শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের অর্জন আর সাফল্যের বছর, ছিল গবেষণাকর্মও
- রিয়া মোদক, হাবিপ্রবি
- প্রকাশ: ২৮ ডিসেম্বর ২০২৩, ১০:৩৫ PM , আপডেট: ২৮ ডিসেম্বর ২০২৩, ১১:৩২ PM
হাজী মোহাম্মদ দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (হাবিপ্রবি) উপাচার্য অধ্যাপক ড. এম. কামরুজ্জামানের নেতৃত্বে শেষ হতে চলেছে ২০২৩ সাল। বছরজুড়ে শিক্ষক-কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের প্রচেষ্টায় প্রায় সকল শাখায় সফলতার সাথে এগিয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়টি। শিক্ষকদের গবেষণাকর্মে আন্তরিকতা ও নিরন্তর প্রচেষ্টা, শিক্ষার্থীদের একাগ্রতা, অনুশীলন-অনুধাবনে অভিনিবেশ সাফল্য জাতীয় পর্যায়ে স্বীকৃতি এনে দিয়েছে। বছরজুড়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের এমন অর্জন ছিল চোখে পড়ার মতো নানান ঘটনা। আর এসব নিয়েই সাজানো হয়েছে এ সালতামামি।
গবেষণাকর্মে শিক্ষকদের সফলতা
বিদায়ী বছরে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের গবেষণাকর্মে সাফল্য, জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক পর্যায়ে স্বীকৃতি পেয়েছে। বিভিন্ন গবেষণা প্রকল্পে তারা উল্লেখযোগ্য অবদান রেখেছেন। এবছর অ্যালপার ডগার (এডি) সায়েন্টিফিক ইনডেক্সের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত বিশ্বসেরা গবেষকদের তালিকায় স্থান পেয়েছে হাবিপ্রবির ১১১ জন গবেষক শিক্ষক ও শিক্ষার্থী। গত বছর এ সংখ্যা ছিল ৩২। যা গত বছরের তুলনায় তিনগুণ।
গবেষকদের গুগল স্কলারের রিসার্চ প্রোফাইলের বিগত পাঁচ বছরের এইচ-ইনডেক্স, আই-১০ ইনডেক্স স্কোর এবং সাইটেশনের ওপর ভিত্তি করে প্রতিবছর বিশ্বসেরা গবেষক ও সেরা বিশ্ববিদ্যালয়ের তালিকা প্রকাশ করে এডি। এছাড়া প্রতিবছরই গবেষণায় উৎসাহ যোগাতে সেরা প্রেজেন্টার অ্যাওয়ার্ড প্রদান করে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। এবছর বেস্ট রিসার্চ অ্যাওয়ার্ড পেয়েছেন প্রত্যেক অনুষদ থেকে মোট ৯ জন শিক্ষক।
বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিষয়ে গবেষণা ও উন্নয়ন কাজে উৎসাহ ও অনুপ্রেরণা প্রদানের লক্ষ্যে প্রতিবছর গবেষণা প্রকল্পে অনুদান প্রদান করা হয়। যেখানে ৬৮ লাখ টাকার অনুদান পেয়েছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের ৪৪ শিক্ষক।
এছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়টির বিভিন্ন অনুষদের শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা সম্মিলিতভাবে বিভিন্ন ধরনের গবেষণায় সফলতা অর্জন করছেন। হাবিপ্রবির বায়োকেমিস্ট্রি অ্যান্ড মলিকিউলার বায়োলজি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. আজিজুল হক হেলাল ও তার একদল গবেষক শিক্ষার্থী বিষমুক্ত বেগুন উৎপাদনের লক্ষ্যে বায়োফার্টিলাইজার (এন্ডোফাইটিক ব্যাকটেরিয়া) প্রয়োগে সফলতা পেয়েছেন।
এই গবেষণার ফলে বেগুনের ফলন তিন থেকে চারগুণ বেশি এবং প্রায় শতভাগ বিষমুক্ত হয়েছে। এছাড়াও, এই বায়োফার্টিলাইজার প্রয়োগের ফলে জমিতে কীটনাশকের ব্যবহারের পরিমাণ প্রায় শূন্যের কোঠায় নেমে এসেছে।
কোনো প্রকার বিষ বা হরমোন ব্যবহার ছাড়াই শুধুমাত্র স্বল্প মাত্রায় ইউরিয়া (টিএসপি, পটাশ) ও ব্যাকটেরিয়ার ব্যবহার করে টমেটো চাষে ব্যাপক সফল হয়েছেন হাবিপ্রবি গবেষক ড. আজিজুল হক ও তার দল। ইউনেস্কোর দ্যা ওয়ার্ল্ড একাডেমি অফ সায়েন্সেস (টিডব্লিউএএস) তাদের এই গবেষণায় অনুদান দিয়েছে। শতকরা পানির পরিমাণ কম হওয়ায় এই টমেটো ফ্রিজে না রেখেই এক মাস সময় পর্যন্ত ভালো থাকবে।
দেশের গবেষণায় এক নজির স্থাপন করে হাবিপ্রবির জেনেটিক্স অ্যান্ড অ্যানিমেল ব্রিডিং বিভাগের গবেষকরা ইনকিউবেটরে উটপাখির ডিম থেকে বাচ্চা ফুটিয়েছেন। এই গবেষণার ফলে উটপাখির চাষে খরচ ৩০-৩৫ হাজার টাকা কমানো সম্ভব হবে বলে আশা করা হচ্ছে।
হাবিপ্রবি ফুড ইঞ্জিনিয়ারিং এন্ড টেকনোলজি বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. সাজ্জাত হোসেন সরকার এবং তার গবেষক দলের উদ্ভাবিত এইচএসটিইউ মাল্টি ক্রপ ড্রায়ার মেশিন দিয়ে স্থাপিত তৃতীয় মিল রিচ ফিড এন্টারপ্রাইজ মিল। মিলটি দিয়ে প্রতিদিন ৩-৪ ব্যাচে, শস্যের আর্দ্রতা ভেদে ৪০ থেকে ৫০ টন শস্য বিশেষ করে ধান, ভুট্টা শুকনো যাবে। কেজি প্রতি মাত্র ৫০ থেকে ৭০ পয়সা খরচে ফসলের আর্দ্রতা শুকিয়ে ১৩-১৪ শতাংশে আনা সম্ভব। ধানের তুষ পুড়িয়ে চালিত সাইক্লোনিক ফারনেস দিয়ে চালানো ড্রায়ারটি একই সাথে পরিবেশ বান্ধব ও জ্বালানি সাশ্রয়ী।
শিক্ষার্থীদের সাফল্য
এ বছর প্রধানমন্ত্রী স্বর্ণপদক পেয়েছেন হাবিপ্রবির ৮ শিক্ষার্থী। স্নাতকে রেকর্ড নম্বর পেয়ে উত্তীর্ণ হওয়া শিক্ষার্থীদের এ স্বর্ণপদক প্রদান করা হয়। প্রধানমন্ত্রীর হাত থেকে ‘বঙ্গবন্ধু স্কলার অ্যাওয়ার্ড’ পায় হাবিপ্রবির সুরাইয়া। হাবিপ্রবি থেকে মোছা. সুরাইয়া আক্তার প্রথম এই অ্যাওয়ার্ডে ভূষিত হন।
রুয়েটে প্রজেক্ট প্রদর্শনী প্রতিযোগিতায় চ্যাম্পিয়ন হয় হাবিপ্রবির এইচএসটিইউ টেক টাইটানস'। তাদের প্রজেক্টের নাম ছিল- Sumz.Al। এছাড়া জাতীয় পর্যায়ে সমাজ উন্নয়ন অ্যাওয়ার্ড পেয়েছেন হাবিপ্রবির সাদী চৌধুরী। তিনি ফিন্যান্স এন্ড ব্যাংকিং বিভাগের ১৭ ব্যাচের শিক্ষার্থী। তিনি ২০১৭ সাল থেকে হাবিপ্রবি রোভার স্কাউটস গ্রুপের সাথে যুক্ত রয়েছেন।
অস্ট্রেলিয়ার ভিক্টোরিয়ার ডেকিন বিশ্ববিদ্যালয়ে ফুল ফান্ডেড স্কলারশিপ পেয়েছেন হাবিপ্রবি শিক্ষার্থী মাহমুদুল হাসান মুন। পিএইচডি প্রোগ্রামে পড়ালেখার সুযোগ পেয়েছেন তিনি। মুন বিশ্ববিদ্যালয়ের সিএসই বিভাগের শিক্ষার্থী।
স্মার্ট বাংলাদেশ পুরস্কার পেলেন হাবিপ্রবির শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের একটি দল। প্রোজেক্টটি বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসিই বিভাগের অধ্যাপক ও ছাত্র পরামর্শ ও নির্দেশনা বিভাগের পরিচালক অধ্যাপক ড. মো. মাহাবুর হোসেনের তত্ত্বাবধানে পরিচালিত হয়। প্রোজেক্টটির সবথেকে বড় সাফল্য হচ্ছে এই পোল্ট্রি রোবট শুধু মনিটরিং-ই করবে না, তাৎক্ষণিক ব্যবস্থাও গ্রহণ করবে। যেকোনো সুইচ অন-অফ করে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের পাশাপাশি রোবটটি তার মালিকের কাছে মেসেজিং-এর মাধ্যমে তাৎক্ষণিক পরিস্থিতির বার্তা প্রেরণ করতে পারবে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়ন
বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের দুর্ভোগ কমানোর জন্য এবছর ওয়ান স্টপ সার্ভিস চালু করা হয়। শিক্ষার্থীদের প্রয়োজনীয় সনদ উত্তোলন সহজীকরণের লক্ষ্যেই ওয়ান স্টপ সার্ভিস পদক্ষেপ নিয়েছে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। এছাড়া লাইব্রেরি অটোমেশন ও ডিজিটাইজেশন প্রক্রিয়ার উদ্বোধন করা হয়েছে। অটোমেশন ও ডিজিটাইজেশনের ফলে লাইব্রেরিতে কি কি বই আছে, সেটা ঘরে বসেই স্মার্ট ফোনের মাধ্যমে শিক্ষার্থীরা চেক করতে পারবেন।
চলতি বছরের উদ্যোগের ফলে শিক্ষার্থীরা অনলাইনের মাধ্যমে এনরোলমেন্ট সুবিধা পেতে যাচ্ছেন। এর মাধ্যমে শিক্ষার্থীরা খুব সহজেই অনলাইন মাধ্যম ব্যবহার করেই এনরোলমেন্ট করাসহ পরীক্ষার এডমিট কার্ড ডাউনলোড করতে পারবেন। এছাড়াও রিপিট শিক্ষার্থীদের মার্কসহ যাবতীয় তথ্য অটোমেটিক হালনাগাদ হবে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের একাডেমিক কার্যক্রমে উৎসাহিত করতে মেধার স্বীকৃতিস্বরূপ বিভিন্ন ক্যাটাগরিতে চারটি অ্যাওয়ার্ড দেবে প্রশাসন। আগে থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ে শুধুমাত্র ডিন’স লিস্ট অ্যাওয়ার্ড চালু থাকলেও এবছর নতুন তিনটি অ্যাওয়ার্ড চালু করে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। বিশ্ববিদ্যালয়ের রিজেন্ট বোর্ডের সভায় প্রবর্তিত নতুন তিনটি অ্যাওয়ার্ড হলো- ডিনস্ মেরিট অ্যাওয়ার্ড, ভাইস-চ্যান্সেলর্স মেরিট অ্যাওয়ার্ড এবং চ্যান্সেলর্স গোল্ড মেডেল অ্যাওয়ার্ড।
বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির প্রথম দিনেই নবীনবরণ অনুষ্ঠানে শিক্ষার্থীদের আরএফআইডি কার্ড প্রদান করা হয়। আরএফআইডি আইডি কার্ড হলো রেডিও ফ্রিকোয়েন্সি প্রযুক্তি সম্বলিত একটি কার্ড। যার মাধ্যমে শিক্ষার্থীরা স্টুডেন্ট আইডি কার্ড, লাইব্রেরি কার্ড এবং পরিবহণ আইডি কার্ডের সুবিধা একসঙ্গে ব্যবহার করতে পারবেন।
এছাড়া এবছরই প্রশাসন নতুন ছাত্রী হলে ছাত্রীদের উঠানো শুরু করেছে। এতে করে বিশ্ববিদ্যালয়ে আবাসন সংকট কিছুটা হলেও কমছে বলে জানিয়েছেন তারা। বর্তমানে নতুন ছাত্রীহলসহ মেয়েদের মোট ৪টি হল রয়েছে।
চুক্তি
উচ্চ শিক্ষায় গবেষণা সক্ষমতা বৃদ্ধি করার লক্ষ্যে ব্র্যাক ব্যাংক লিমিটেডের সাথে হাবিপ্রবি একটি সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হয়েছে। এছাড়াও ভিয়েতনামের দুটি বিশ্ববিদ্যালয়ের সাথে সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত করেছে হাবিপ্রবি। কৃষি বনায়ন ও পরিবেশ বিভাগে পরিচালিত ইউ ইরমুনাস এসইএ-এশিয়া (EU Erasmus SEA- ASIA) প্রোগ্রামের আওতায় ভিয়েতনামে দুইটি সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হয়।
এই চুক্তির মাধ্যমে হাবিপ্রবির ছাত্র-ছাত্রী এবং শিক্ষকগণ উক্ত দুই বিশ্ববিদ্যালয়ে উচ্চতর শিক্ষা গবেষণা এবং অর্জিত জ্ঞান বিনিময় করতে পারবেন। বিশেষ করে কৃষি, বনায়ন, আইসিটি রসায়ন, ইঞ্জিনিয়ারিং ও পরিবেশ ব্যবস্থাপনা, ফুড সায়েন্স, পরিবেশ বিজ্ঞান সহ অন্যান্য সংশ্লিষ্ট বিষয়ে ছাত্র-ছাত্রীরা উচ্চতর শিক্ষা অর্জনের সুযোগ পাবেন।