ইবিতে বছরজুড়ে আলোচনায় ছিল র্যাগিং, মারামারি, ভাঙচুর ও অডিও কান্ড
- রেদোয়ান রাকিব
- প্রকাশ: ২৯ ডিসেম্বর ২০২৩, ১২:০৯ PM , আপডেট: ২৯ ডিসেম্বর ২০২৩, ১২:৩৫ PM
কালের অমোঘ নিয়মে নতুনের সম্ভাবনায় দরজায় কড়া নাড়ছে নতুন বছর। আর মাত্র কয়েকটা দিনের অপেক্ষা। অবকাঠামো উন্নয়ন, নানান সাফল্য আর কোলাহলমুখর ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় (ইবি) ক্যাম্পাস সবাইকে আকর্ষণ করেছে। তবে নানান সাফল্যের মধ্যেও সেশনজট, শ্রেণীকক্ষ সংকটসহ নানান বিষয়ে উত্তাল ছিল ১৭৫ একরের ক্যাম্পাস।
বছর জুড়ে আলোচনায় ছিল, নবীন শিক্ষার্থীকে র্যাগিং, ভাঙচুর, মারামারি, অডিও ক্লিপ ভাইরাল, কর্মকর্তাদের কর্মবিরতি এবং প্রধান ফটকে তালা। তবে সব থেকে বেশি আলোচনায় ছিল নবীন শিক্ষার্থী ফুলপরী খাতুনকে র্যাগিং। আর এসব নিয়েই সাজানো হয়েছে ইবির ২০২৩ সালের এ সালতামামি।
নবীন শিক্ষার্থীকে বিবস্ত্র করে র্যাগিং
চলতি বছরের গত ১১ ও ১২ই ফেব্রুয়ারি বিশ্ববিদ্যালয়ের দেশরত্ন শেখ হাসিনা হলের গণরুমে এক নবীন ছাত্রী ফুলপরী খাতুনকে রাতভর নির্যাতন ও বিবস্ত্র করে ভিডিও ধারণের অভিযোগ ওঠে শাখা ছাত্রলীগ নেত্রীসহ পাঁচ শিক্ষার্থীর বিরুদ্ধে। এর দায়ে ছাত্রলীগ নেত্রী সানজিদা চৌধুরী অন্তরাসহ পাঁচজনের ছাত্রত্ব বাতিল করে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। বিশ্ববিদ্যালয়ের ২৬০তম জরুরি সিন্ডিকেট সভায় এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। সুপ্রিমকোর্টের হাইকোর্ট ডিভিশনের নির্দেশনা মোতাবেক তাদের আজীবন বহিষ্কারের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়।
স্থায়ী বহিষ্কৃত অন্য অভিযুক্তরা হলেন ফিন্যান্স অ্যান্ড ব্যাংকিং ২০১৭-১৮ সেশনের শিক্ষার্থী সানজিদা চৌধুরী অন্তরা, একই বিভাগের ২০-২১ সেশনের তাবাসসুম ইসলাম ও মোয়াবিয়া জাহান, আইন বিভাগের ২০২০-২১ সেশনের শিক্ষার্থী ইসরাত জাহান মীম ও চারুকলা বিভাগের হালিমা খাতুন উর্মী।
ফুটবল ও ক্রিকেট খেলাকে কেন্দ্র করে মারামারি
গত ২১ নভেম্বর বিশ্ববিদ্যালয়ে ফুটবল ও ক্রিকেট খেলাকে কেন্দ্র করে শিক্ষার্থীদের দু’গ্রুপের মধ্যে মারামারির ঘটনা ঘটে। এতে অন্তত ২৫ জন শিক্ষার্থী আহত হন। আহতদের বিশ্ববিদ্যালয়ের চিকিৎসা কেন্দ্রে প্রাথমিক চিকিৎসা দেওয়া হয়। ওই দিন বিকাল সাড়ে ৫টার দিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের ফুটবল মাঠে এ ঘটনা ঘটে।
আরও পড়ুন: শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের অর্জন আর সাফল্যের বছর, ছিল গবেষণাকর্মও
চার দশক পর মোবাইলে সকল ফি দিতে পারবেন শিক্ষার্থীরা
চার দশক পর বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষার ফি-সহ সব ধরণের ফি অনলাইন ও মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে দেওয়ার ব্যবস্থা গ্রহণ করে প্রশাসন। এটি বাস্তবায়নে অগ্রণী ব্যাংকের কেন্দ্রীয় আইটি টিম, ব্যাংকের ইবি শাখা, বিশ্ববিদ্যালয়ের আইসিটি সেল ও বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন সমন্বিতভাবে কাজ করছে। যা গত ২২ ডিসেম্বর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাবার্ষীকিতে উদ্বোধন করেন উপাচার্য।
লাল ফিতার দৌরাত্ম্য, ফাইল চলে না
ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের (ইবি) বিভিন্ন দফতর ও বিভাগসমূহের বিভিন্ন কাজে প্রশাসনের অনুমোদন নিতে হয়। এ জন্য অনুমতি চেয়ে ফাইল প্রশাসন বরাবর জমা দিতে হয়। এ ফাইল যেন চলে কচ্ছপ গতিতে। আবার ফাইল হারিয়ে ফেলেন প্রশাসনিক কর্মকর্তারা। কর্মকর্তাদের গাফিলাতির ফলে এমন পরিস্থিতি সৃষ্টি হচ্ছে বলে মনে করেন সচেতন শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা। এতে ক্ষুব্ধ বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভাগগুলোর দফতর প্রধানসহ অন্যান্য অফিস প্রধানরা। বারবার অভিযোগ করলেও উদাসীন বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ।
নিয়ন্ত্রণহীন ইবির পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক
বছরের অন্যতম সমালোচিত বিষয় নিয়ন্ত্রণহীন ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক দফতর। অ্যাকাডেমিক ট্রান্সক্রিপ্ট, নম্বরপত্র ও সনদসহ প্রয়োজনীয় কাগজপত্র উত্তোলন করতে গিয়ে ভোগান্তিসহ নানা ধরনের সমস্যায় পড়তে হয় বলে অভিযোগ শিক্ষার্থীদের। এ ছাড়া শিক্ষার্থীদের আবেদন হারিয়ে যাওয়া, অফিসে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাকে না পাওয়া, কাউকে পেলেও তারা লাঞ্চের পরে আসার জন্য বলেন, টাকার বিনিময়ে সেবা প্রদান, শিক্ষার্থীদের সঙ্গে অসদাচরণসহ কর্মকর্তারা আমবাগানে আড্ডায় ব্যস্ত থাকেন বলে অভিযোগ রয়েছে।
সংশ্লিষ্ট দপ্তর সূত্রে জানা যায়, বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রায় ১৮ হাজার শিক্ষার্থীদের সনদ লেখার জন্য লিপিকুশলী রয়েছেন মাত্র একজন। স্বাভাবিকভাবে আবেদনের ১৫ দিনের মধ্যে পরীক্ষার নম্বরপত্র বা সনদ দেয়ার নিয়ম থাকলেও তা পেতে বিলম্ব হচ্ছে কয়েকমাস। এদিকে পরীক্ষা নিয়ন্ত্রকের ট্যাবুলেশন শিট রাখা গোপনীয় কক্ষ হলেও শিক্ষার্থীদের অবাধ যাতায়াত রয়েছে।
দুই ছাত্রীসহ ৪ মৃত্যু
ভবনের ছয়তলা থেকে লাফ দিয়ে ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের ল এন্ড ল্যান্ড ম্যানেজমেন্ট বিভাগের ২০১৭-১৮ সেশনের শিক্ষার্থী নওরিন নুসরাতের এ বছর মৃত্যু হয়। গত ৮ আগস্ট বেলা ছয়টার দিকে আশুলিয়ার পলাশবাড়ী নামাবাজারের পাশে বিজয়নগর রোডে আব্দুর রহিমের মালিকানাধীন বাড়িতে এ ঘটনা ঘটে। নওরীন নুসরাতের বাড়ি নুসরাত স্নিগ্ধা টাঙ্গাইলের জেলা থানার ইসলামবাগ গ্রামের খন্দকার নজরুল ইসলামের মেয়ে।
হিউম্যান রিসোর্স ম্যানেজমেন্ট বিভাগের ২০১৮-১৯ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থী রাকিব উদ্দিন স্ট্রোক জনিত কারণে মৃত্যু বরণ করেন। জন্ডিসে আক্রান্ত হয়ে ফিন্যান্স এন্ড ব্যাংকিং বিভাগের ২০২২-২৩ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থী আকলিমা আক্তার আঁখি মারা যান গত ২৪ ডিসেম্বর। রংপুর ডক্টরস ক্লিনিকে আইসিইউতে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তার মৃত্যু হয়।
এছাড়া চলতি বছরের আগস্ট মাসে রাজধানীর ইবনে সিনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ইবি কেন্দ্রীয় মসজিদের ইমাম ও খতিব ড. আ স ম শোয়াইব ইন্তেকাল করেন।
আরও পড়ুন: শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের অর্জন আর সাফল্যের বছর, ছিল গবেষণাকর্মও
মেডিকেল ভাংচুর
অ্যাম্বুলেন্স দিতে দেরি করায় ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের (ইবি) চিকিৎসা কেন্দ্রে ভাংচুর করেন আইন বিভাগের শিক্ষার্থী রেজওয়ান সিদ্দিকী কাব্য ও তার সঙ্গীরা। মাদকাসক্ত অবস্থায় এমনটি করেছিল বলে দাবি মেডিকেল কর্তৃপক্ষের। এ ঘটনায় তিন শিক্ষার্থীর বহিষ্কার করা হয়। বহিষ্কৃতরা হলেন, আইন বিভাগের ছাত্র রেজোয়ান সিদ্দিক কাব্য, র্যাগিংয়ের ঘটনায় হিউম্যান রিসোর্স ম্যানেজমেন্ট বিভাগের ২০২১-২২ সেশনের শিক্ষার্থী হিশাম নাজির শুভ এবং মিজানুর রহমান ইমন।
জিয়া হল প্রভোস্ট কার্যালয় ভাঙচুর
বিশ্ববিদ্যালয়ের জিয়াউর রহমান হলের আবাসিক শিক্ষার্থীদের তথ্য নিতে গিয়ে প্রভোস্ট সহকারী অধ্যাপক জলিল পাঠানকে লাঞ্ছিত ও প্রভোস্টের কার্যালয় ভাঙচুর করে ছাত্রলীগের কর্মীরা। চলতি বছর ১৪ মার্চ রাত সাড়ে ১০টার দিকে এ ঘটনা ঘটে।
উপাচার্যের একাধিক নিয়োগ বাণিজ্যের অডিও ফাঁস
বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. শেখ আবদুস সালামের ‘কণ্ঠ সদৃশ’ নিয়োগ সংক্রান্ত একাধিক অডিও ভাইরাল হয় এ বছর। বিভিন্ন নামের ফেইসবুক আইডি থেকে প্রায় ১৫ টি অডিও ভাইরাল করা হয়। অডিওতে ভাইভার আগে চাকরির প্রশ্নফাঁস, নিয়োগ অর্থ লেনদেন সংক্রান্ত কথোপকথন ও শিক্ষক-কর্মকর্তাদের নিয়ে নেতিবাচক মন্তব্য শোনা যায়।
এ ঘটনায় বিশ্ববিদ্যালয়ে চাকরি প্রত্যাশীরা আন্দোলন ও ভিসির কার্যালয়ে তালা দিয়ে ভিসির একান্ত সচিবকে অব্যাহতি এবং শিক্ষক সমিতি ও শাপলা ফোরাম সরকারের হস্তক্ষেপ কামনা ও তদন্ত করে ব্যবস্থার দাবি করেন।
রেজিস্ট্রারের কণ্ঠ সদৃশ অডিও ক্লিপ ফাঁস
ভারপ্রাপ্ত রেজিস্ট্রার এইচ এম আলী হাসানের ঠিকাদারের সঙ্গে ‘অর্থ লেনদেন সংক্রান্ত' আলাপন ফাঁস হয়। পহেলা মে ‘সাথী খাতুন’ নামক একটি ফেসবুক আইডি থেকে ৪৪ সেকেন্ডের একটি রেকর্ড সম্বলিত একটি অডিও ক্লিপ ভাইরাস ভাইরাল হয়। অডিওতে রেজিস্ট্রারকে বলতে শোনা যায়, ‘এখন একটা চেক নিয়ে যান। দেওয়ার কথা ছিল ৬ লাখ এখন ৪ লাখ দেন। এক কাজ করেন ৫ লাখ দেন। আমার কথাও থাক আপনার কথাও থাক।’
অনার্সে ফেল করেও মাস্টার্স পাশ
বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিন্যান্স অ্যান্ড ব্যাংকিং বিভাগের ২০১৩-২০১৪ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থী শামীরুল ইসলাম। তার ২০১৭ সালে স্নাতক শেষ বর্ষের পরীক্ষা অনুষ্ঠিত। তার রোল নম্বর ছিল ১৩২১০৩৭। পরে স্নাতক শেষ বর্ষের ৪১৫ নম্বর কোর্সে ফেল করেন তিনি। তবুও ২০১৭-১৮ শিক্ষাবর্ষে তিনি স্নাতকোত্তরে ভর্তি হন। ২০১৮ সালে তিনি সংশ্লিষ্ট বিভাগ থেকে স্নাতকোত্তরে কৃতকার্য হন। পরবর্তীতে দীর্ঘ চার বছর পর স্নাতক শেষ বর্ষের অকৃতকার্য বিষয়ে পরীক্ষার জন্য তিনি আবেদন করলে বিষয়টি প্রকাশ্যে আসে ও আলোচনার সৃষ্টি করে। এ ঘটনায় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের মাঝে বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়। পরে ওই শিক্ষার্থীর বিশ্ববিদ্যালয়ের সকল সনদ বাতিলের সিদ্ধান্ত নেন কর্তৃপক্ষ।