জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের মাস্টার্সে অর্থনীতিতে ফলাফল বিপর্যয়
- হোসাইন আরমান
- প্রকাশ: ১১ অক্টোবর ২০২২, ১১:১১ AM , আপডেট: ১১ অক্টোবর ২০২২, ০১:৫৫ PM
জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে অনুষ্ঠিত ২০১৯ সালের মাস্টার্স শেষ পর্ব পরীক্ষার ফল প্রকাশিত হয় চলতি মাসের ০২ অক্টোবর। এই পরীক্ষায় পাস করেছেন ৬৮ দশমিক ১৯ শতাংশ শিক্ষার্থী। এতে অর্থনীতি বিভাগের ফলাফলে বিপর্যয় দেখা দিয়েছে। বিভাগটিতে পাসের হার এবং ফার্স্ট ক্লাসের সংখ্যাও ছিল হাতে গোনা। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে দেশের স্বনামধন্য কয়েকটি কলেজে বিভাগটির ফলাফল বিশ্লেষণে দেখা যায় এতে অন্তত ৮০ শতাংশ শিক্ষার্থী ফেল করেছেন।
চলতি বছরের ফল বিশ্লেষণে দেখা গেছে, ফেল করা বেশিরভাগ পরীক্ষার্থীই সামষ্টিক অর্থনীতি এবং ব্যষ্টিক অর্থনীতি কোর্সের। আর যারা পাস করেছেন তাদের অধিকাংশই এ দুই বিষয়ে ‘ডি’ ও ‘সি’ গ্রেড নিয়ে পাস করেছেন।
জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে দেশের স্বনামধন্য ১৩টি কলেজের অর্থনীতি বিভাগের স্নাতকোত্তর ২০১৯ সালের ফলাফলের পরিসংখ্যানে দেখা যায়, এবার সিলেট এম.সি কলেজের ৬৪৩ জন পরীক্ষার্থীর মধ্যে পাস করেন ১২৩ জন, ফেল করেছেন ৫২০ জন। পাসের হার ১৯.২, ফেল ৮০.৮ শতাংশ। সর্বোচ্চ পয়েন্ট পান সাইরা খাতুন (৩.৬১)।
চট্টগামের সরকারী মহসিন কলেজে ৬১৩ জনের মধ্য ফেল করেন ৪৬০ জন। পাস করেন ১৫৩ জন। পাসের হার ২৫ শতাংশ, ফেলের হার ৭৫ শতাংশ। সর্বোচ্চ পয়েন্ট পান মো. তানিমুল হাইদার (৩.৫০)। বগুড়ার সরকারী আজিজুল হক কলেজে ৪৮৪ জনের মধ্য পাস করেন ১১৫ জন এবং ফেল করেন ৩৬৯ জন। পাসের হার ২৩.৮ ও ফেল ৭৬.২ শতাংশ। সর্বোচ্চ পয়েন্ট মোছা. সাকিলা খাতুন (৩.৩৪)।
বরিশালের সরকারি বি.এম. কলেজে ৩৬৩ জনের মধ্যে ২৬৫ জনই ফেল এবং পাস করেন মাত্র ৯৮ জন। পাসের হার ২৭.০ ও ফেল ৭৩ শতাংশ। সর্বোচ্চ পয়েন্ট লিমা আক্তার (৩.৪২)। রংপুরের কার মাইকেল কলেজে ৭১২ জন পরীক্ষার্থীর মধ্যে ফেল করেন ৪২৭ পাস করেন ২৮৫ জন। পাসের হার ৪০.০, ফেল ৬০.০ শতাংশ। সর্বোচ্চ পয়েন্ট মোছা. মৌসুমি আক্তার (৩.৩৪)।
গাজীপুরের ভাওয়াল বদরে আলম সরকারি কলেজে ২৬১ জনের মধ্যে পাস করেন ৬৬ এবং ফেল ১৯৫ জন। পাসের হার ২৫.৭, ফেল ৭৪.৩ শতাংশ। সর্বোচ্চ পয়েন্ট সুমাইয়া সারা (৩.৩৮)। ঢাকা সিটি কলেজে ৩১৪ জনের মধ্যে মাত্র ৯৬ জন পাস করেন ফেল ২১৮ জন। পাসের হার ৩১.০, ফেল ৬৯.০ শতাংশ। চট্টগ্রাম কলেজের ৭৭৬ জনের মধ্যে ফেলই করেন ৫৩৮ জন, পাস করেন ২৩৮ জন। পাসের হার ২৯.৫, ফেল করেন ৭০.৫ শতাংশ।
আরও পড়ুন: অর্থনীতি: পাস করা যেখানে কষ্টের, ফার্স্ট ক্লাস সেখানে বিলাসিতা
আনন্দ মোহন কলেজের ৪৭৯ জন পরীক্ষা দিয়ে পাস করে ১৯১ জন, ফেল ৩৮৮ জন। পাসের হার ৪০.০, ফেল করেন ৬০.০ শতাংশ। সর্বোচ্চ পয়েন্ট মৌমিতা আফরিন (৩.৫৬)। খুলনা সরকারী বি.এল কলেজের মোট পরীক্ষার্থ ছিলো ৫৫৫ জন। পাস করেন ২৫৪ জন, ফেল ৩০১ জন। পাসের হার ৪৬.০, ফেলের করেন ৫৪.০ শতাংশ। সর্বোচ্চ পয়েন্ট চৈতী সাহা (৩.৪৪)।
ভিক্টোরিয়া সরকারি কলেজের ৪৭১ জন পরীক্ষা দিয়ে পাস করেন ২১৭ জন এবং ২৫৪ জন ফেল করেন। পাসের হার ৪৭.০, ফেল ৫৩.০ শতাংশ। সর্বোচ্চ পয়েন্ট নাসরিন আক্তার (৩.৭৮)। রাজশাহী সরকারি কলেজের ৫৬৭ জনের মধ্যে ৩৬৪ জন ফেল করেন। পাস করেন ২০৩ জন। পাসের হার ৩৫.৮, ফেল ৬৪.২ শতাংশ। সর্বোচ্চ পয়েন্ট মো. শিমন আলি (৩.৩৮)। ফেনী সরকারি কলেজের ৩৩২ জন পরীক্ষার্থীর মধ্যে পাস করেন মাত্র ৭৭ জন। ফেল করেন ২৫৫ জন অথাৎ সিংহভাগ অংশ ৭৬.৮৮ শতাংশ শিক্ষার্থী ফেল করেন, পাস করেন ২৩.১৯ শতাংশ।
এর আগে চলতি বছরের এপ্রিলে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতকোত্তর ২০১৮-১৯ শিক্ষাবর্ষের চূড়ান্ত পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়। এতে মোট পরীক্ষার্থীর সংখ্যা ছিল ২ লাখ ১৫ হাজার ৯০৯ জন। ১১৭টি কেন্দ্রে ১৭৫টি কলেজে ৩০টি বিষয়ে এই পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়।
শিক্ষার্থীদের অভিযোগ, মাস্টার্সে ভর্তি হওয়ার পর করোনা মহামারী শুরু হয়। এজন্য তারা কোন ক্লাস করতে পারেননি। এই দুই কোর্সের প্রশ্নও কঠিন হয়েছে। এছাড়া খাতা কঠিনভাবে মূল্যায়ন করার কারণে এমন ফলাফল বিপর্যয় হয়েছে বলে অভিযোগ করেন তারা।
গোপালগঞ্জের বঙ্গবন্ধু সরকারি কলেজের অর্থনীতি বিভাগের দেড় শতাধিকের বেশি শিক্ষার্থী ২০১৯ সালের মাস্টার্স পরীক্ষা অংশ নিয়ে পাস করেছেন মাত্র ২৮ জন। ওই কলেজের ছাত্র আলি আমিন বলেন, আমাদের অনেকের চাকরির বয়স শেষের দিকে এবং দীর্ঘ বিরতির পর মাস্টার্স পরীক্ষা হওয়ার কারণে আমরা ২০২০-এর পরীক্ষা ২০২২-এ এসে দিয়েছি। আমাদের পরীক্ষা সময় মত হলে আমরা এটিকে ওভারকাম করতে পারতাম। কিন্তু মাস্টার্সের ফলের জন্য আমরা বসে আছি।
আলি আমিন বলেন, ‘আমাদের তো চাকরির বয়স আছে আর এক থেকে দেড় বছর। এখন এই মাস্টার্সের চাপের ফলে হাজার হাজার শিক্ষার্থী চাকরির জন্য আর কোন প্রকার চেষ্টাই করতে পারবো না। আমাদের বেশির ভাগ শিক্ষার্থীদের একটি বিষয় অকৃতকার্য দেখানো হয়েছে। কিন্তু অন্য সকল বিষয় মিলিয়ে আমাদের বিশেষ বিবেচনা করে প্রমোটেড দেখিয়ে দিলে আমাদের জীবন থেকে একটি বছর নষ্ট হবে না। আমরা এ ব্যাপারে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের দৃষ্টি আকর্ষন করছি।
রংপুর কারমাইকেল কলেজের ছাত্রী রাবেয়া আক্তার বলেন, সব কলেজের একই চিত্র। সবাই তো আর দুর্বল শিক্ষার্থী না। সবাই পড়ালেখা করেননি বিষয়টি এমন না। বিগত সময়ে কখনও এমন ফলাফল বিপর্যয় ঘটেনি। আমাদের খাতার পুনঃমূল্যায়নের দাবি করছি।
আরও পড়ুন: বদলে গেল গার্হস্থ্য অর্থনীতি কলেজের নাম
তবে ফলাফল বিপর্যয়ের জন্য শিক্ষার্থীদের উদাসীনতাকেই দায়ী করেছেন শিক্ষকরা। জানতে চাইলে এ বিষয়ে ফেনী সরকারি কলেজের অর্থনীতি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক মো. আইয়ুব দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, শিক্ষকদের সাথে শিক্ষার্থীদের কোন সম্পর্ক নেই। আমরা কাউকে ক্লাসে দেখি না। ক্লাস করে না। পরীক্ষার একমাস আগে একটা গাইড বই কিনে সামান্য প্রস্তুতি নিয়ে পরীক্ষা দেয়। পড়ালেখার প্রতি কোন গুরুত্ব নেই।
পরীক্ষার্থীরা অভিযোগ করেন কঠিনভাবে খাতা মূল্যায়নের কারণে ফেলের সংখ্যা বৃদ্ধি পায়। তাদের এই অভিযোগ অস্বীকার করে তিনি বলেন, খাতা মূল্যায়নে কোন সমস্যা নেই। অর্থনীতি বিষয়ে অনেক অংক থাকে যদি সঠিক না হয় তাহলে তো নাম্বার দেয়ার সুযোগ নেই। খাতায় সঠিক লিখা থাকলেইতো আমার নম্বর দিবো।
এ বিষয়ে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক মশিউর রহমান বলেন, যারা খাতা মূল্যায়ন করেন অথাৎ শিক্ষকরা শিক্ষার্থীদের বিরোধী না। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের খাতা মূল্যায়নের যে পদ্ধতি তাতে কোন শিক্ষক কোন কলেজের খাতা মূল্যায়ন করছেন সেটা জানারও সুযোগ নেই। প্রত্যেক শিক্ষকের খাতা মূল্যায়ন পদ্ধতি ভিন্ন রকম। কেউ নাম্বার কম দেয় কেউ বেশি দেয়। কিন্তু শিক্ষকরা কখনই ইচ্ছা করে শিক্ষার্থীদের ফেল করান না।
তিনি বলেন, দেখা যায় শিক্ষার্থী পাস করলে সেটা তার ক্রেডিট। আর ফেল করলে সেটা শিক্ষকের দোষ। শিক্ষক ফেল করিয়ে দিয়েছে। সে ফেল করেনি তাকে ফেল করানো হয়েছে। এখন সমস্যা হলো অর্থনীতি একটা ভালো বিষয় এবং একটু কঠিনও আছে। আর যে কোর্সে বেশিরভাগি শিক্ষার্থী ফেল করেছন হয়তো কোর্সটি একটু কঠিন ছিলো। হতে পারে প্রশ্নও কঠিন হয়েছে। শিক্ষার্থীরা ঠিকমত পড়েননি। এজন্য হয়তো এমন হয়েছে।
উপাচার্য আরও বলেন, আমি পরীক্ষা নিয়ন্ত্রকের সাথে কথা বলে বিষয়টি দেখবো। আসলে কি হয়েছিলো। কেন এই ফলাফল বিপর্যয়। আমাদেরতো খাতা পুনঃমূল্যায়নের সুযোগ নেই। পুনঃনিরিক্ষা করতে পারবে। কারও নম্বর গণনায় ভুল হলে বা নম্বর যোগ না হলে সেটা ঠিক করে দিতে পারেব। খাতা মূল্যায়নের সময় একটু এদিক-সেদিক হতে পারে। কেউ ২০ পাওয়ার থাকলে তাকে হয়তো ১৮ দিয়েছে। কিন্তু কেউ ১০ পেলে তাকে তো দুই দেবে না। তবুও বিষয়টি আমরা বিবেচনা করবো।