বাবার অপূর্ণতা যেন পরিপূর্ণ মানুষ হয়ে ওঠার রাস্তা দেখায় চৈতি-বিন্তী-মুহিমদের

ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির শিক্ষার্থী চৈতি, বিন্তী ও মুহিম (বাঁয়ে থেকে)
ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির শিক্ষার্থী চৈতি, বিন্তী ও মুহিম (বাঁয়ে থেকে)  © টিডিসি সম্পাদিত

প্রতি বছরের জুন মাসের তৃতীয় রবিবার বিশ্বব্যাপী উদযাপিত বাবা দিবস উদযাপিত হয়। এ প্রেক্ষিতে গত রবিবার (১৫ জুন) পালিত হয় এ দিবস। এ দিবসে পৃথিবীর বহু প্রান্তে সন্তানরা তাদের বাবার প্রতি কৃতজ্ঞতা আর ভালোবাসা প্রকাশ করে। তবে যাদের জীবনে বাবা নেই, তাদের জন্য এ দিন হয়ে ওঠে এক দীর্ঘ অসীম শূন্যতার প্রতিচ্ছবি। ‘বাবা’ শব্দে গাঁথা আছে সীমাহীন নির্ভরতার ছায়া, অসীম আত্মত্যাগের ভুবন আর অনাগ্রহে নিঃশব্দ এক শক্তি। বছরজুড়ে একবারই আসে বাবা দিবস, কিন্তু যাদের জীবনে বাবার অনুপস্থিতি, তাদের কাছে প্রতিবার এ দিন মনে করিয়ে দেয় এক অনিবার্য ফাঁক, এক নীরব শূন্যতা। ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির তিনজন বাবা-হারানো শিক্ষার্থী তাদের আবেগ, স্মৃতি ও জীবনের অগ্নিপরীক্ষার কথা জানিয়েছেন। তাদের অনুভূতি তুলে ধরেছেন দ্য ডেইলি ক্যাম্পাসের ড্যাফোডিল ইউনিভার্সিটি প্রতিনিধি আতিকুর রহমান বাবু। 

ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির ফার্মেসি বিভাগের তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী নিশাত তাসনিম চৈতি জানান, বাবা হারানোর কষ্ট তাকে অবর্ণনীয় মনে হয়। তার বাবার মৃত্যু হয় ২০১৩ সালে, তখন তিনি পঞ্চম শ্রেণিতে পড়তেন। বাবা না থাকার অনুভূতিটি হৃদয়ে বিষণ্নতা নিয়ে আসে এবং প্রতিটি পদক্ষেপে বাবার অবদান অনুভব হয় বলে তিনি জানান।

চৈতী বলেন, বাবা দিবসে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সবাই তাদের বাবার প্রতি ভালোবাসা প্রকাশ করেন। আমারও বাবার ছবিগুলো দেখলেই বাবা হারানোর অনুভূতি চোখের সামনে ভেসে ওঠে, প্রচণ্ড শূন্যতা অনুভূত হয়। বাবার সাথে কাটানো প্রতিটি স্মৃতি এখন তাঁর কাছে বিশেষ। অসুস্থতার সময় বাবা যেমন তাকে নিয়ে উদ্বিগ্ন হয়ে পড়তেন, সেই মুহূর্তগুলো এখন খুবই মনে পড়ে।

চৈতী জানান, বাবা না থাকার কষ্টে তার মা ও ছোট চাচ্চুকে সুপারম্যান মনে হয়। বাবা দিবসের এই দিনে যদি বাবাকে কিছু বলতে পারতেন, তাহলে বলতেন, ‘আব্বু আমি তোমাকে ভীষণ মিস করি! তুমি থাকলে জীবনটা এতো কঠিন হতো না! বেঁচে থাকার জন্য বাবার ছায়া বড় বেশি প্রয়োজন। আল্লাহ আমার আব্বুকে জান্নাতের উচ্চ মাকাম দান করুক, আমিন।’

ইলেকট্রিক্যাল অ্যান্ড ইলেকট্রনিক্স ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থী ফারজানা ফারিহা বিন্তী তার বাবাকে হারিয়েছেন গত ২০২৪ সালের ২৫ নভেম্বর। বাবা নেই—এই কথাটা আজও মেনে নিতে পারেননি ফারজানা। বাবার স্মৃতিতে প্রতিদিনই ভেঙে পড়েন তিনি। প্রতিবছর বাবা দিবসে বাবার সঙ্গে বের হতেন, কাটাতেন জীবনের সবচেয়ে আনন্দের মুহূর্তগুলো, সেই স্মৃতিই এখন কাঁদায়।

২০২০ সালের কোভিড-লকডাউনের সময়কার একটি ঘটনা আজও তার মনে তাজা। তখন তিনি ঢাকায় খালামনির বাসায়, আর বাবা সিরাজগঞ্জে ছিলেন। রমজানের সময় চলছিল লকডাউন, ইফতারের ঠিক কয়েক মিনিট আগে বাবা একটি গাড়ি চালিয়ে ঢাকায় এসে আমাকে দেখার জন্য এসেছিলেন। তিনি বলেন, ওই দিনটা আমি কোনোদিন ভুলবো না। শোককে শক্তিতে পরিণত করতে শিখেছেন তিনি, ধৈর্য ধরে নিজেকে সামলাতে চেষ্টা করেন প্রতিদিন, আর মায়ের কাছ থেকে পান অদম্য মানসিক সাহস। বাবা দিবসে যদি আবেদনের সুযোগ থাকতো, তাহলে বলতেন, আব্বু, আমি তোমাকে অনেক ভালোবাসি।

কম্পিউটিং অ্যান্ড ইনফরমেশন সিস্টেম বিভাগের চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থী এটিএম মুখলেছুর রহমান মুহিমের জীবন ২০২২ সালের ২২ নভেম্বর এক গভীর দুঃখের মোড় নেয়। সেদিন তিনি হারান তার বাবাকে। বাবার মৃত্যুর অভিজ্ঞতা ছিল মুহিমের কাছে এক ভয়াবহ বাস্তবতা। তিনি বলেন, বাবা মারা যাওয়ার পর মনে হতো, পায়ের নিচে মাটি নেই। আমি যেন এক অকূল পাথরে সাঁতার কাটছি।

শৈশবের স্মৃতিচারণে মুহিম বলেন, চার-পাঁচ বছর বয়সে বাবা না উঠালে আমি বিছানা ছাড়তাম না। নাস্তা করতাম না। বাবা ছিলেন আমার পৃথিবীর সবচেয়ে নিরাপদ আশ্রয়।

বাবা থেকে শিখেছেন জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা—সম্মানের সাথে হালাল পথে জীবন পরিচালনা করা। জীবনের চলার পথে পরিবারের সবার কাছ থেকে সমর্থন পেলেও বড় ভাইয়ের ভূমিকাকে বিশেষভাবে স্মরণ করেন তিনি। তিনি বলেন, আমার বাবার স্থান অপ্রতিস্থানীয়। তাকে কেউই পরিবর্তন করতে পারে না।

বাবার অনন্য ব্যক্তিত্ব মুহিমের জীবনের আজও প্রেরণার উৎস। মুহিমের বাবা এমন একজন মানুষ ছিলেন, যিনি সমাজের প্রতিটি স্তরের মানুষের সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রাখতেন। সবার কাছ থেকে ভালোবাসা ও সম্মান আদায় করে নিতে পারতেন। আত্মসম্মান বজায় রেখে জীবিকা নির্বাহ করার যে কৌশল তিনি জানতেন, তা আজও মুহিমকে ভাবায়। ছোটবেলায় বাবার শাসন হয়ত কঠিন ছিল, কিন্তু আজ তা-ই তার পথপ্রদর্শক। দুষ্টুমি, মারামারি কিংবা পরিবারের শাসন—সবকিছুর পেছনেই ছিল এক নিঃশর্ত ভালোবাসা। এখন যখন পড়াশোনার জন্য পরিবার থেকে দূরে, তখন অনুভব করেন, বাবার ভালোবাসা প্রকাশে নীরব ছিল, কিন্তু নিঃস্বার্থ ছিল।

তিনি আরও বলেন, আমার বাবার সবচেয়ে বড় শিক্ষা ছিল নিজের পরিচয় ও মর্যাদা বজায় রেখে সৎ পথে থাকা। তিনি সবসময় সত্য ও ন্যায়ের পক্ষে থেকেছেন। মুহিম মনে করেন, বাবার অনুপস্থিতি তাকে আত্মনির্ভর ও পরিণত হতে বাধ্য করেছে।

মহিম বলেন, আল্লাহ হয়ত বাবাকে আমাদের কাছ থেকে নিয়ে গেছেন, যেন আমরা নিজেদের নতুন করে গড়তে পারি। বাবার ছায়াতলে হয়ত এভাবে গড়ে ওঠা সম্ভব হতো না। তখন আমরা খুব বেশি নির্ভরশীল হয়ে পড়তাম। আজ আমি শুধু এটুকুই চাই, বাবার অপূর্ণতা যেন আমাকে পূর্ণতা পাওয়ার পথ দেখায়। আমি যেন তাঁর মতো একজন আলেম হতে পারি, এবং একদিন আমাদের পরিবার যেন জান্নাতি পরিবারে পরিণত হয়।

তিন শিক্ষার্থীর স্মৃতিচারণ বলে দেয়, বাবা না থাকলেও, বাবার শিক্ষা ও ভালোবাসা আজও তাদের জীবনকে শক্ত করে। বাবার ছাপ যেন তাদের সম্পূর্ণ মানুষের পথে এগিয়ে নিয়ে যায়।


সর্বশেষ সংবাদ