়েছেন। ২০২১ সালের দায়িত্ব শেষের দিনে তিনি নিয়মবহির্ভূতভাবে ১৪১ জনকে নিয়োগ দিয়েছিলেন বলে অভিযোগ রয়েছে।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক শিরিন আখতার বিরুদ্ধে ঘুষ, অবৈধ নিয়োগ ও সরকারি অর্থ আত্মসাতের অভিযোগে দুদক সম্প্রতি অনুসন্ধান শুরু করেছে।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ডিজিটাল ইউনিভার্সিটির প্রথম উপাচার্য অধ্যাপক মুনাজ আহমেদ নূরের বিরুদ্ধে ৫.৯ কোটি টাকা ব্যয়ে একটি ডেটা ল্যাব স্থাপনে দুর্নীতির অভিযোগ খতিয়ে দেখছে দুদক।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য ডা. শরফুদ্দিন আহমেদের বিরুদ্ধেও প্রায় ১০০ কোটি টাকা ঘুষ নেওয়ার অভিযোগে তদন্ত চালাচ্ছে দুদক। অভিযোগে বলা হয়েছে, তিনি অবৈধ নিয়োগের মাধ্যমে এই অর্থ গ্রহণ করেন।
২০২৪ সালের সেপ্টেম্বর মাসে জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য সৌমিত্র শেখর দে’র বিরুদ্ধে ক্ষমতার অপব্যবহার, অবৈধ নিয়োগ ও অর্থ আত্মসাতের মাধ্যমে অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগে তদন্ত শুরু হয়।
হাজী মোহাম্মদ দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য এম কামরুজ্জামান ও মো. আবুল কাশেমের বিরুদ্ধে কর্মকর্তা-কর্মচারী নিয়োগ, ভর্তি প্রক্রিয়া ও সরকারি অর্থ আত্মসাতের অভিযোগে তদন্ত চলছে।
এছাড়া যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য আনোয়ার হোসেন, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য শেখ আব্দুস সালাম, খুলনা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য মো. শহিদুর রহমান খান, রাজশাহী প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য রফিকুল ইসলাম শেখ, সিলেট মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য মোরশেদ আহমেদ চৌধুরী, খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ফায়েকুজ্জামান ও অধ্যাপক মাহমুদ হোসেন, বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য লুৎফুল হাসান মন্টু, গোপালগঞ্জ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক খন্দকার নাসিরউদ্দিনসহ আরও অনেক সাবেক উপাচার্যের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগে তদন্ত চলছে।
এদিকে দুদকের একাধিক সূত্র বলছে, আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে দায়িত্ব পালন করা আরও বহু উপাচার্যের বিরুদ্ধেও দুর্নীতির অভিযোগ খতিয়ে দেখা হচ্ছে।
ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)-এর নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর উপাচার্যদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ দীর্ঘদিন ধরেই আলোচিত হয়ে আসছে। আমাদের গবেষণায়ও এসব দুর্নীতির সুস্পষ্ট চিত্র উঠে এসেছে। কিন্তু দীর্ঘ সময় ধরে কর্তৃত্ববাদী শাসনের অধীনে এসব বিষয়ে কোনো কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।
যেকোনো প্রতিষ্ঠানে দুর্নীতি অনভিপ্রেত, কিন্তু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, বিশেষত বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে দুর্নীতি আরও বেশি অগ্রহণযোগ্য। কারণ এসব প্রতিষ্ঠানে মূল্যবোধ ও জবাবদিহিতার সংস্কৃতি গড়ে তোলার কথা। অথচ উপাচার্য পর্যায়ের ব্যক্তিরাই যখন দুর্নীতিতে জড়িত হন, তখন তা গভীর উদ্বেগের বিষয় হয়ে দাঁড়ায়।
তিনি বলেন, এই দুর্নীতির জবাবদিহি নিশ্চিত করা এখন সময়ের দাবি। ইতোমধ্যে যেভাবে তদন্ত কার্যক্রম শুরু হয়েছে, তা অব্যাহত রেখে সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ তদন্তের মাধ্যমে দৃষ্টান্তমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে, যাতে ভবিষ্যতে কেউ এ ধরনের অনিয়মে জড়াতে সাহস না পায়।
তিনি আরও বলেন, ‘উপাচার্যদের দুর্নীতির অন্যতম প্রধান কারণ হলো দলীয় প্রভাব এবং সেই প্রভাবে শিক্ষক-কর্মকর্তা নিয়োগ। এর ফলেই বিচারহীনতা ও জবাবদিহির অভাব তৈরি হয়েছে, যার মাধ্যমে পেশাগত নৈতিকতা ভেঙে পড়েছে। এই পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের জন্য জনগণের গণজাগরণ ঘটেছে, যা আমাদের সামনে নতুন সম্ভাবনার দরজা খুলে দিয়েছে।’
‘বর্তমানে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সামনে এ দুর্নীতির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের একটি বড় সুযোগ এসেছে। এই সুযোগ হাতছাড়া করা যাবে না। আমরা প্রত্যাশা করি, তাদের মেয়াদে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর মাধ্যমে যথাযথ প্রক্রিয়ায় দোষীদের বিরুদ্ধে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করা হবে।’
ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, ‘এ ধরনের পদক্ষেপ একটি শক্তিশালী বার্তা দেবে—যে কেউ দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত থাকুক না কেন, তার পদমর্যাদা যাই হোক, তাকে শাস্তির আওতায় আসতেই হবে।’
দুদকের জনসংযোগ বিভাগের উপ-পরিচালক আকতারুল ইসলাম দ্য ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, ঢাকা, চট্টগ্রাম, রংপুর, রাজশাহীসহ দেশের বিভিন্ন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের একাধিক সাবেক উপাচার্যের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে।
তিনি বলেন, এসব অভিযোগের ভিত্তিতে দুদক ইতোমধ্যে তদন্ত কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। তদন্ত প্রতিবেদন হাতে এলে, দোষী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।