অনুমোদনের অপেক্ষায় ১২০০ কোটি টাকার মাস্টারপ্ল্যান, বদলে যাবে ঢাকা মেডিকেল কলেজের চিত্র
- নবাব আব্দুর রহিম
- প্রকাশ: ২৮ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ০৮:৫৫ PM , আপডেট: ২৯ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ০৪:০৯ PM
ঢাকা মেডিকেল কলেজের (ঢামেক) অবকাঠামোগত সংকট দূর করতে বড় বাজেটের পরিকল্পনা হাতে নিয়েছে সরকার। ইতিমধ্যে প্রায় ১২০০ কোটি টাকার একটি উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাবনা (ডিপিপি) তৈরি করেছে সংশ্লিষ্ট দপ্তরগুলো। আগামী নভেম্বর মাসে জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) সভায় উত্থাপিত হতে পারে এ প্রকল্প। পুরান ঢাকার বকশিবাজারে ঢামেকের হল এলাকা ঘিরে প্রণীত ডিপিপি বাস্তবায়ন হলে একাডেমিক ও আবাসিক ভবনের অভাব দূর হবে প্রতিষ্ঠানটির। ঢাকা মেডিকেল কলেজ ও স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিদপ্তর সূত্রে এ তথ্য নিশ্চিত হওয়া গেছে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ঢাকা মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল নিয়ে স্বপ্নসাক্ষর নামে ২৫ হাজার কোটি টাকার বড় একটি প্রকল্পের উদ্যোগ নিয়েছিল বিগত আওয়ামী লীগ সরকার। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বিশাল এ প্রকল্পের স্বপ্ন দেখিয়ে হাসপাতালের পাশাপাশি ঢামেকের সব ধরনের উন্নয়ন আটকে রাখা হয়েছিল। বর্তমানে ঢামেকে চারটি হল রয়েছে। এর মধ্যে ছাত্রীদের ডা. আলিম চৌধুরী ও নারী ইন্টার্ন চিকিৎসকদের ডা. মিলন হল কলেজ ক্যাম্পাসে অবস্থিত। ছাত্রদের ডা. ফজলে রাব্বি ও ইন্টার্ন চিকিৎসকদের ডা. মিলন হল বকশিবাজারে অবস্থিত। স্বপ্নসাক্ষর প্রকল্পের কথা বলে ছোটখাটো কোনো সংস্কারও হয়নি এ হলগুলোতে। ফলে স্বল্প সংখ্যক আবাসনের ব্যবস্থা থাকলেও দীর্ঘদিন সংস্কারের ছোঁয়া না পড়ায় ব্যবহারের অনুপযোগী হয়ে পড়েছে ছেলেদের হলগুলো। এ ছাড়া ১৯৫৫ সালের দিকে নির্মিত একাডেমিক ভবনটিও অনেকাংশে ব্যবহার অনুপযোগী হয়ে পড়েছে বলেও জানাচ্ছেন সংশ্লিষ্টরা।
তারা বলছেন, দেশের পুরনো আটটি মেডিকেল কলেজের মধ্যে ঢামেক ছিল সবচেয়ে অবহেলিত। এতে পুরনো ঝুঁকিপূর্ণ হোস্টেলে দীর্ঘদিন বাস করতে হচ্ছে শিক্ষার্থীদের। একই সাথে ঝুঁকি নিয়ে চলছে ক্লাস-পরীক্ষাও।
আমাদের পুরনো ৮টা মেডিকেল কলেজের অবস্থা খুব খারাপ। এর মধ্যে ঢাকা মেডিকেল কলেজ সবচেয়ে অবহেলিত। আজকে এই বিল্ডিং ভেঙে পড়ছে, কালকে ওই গ্যালারি ভেঙে পড়ছে। এটা নিয়ে আমরা কাজ করছি। ইতোমধ্যে ডিপিপি স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়েছি। আশা করছি আগামী দুই-তিন মাসে যে একনেক হবে, সেখানে এই প্রকল্পটি পাস হবে— অধ্যাপক ডা. মো. নাজমুল হোসেন, মহাপরিচালক, স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিদপ্তর।
এ নিয়ে গত জুন মাসে আন্দোলন শুরু করেছিলেন শিক্ষার্থীরা। ওই সময় তারা পাঁচ দফা দাবি জানিয়েছিলেন। সেগুলো হলো- নতুন ছাত্রাবাস ও ছাত্রীনিবাস নির্মাণের জন্য দ্রুত বাজেট পাস, আবাসন ব্যবস্থা নির্মাণ শেষ না হওয়া পর্যন্ত বিকল্প আবাসনের ব্যবস্থা নিশ্চিত করা, নতুন একাডেমিক ভবনের জন্য আলাদা বাজেট পাস করা, আবাসন ও একাডেমিক ভবনের বাজেট পৃথকভাবে অনুমোদন ও দ্রুত দৃশ্যমান বাস্তবায়ন এবং সব প্রকল্প ও কার্যক্রমের অগ্রগতি শিক্ষার্থীদের সামনে স্বচ্ছভাবে উপস্থাপনের জন্য শিক্ষার্থী প্রতিনিধি নিয়োগ। আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে ওই সময়ে সরকারি মেডিকেল কলেজের জন্য ১৯টি হল নির্মাণে গৃহীত প্রকল্পে ঢাকা মেডিকেল কলেজের জন্যে দুটি হলের বাজেটের সমপরিমাণ অর্থ বরাদ্দ রাখার ঘোষণা দেওয়া হয়।
স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিদপ্তর ও ঢামেক সূত্র জানিয়েছে, ঘোষিত ওই দুই হল নির্মাণের পাশাপাশি পৃথক আরেকটি প্রকল্প নেওয়া হয়েছে। ঢাকা মেডিকেল কলেজ কর্তৃপক্ষ, স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিদপ্তর, গণপূর্ত অধিদপ্তর, স্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর ও স্থাপত্য অধিদপ্তরের সমন্বয়ে প্রণয়ন হয়েছে এই ডিপিপি। এ প্রকল্পের অধীনে বকশিবাজার ক্যাম্পাসে ১৫ তলা একাডেমিক ভবন, শিক্ষার্থীদের জন্য দুটি আবাসিক হল এবং শিক্ষকদের আবাসিক ভবন নির্মাণ করা হবে। নতুন ভবন নির্মাণের পর পুরনো হোস্টেলগুলো ভেঙে ফেলা হবে। একই সাথে সংস্কার করা হবে খেলার মাঠটি। এ প্রকল্পে প্রস্তাবিত ব্যয় ধরা হয়েছে ১১৮২ কোটি টাকা।
পরিকল্পনার কথা জানিয়ে ঢাকা মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ অধ্যাপক ডা. মো. কামরুল আলম দ্য ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, বকশিবাজারে আমরা কিছু জায়গা বের করেছি। ওই ফাঁকা জায়গায় হোস্টেল এবং একাডেমিক বিল্ডিং হবে। এখন যেটা বকশিবাজারের মাঠ (ফজলে রাব্বি হল মাঠ) আছে, মাঠটাকে সামনে রেখে একাডেমিক বিল্ডিং হবে। পরে পুরনো হোস্টেলটি ভেঙে ফেলা হবে। মাঠটা থাকবে, ছাত্ররা যাতে বলতে না পারে আমাদের খেলার মাঠ বন্ধ হয়ে যাবে।
তিনি বলেন, এই প্রকল্পের বাইরে ১৯ হোস্টেল প্রকল্পের যে দুটি হোস্টেল আমরা পাচ্ছি, তা সম্পূর্ণ আলাদা। তবে নতুন প্রকল্পটি আমরা এমনভাবে ডিজাইন করেছি যে ওই দুইটা হোস্টেলকেও ধরে নিয়েছি। ওই দুইটা হোস্টেলের প্রকল্প এতে ক্ষতিগ্রস্ত হবে না। যেহেতু আমাদের ৪টা হোস্টেল প্রয়োজন, দুটি হোস্টেল ওই প্রকল্পে, আর দুটি নতুন মাস্টারপ্ল্যানে নির্মাণ হবে। আর একাডেমিক বিল্ডিং বকশিবাজারে হওয়ার কারণে ঢামেক ক্যাম্পাস প্রায় পুরোটাই বকশিবাজারে স্থানান্তর হবে। বাকি একটা হোস্টেল (ছাত্রী হোস্টেল) এদিকে থাকবে, আর হাসপাতাল তো আছেই। ফলে উভয় পাশে যাতায়াতের জন্য ডেডিকেটেড ওভারপাস তৈরি করা হবে। এটি শুধু শিক্ষার্থীদের জন্য, সাধারণ মানুষ এটি ব্যবহার করতে পারবে না।
আরও পড়ুন: ঢামেকে যন্ত্রপাতি আংশিক অচল, জনবল সংকট তীব্র—সেবাবঞ্চিত হচ্ছেন রোগীরা
তবে কলেজের এই পরিকল্পনার সঙ্গে ঢামেক হাসপাতালকে সংযুক্ত করার চিন্তা-ভাবনা করছেন স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের কোনো কোনো কর্মকর্তা। এ বিষয়ে ঢামেক অধ্যক্ষ বলেন, গত ১৫ বছর ধরে ঢামেকের অবকাঠামো উন্নয়নের সঙ্গে ৫ হাজার শয্যার হাসপাতালের স্বপ্ন দেখিয়ে এক ধরনের মূলা ঝুলিয়ে রাখা হয়েছিল। তবে শেষের দিকে দুটিকে আলাদা করার চিন্তা করা হচ্ছিল। আমরা তার আলোকেই ডিপিপি সাজিয়েছি। কেননা, কলেজ ও হাসপাতাল দুটিকে একসাথে নিয়ে কাজ করলে তা জটিল এবং দীর্ঘমেয়াদি হবে।
স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. মো. নাজমুল হোসেন দ্য ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, ‘আমাদের পুরনো ৮টা মেডিকেল কলেজের অবস্থা খুব খারাপ। এর মধ্যে ঢাকা মেডিকেল কলেজ সবচেয়ে অবহেলিত। আজকে এই বিল্ডিং ভেঙে পড়ছে, কালকে ওই গ্যালারি ভেঙে পড়ছে। এটা নিয়ে আমরা কাজ করছি। ইতোমধ্যে ডিপিপি স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়েছি। আশা করছি আগামী দুই-তিন মাসে যে একনেক হবে, সেখানে এই প্রকল্পটি পাস হবে।’

প্রকল্পে হাসপাতালকে যুক্ত করার প্রসঙ্গে তিনি বলেন, মন্ত্রণালয়ের কেউ কেউ হাসপাতাল এবং কলেজের সমন্বয় করতে বলছেন। মুশকিল হল, হাসপাতালেরটা যদি করতে হয়, তাহলে আরেকটা বিভাগের (স্বাস্থ্য অধিদপ্তর) সঙ্গে সমন্বয় করতে হবে। এখন আমাদের প্রকল্প প্রস্তাবনা প্রস্তুত, কিন্তু তাদেরটা প্রস্তুত হয়নি। ফলে এখানে ঢাকা মেডিকেল কলেজেরটা আগে করে ফেলা যেতে পারে, কারণ এই প্রকল্পের সম্পূর্ণটিই বকশিবাজার ক্যাম্পাসে। একটি হোস্টেল প্রধান ক্যাম্পাসে থাকবে, সেটিও হাসপাতালের সঙ্গে না।
এদিকে শুধু ঢামেক নয়, সব মেডিকেল কলেজের অবকাঠামোগত উন্নয়নে পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে জানিয়ে স্বাস্থ্য শিক্ষার মহাপরিচালক বলেন, পুরনো আটটি মেডিকেলের মধ্যে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ, রংপুর মেডিকেল কলেজ আর রাজশাহী মেডিকেল কলেজে কিছু ভবন তৈরি করা হয়েছিল। এর বাইরে রংপুর মেডিকেল কলেজ, ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ, সিলেট ওসমানী মেডিকেল কলেজ এবং বরিশাল শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজের জন্য চারটা ডিপিপি তৈরি করে মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে। এগুলো বাস্তবায়ন হলে আমাদের এই মেডিকেল কলেজগুলোর অনেক সংকট দূর হবে। এ ছাড়া ১৯টি হোস্টেলের কাজ শুরু হয়েছে। এই হোস্টেলগুলো নির্মাণ হলে ৮৮৫০ জন ছাত্রছাত্রী থাকতে পারবেন। এতে মোট শিক্ষার্থীর ৩৫ থেকে ৪০ শতাংশের আবাসন সুবিধা নিশ্চিত করা যাবে। এর বাইরে বগুড়ার শহীদ জিয়াউর রহমান মেডিকেল কলেজ, ফরিদপুর মেডিকেল কলেজ, কুমিল্লা মেডিকেল কলেজসহ দ্বিতীয় প্রজন্মের মেডিকেল কলেজগুলোর আসন সংখ্যা বাড়িয়ে আরও কয়েকটা হোস্টেল নির্মাণের উদ্যোগ নিয়েছি। এই ডিপিপিগুলো বাস্তবায়ন করলে মেডিকেল কলেজগুলোর একটা দৃশ্যমান উন্নতি হবে।