ফারইস্ট ইউনিভার্সিটি
ইউজিসির শর্ত ভেঙে ট্রাস্টি সদস্যের ছেলে-মেয়েকে নিয়োগ, শিক্ষক হয়েছেন ২.৬৪ সিজিপিএ নিয়েও!
- নবাব আব্দুর রহিম
- প্রকাশ: ২৯ নভেম্বর ২০২৫, ০৮:২২ PM , আপডেট: ২৯ নভেম্বর ২০২৫, ০৮:২২ PM
বেসরকারি ফারইস্ট ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটিতে (এফআইইউ) নীতিমালা ভেঙে শিক্ষক নিয়োগ এবং পদায়নের অভিযোগ উঠেছে। যোগ্যতা না থাকলেও প্রভাব খাটিয়ে নিয়োগ পেয়েছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্রাস্টি বোর্ড সদস্যদের ছেলে-মেয়েরাও। সরাসরি নিয়োগে যোগ্যতা বিবেচনা না করার পাশাপাশি পদোন্নতিতেও অনুসরণ হয়নি কোনো নীতি-নিয়ম।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, দেশত্যাগী সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার চাচা, দেশের বেসরকারি উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর মালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় সমিতির (এপিইউবি) সদ্য সাবেক চেয়ারম্যান ও বিশ্ববিদ্যালয়টির ট্রাস্টি বোর্ডের সদস্য শেখ কবির হোসেনের তত্ত্বাবধানে এসব অনিয়ম সংগঠিত হয়েছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দেশের বেসরকারি উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে শিক্ষা, গবেষণা এবং অন্যান্য বিচারে সামগ্রিক পিছিয়ে থাকলেও বিগত আওয়ামী সরকারের প্রভাব খাটিয়ে সবসময়ই আইন ও নীতিমালার বাইরে থাকার সুযোগ পেয়েছে প্রতিষ্ঠানটি। তা ছাড়া ফারইস্ট ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটিতে নিয়ম ভেঙে শিক্ষক এবং কর্মকর্তার নিয়োগ হয়েছে পরিবারের সদস্যদের প্রতিষ্ঠানটিতে অবৈধ সুযোগ দেওয়ার জন্য।
আরও পড়ুন: মেডিকেলেও ছাত্র সংসদ চায় শিবির, উদাসীন অন্যরা, সাড়া নেই প্রশাসনের
আইন ও নিয়ম ভেঙে নিয়োগের ঘটনা ঘটেছে খোদ আইন বিভাগেও। বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘আইন ও বিচার’ নামের এ বিভাগে কোন রকম পূর্ব অভিজ্ঞতা ছাড়াই সহকারী অধ্যাপক বনে যান রিসাত নূর।
বিশ্ববিদ্যালয়টির কয়েকটি নিয়োগ এবং সংশ্লিষ্ট প্রমাণাদি বিশ্লেষণে দেখা দেখা গেছে, ফলাফলে অযোগ্যতা থাকলেও পারিবারিক এবং দলীয় প্রভাবের কারণে বিশ্ববিদ্যালয়টি শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ, পদায়ন এবং দায়িত্ব বন্টন হয়েছে। এমন তিনজন শিক্ষক-কর্মকর্তার তথ্য নিশ্চিত হওয়া গেছে। এর মধ্যে খোদ শেখ কবির হোসেনের ছেলেও রয়েছে।
জানা গেছে, ২০১৮ সালের ফেব্রুয়ারিতে বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিরেক্টর অব ফিন্যান্স হিসেবে নিয়োগ পান শেখ কবিরের ছেলে শেখ মোসাদ্দেক কবির। কোন ধরনের প্রবিধান অনুসরণ না করেই তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়োগ পেয়েছেন বলে নিশ্চিত করেছেন বিশ্ববিদ্যালয় সংশ্লিষ্টরা। অভিযোগ আছে, আর্থিক বিষয়গুলো নিজের কব্জায় রাখতে অভিজ্ঞতা ও যোগ্যতা না থাকা সত্ত্বেও নিজের ছেলেকে এ পদে নিয়োগ দেন শেখ কবির। এ ছাড়া শিক্ষক-কর্মকর্তাদের হয়রানি এবং বিভাগের বাইরে খবরদারির কারণে বিশ্ববিদ্যালয়ে নির্বিঘ্নে কাজ করতে না পারার অভিযোগও রয়েছে তার বিরুদ্ধে।
আরও পড়ুন: ‘ছেলে বাঁচি থাকি কিছু করি খাইতে পারবে না, তারপরও আমার জন্য বাঁচি থাকুক’
শেখ মোসাদ্দেক ছাড়াও পারিবারিক বলয় থেকে নিয়োগ পেয়েছেন ট্রাস্টি বোর্ডের আরেক সদস্য মোহাম্মদ আব্দুল আজিজের মেয়ে ফারিয়া সুলতানা। তিনি বিশ্ববিদ্যালয়টির ইংরেজি বিভাগের প্রধান এবং সহকারী অধ্যাপক হিসেবে রয়েছেন। বাবা ট্রাস্টি বোর্ডের সদস্য হওয়ার ফলে শর্ত ভেঙে বিশ্ববিদ্যালয়ে চাকরি এবং পদায়নে তার কোথাও আটকাতে হয়নি।
দেশত্যাগী শেখ হাসিনার চাচা শেখ কবির হোসেনের তত্ত্বাবধানে এসব অনিয়ম সংগঠিত হয়েছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, শিক্ষা, গবেষণা এবং অন্যান্য বিচারে সামগ্রিক পিছিয়ে থাকলেও বিগত আওয়ামী সরকারের প্রভাব খাটিয়ে সবসময়ই আইন ও নীতিমালার বাইরে থাকার সুযোগ পেয়েছে প্রতিষ্ঠানটি।
দেশের উচ্চশিক্ষার তদারক প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) শর্তমতে, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক হতে ন্যূনতম ৩.৫ সিজিপিএ থাকা আবশ্যক হলেও তার স্নাতকের অর্জন সিজিপিএ ২.৬৪। এছাড়াও পূর্ববর্তী একাধিক ফলাফলে দারুণ পিছিয়ে ছিলেন তিনি। তার মাধ্যমিক এবং উচ্চ মাধ্যমিকে জিপিএ ছিল যথাক্রমে ৩.৪৪ এবং ৩.৫। যদিও শিক্ষক নিয়োগে ইউজিসির আরেকটি শর্ত ছিল শিক্ষাজীবনে কোন তৃতীয় বিভাগ অর্জন না থাকা।
এছাড়াও তার প্রভাষক থেকে সহকারী অধ্যাপক হিসেবে পদায়নেও দেখা হয়নি কোন শর্ত বা নীতিমালা। শিক্ষাজীবনে পিছিয়ে থাকা এ শিক্ষার্থী আলো ছড়াতে পারেননি শিক্ষকতাতেও। তার বিরুদ্ধে বিশ্ববিদ্যালয়টির শিক্ষার্থীদের অভিযোগ, ক্লাসে পড়াতে পারেন না তিনি। ফলে শিক্ষার্থীদের হয়রানির ঘটনাও ঘটেছে তার হাতে।
আরও পড়ুন: অনুমোদনের অপেক্ষায় ১২০০ কোটি টাকার মাস্টারপ্ল্যান, বদলে যাবে ঢাকা মেডিকেল কলেজের চিত্র
শিক্ষার্থীদের পড়াতে না পারার এ অভিযোগের সত্যতা পাওয়া গেছে ফারইস্ট ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির প্রাক্তন শিক্ষার্থীদের বক্তব্যে। উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানটির একই বিভাগ থেকে স্নাতক এবং স্নাতোকোত্তর সম্পন্ন করা একজন শিক্ষার্থী নাম অপ্রকাশিত রাখার শর্তে দ্য ডেইলি ক্যাম্পাসকে জানান, ফারিয়া সুলতানা ক্লাসে কখনও লেকচার দিতে পারতেন না। তিনি এসে বই খুলে ১০ মিনিটের মত পড়িয়ে চলে যেতেন। কোন শিক্ষার্থী প্রশ্ন করলে তিনি রাগান্বিত হতেন এবং পরবর্তীতে তাদের ফলাফলসহ বিভিন্ন বিষয়ে হয়রানি করতেন।
এভাবে যদি নিয়োগ হয়ে থাকে, এটা প্রচণ্ড দুঃখজনক একটা ঘটনা। আমরা ক্ষতিয়ে দেখব— প্রফেসর ড. মো. আনোয়ার হোসেন, ইউজিসি সদস্য
ফারইস্ট ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির আইন ও নিয়ম ভেঙে নিয়োগের ঘটনা ঘটেছে খোদ আইন বিভাগেও। বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘আইন ও বিচার’ নামের এ বিভাগে কোন রকম পূর্ব অভিজ্ঞতা ছাড়াই সহকারী অধ্যাপক বনে যান রিসাত নূর। ইউজিসির শর্তমতে, সরাসরি সহকারী অধ্যাপক পদে নিয়োগে পিএইচডি ডিগ্রির পাশাপাশি ৩ বছরের শিক্ষকতার অভিজ্ঞতা বাধ্যতামূলক হলেও সেটি দেখা হয়নি। কোন রকম অভিজ্ঞতা ছাড়াই তাকে এ পদে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। এছাড়া একই বিভাগের প্রভাষক হিসেবে নিবেদিতা তালুকদারের নিয়োগেও মানা হয়নি ইউজিসির বিধিমালা। আর এসব অনিয়মে প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষভাবে জড়িয়েছেন শেখ কবির হোসেন।
আরও পড়ুন: ৪ তলা বাড়িয়ে হয়েছে সাত, ‘অতি ঝুঁকি’ নিয়েই মেডিকেল শিক্ষার্থীদের বাস এই ভবনে
বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) সদস্য প্রফেসর ড. মোহাম্মদ আনোয়ার হোসেন দ্য ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, প্রত্যেকটা ইউনিভার্সিটির নিজস্ব কিছু নিয়ম কানুন আছে এবং সায়ত্ত্বশাসন থাকা উচিত। কিন্তু ২.৬ পয়েন্ট দিয়ে প্রভাষক হওয়ার কোন সুযোগ নেই। এখন স্ট্যান্ডার্ড প্র্যাক্টিস হচ্ছে ৩.৫। আর ফিন্যান্স ডিরেক্টর নিয়োগের ক্ষেত্রেও ফাইনান্স রিলেটেড সার্ভিস এক্সপেরিয়েন্স এবং মাস্টার্স ডিগ্রি হোল্ডার দেখা হয়। এডিশনাল কোয়ালিফিকেশন হাইলি এপ্রিশিয়েটেড।
তিনি বলেন, সহকারী অধ্যাপক পদে সরাসরি নিয়োগের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের প্রচলিত যে নিয়ম, সেখানে সরাসরি সহকারী অধ্যাপক নিয়োগের সুযোগ নেই। তবে যদি পিএইচডি হোল্ডার হয়, তাহলে তার পাবলিকেশন ট্র্যাক রেকর্ড এবং পিএইচডির সময় তার যে টিচিং এক্সপেরিয়েন্স, সেই ট্রেনিংগুলো এবং সঙ্গে রিসার্চ এক্সপেরিয়েন্স বিবেচনায় দিতে পারে। কিন্তু এগুলো ঠিক না থাকলে সরাসরি সহকারী অধ্যাপক হওয়ার সুযোগ নেই। এভাবে যদি নিয়োগ হয়ে থাকে, এটা প্রচণ্ড দুঃখজনক একটা ঘটনা। আমরা ক্ষতিয়ে দেখব।
বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক হতে ন্যূনতম ৩.৫ সিজিপিএ থাকা আবশ্যক হলেও ফারিয়া সুলতানার স্নাতকের অর্জন সিজিপিএ ২.৬৪। এছাড়াও পূর্ববর্তী একাধিক ফলাফলে দারুণ পিছিয়ে ছিলেন তিনি। তার মাধ্যমিক এবং উচ্চ মাধ্যমিকে জিপিএ ছিল যথাক্রমে ৩.৪৪ এবং ৩.৫।
গণঅভ্যুত্থানের পর চলতি বছরের ৮ জুন সিঙ্গাপুর এয়ারলাইন্সের একটি ফ্লাইটে হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর দিয়ে দেশ ছাড়েন কবির হোসেন। তিনি বর্তমানে বিদেশে অবস্থান করছেন। এসব বিষয়ে মন্তব্য জানতে তার ছেলে শেখ মোসাদ্দেক কবিরের মুঠোফোনে একাধিকবার কল দেওয়া হলেও সাড়া পাওয়া যায়নি। জানতে চাইলে ইংরেজি বিভাগের শিক্ষক ফারিয়া সুলতানা দ্য ডেইলি ক্যাম্পাসকে জানান, যেসব অভিযোগ জানানো হয়েছে, তা সত্য নয়। যোগ্যতা পূরণ করেই তিনি নিয়োগ পেয়েছেন।
সার্বিক বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য (ভারপ্রাপ্ত) ড. মো. মুঞ্জুর ই খোদা তরফদার দ্য ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, এরকম অভিযোগ প্রথমবার আপনার কাছেই পেলাম। বিষয়টা আমাকে একটু পরীক্ষা করতে হবে।