খালেদা জিয়ার শৈশব ও কৈশোর: এক স্বপ্নীল সোনালি উপাখ্যান
- টিডিসি ডেস্ক
- প্রকাশ: ৩০ ডিসেম্বর ২০২৫, ০৫:১৫ PM , আপডেট: ৩০ ডিসেম্বর ২০২৫, ০৬:০১ PM
১৯৪৫ সালের ১৫ আগস্ট বর্তমান পশ্চিমবঙ্গের জলপাইগুড়িতে জন্মগ্রহণ করেন। ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর বাবা ইস্কান্দর মজুমদার পরিবারসহ চলে আসেন বাংলাদেশে। ব্যবসায়িক সূত্রে বসতি গড়ে তোলেন দিনাজপুরে। সেখানেই শৈশব কেটেছে বেগম খালেদা জিয়ার। তবে তার বেড়ে ওঠাটা ‘পুতুল’ নামে। পরিবারের সবাই আদর করে ‘পুতুল’ই ডাকতেন তাঁকে। সেই পুতুল থেকে বেগম খালেদা জিয়া হয়ে তিনি বাংলাদেশের রাজনীতির অবশ্যম্ভাবী এক কেন্দ্রীয় চরিত্র হয়ে উঠেছিলেন। আজ মঙ্গলবার (৩০ ডিসেম্বর) ভোরে রাজধানীর এভারকেয়ারে হাসপাতালে শেষ নিঃশাস ত্যাগ করেছেন তিনি।
শৈশবে দিনাজপুরের ঈদগাঁ বস্তিতে একটি ভাড়া বাসায় থাকতেন বেগম খালেদা জিয়া। তার শৈশব আর কৈশোর ছিল অসামান্য রঙিন। তার মা বেগম তৈয়বা মজুমদার, ছোট ভাই সাঈদ ইস্কান্দর, বড় বোন খুরশীদ জাহান এবং ছেলেবেলার সারাক্ষণের সাথী মেজো বোন সেলিমা ইসলাম বিউটির বক্তব্যেও এমন চিত্র উঠে এসেছে। সাংবাদিক ও কলামিস্ট সৈয়দ আবদাল আহমেদ তার ‘নন্দিত নেত্রী খালেদা জিয়া: সংগ্রামমুখর জীবনের আলেখ্য’ গ্রন্থে সংকলন করেছেন তাদের বক্তব্য। দ্য ডেইলি ক্যাম্পাসের পাঠকদের জন্য গ্রন্থটির ‘সোনালি শৈশবে, স্বপ্নের কৈশোরে’ অধ্যায় থেকে থেকে মা ও ভাই-বোনদের চোখে বেগম খালেদা জিয়ার শৈশবের চিত্র তুলে ধরা হল।
আরও পড়ুন: আপসহীন সংগ্রামের প্রতীক ছিলেন খালেদা জিয়া
পরিবারে খালেদা জিয়াই ছিলেন তখন সবার আদরের পুতুল। তাকে কেউ তখন ধমক দিতে পারত না। আদর করতে হত। সেই আনন্দময় শৈশবের মুহূর্তগুলো বর্ণনা করলেন খালেদা জিয়ার মা বেগম তৈয়বা মজুমদার—
পুতুল ছিল আমার সবার আদরের মেয়ে। ছোটবেলা থেকেই ও খুব সুন্দর। ওর বাবা ওকে ভীষণ আদর করত। কাউকে কিছু বলতে দিত না। প্রতিদিন ওর বাবা বাসায় এলেই ও দৌড়ে গিয়ে কোলে উঠত। ওর বাবা ওর কাছে জিজ্ঞাসা করত কে কে আদর করেছে, কে করেনি। কেউ কিছু বলেছে কি-না। পুতুলের বয়স তখন দুবছর। মুখে কথা ফুটেছে। আমরা জলপাইগুড়িতে। আমাদের পারিবারিক চিকিৎসক ডাক্তার অবনীগুহ একদিন আমাদের বাসায় এসে পুতুলকে কোলে নিল। অবনীগুহের গোঁফ ছিল অনেক বড়। সে পুতুলকে আদর করে বলল, ‘এই বুড়ি! তোকে গোঁফ দিয়ে বেঁধে নিয়ে যাব।’ পুতুল তখনি ওর কোল থেকে নেমে এসে আমার কাছে নালিশ করে—‘চাচ্চুটা ভাল না। আমাদের বাসায় আর ওকে আসতে দিও না।’ বিউটিকে নিয়ে পুতুল সারাক্ষণ খেলত। কাঠের পুতুল, মাটির পুতুল নিয়ে ওরা বউ খেলায় মেতে থাকত। ছোট হাঁড়িতে বালি দিয়ে রান্না চড়াত। মিছেমিছি খাবারের ভান করত। ওদের মধ্যে কোনোদিন ঝগড়া হয়নি। পুতুলের একদিন আঙুল কেটে গিয়েছিল, বিউটি তো কেঁদেই অস্থির। ছোটবেলায় পুতুল ওর বাবার গামছাকে শাড়ি হিসাবে পরত। ওর শখ দেখে ওর বাবা একটি ছোট্ট লাল শাড়ি এনে দেয়। ওটা ও পরত। আমরা ওকে তখন বলতাম লাল টুকটুকে বউ। বিউটি যখন পড়তে বসত, পুতুলও বিউটির কাছে গিয়ে বসত। বিউটির সঙ্গে সেও পদ্য মুখস্থ করত। ওর বাবা বাসায় এলে পদ্য মুখস্থ শুনাত। ওর বাবা বলত, আমার ওই মেয়েটি বিদ্বান হবে। বইয়ের ছবি দেখতে পুতুল পাগল ছিল। নতুন বই আনলেই উলটে-পালটে ছবি দেখত।
ওর বয়স তখন চার। রোজার দিন। আমরা সবাই রোজা রাখছি। সেও রোজা রাখতে প্রতিদিন কান্নাকাটি করত। আমরা বলতাম ছোট মানুষের রোজা এমনিতেই হয়। কিন্তু সে মানত না। পুতুল ‘রোজা রাখব’ বলতে পারত না। বলত ‘আম্মা আমি আজ রোজা খাব’। একদিন তো সে একটি রোজা রেখেই দিল। অনেক চেষ্টা করেও আমরা রোজা ভাঙাতে পারিনি। আমার সঙ্গে নামাজের বিছানায় নামাজও পড়ত। ওর বাবা এবং আমি ওকে মুখে মুখে কলমা শিখিয়েছি। অবশ্য একটু বড় হলে মৌলানা সাহেব রেখে আমরা ওদের নামাজ ও কলমা-কালাম শিখিয়েছি। শবে বরাতের দিন ফকির-মিসকিনদের পুতুল হালুয়া রুটি বিলিয়ে দিত। রাতে আমাদের সঙ্গে নামাজ পড়ত। ঈদের দিনে নতুন কাপড় পরে খুব মজা করত। ছোটবেলা থেকেই পুতুলের তেমন চাহিদা নেই। অন্যের নতুন জামা-কাপড় দেখে ও কিনে দেয়ার জন্য বায়না ধরত না। ছোটবেলায় পুতুল গান করেছে, নাচ করেছে। ওর জন্য নাচের মাস্টার রেখেছিলাম। বাসায় ও নাচ করেছে। অবশ্য একটু বড় হলে আর নাচে উৎসাহিত করিনি।
আরও পড়ুন: এই দেশ ও মানুষই ছিল আমার মায়ের পরিবার-সত্তা-অস্তিত্ব: তারেক রহমান
পুতুলকে ওর বাবা পাঁচ বছর বয়সে স্কুলে ভর্তি করে দেন। প্রথম দিন স্কুলে গিয়ে তো সে খুব খুশি। স্কুল থেকে এসে নানান গল্প করল। স্কুলের অন্য ছেলেমেয়েরা কী বলেছে, স্যার কী বলেছেন, স্যারটি কেমন—আরো কত কি! খেলাধুলা সে খুব পছন্দ করত। মিশন স্কুল থেকে ওকে দিনাজপুর গার্লস স্কুলে ভর্তি করা হল। স্কুলে লেখাপড়ার পাশাপাশি নানা খেলাধুলায় সে মেতে থাকত। দৌড়, লং জাম্প, মিউজিক্যাল চেয়ার, যেমন খুশি তেমন সাজো এবং সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে পুতুল অংশ নিত। খেলাধুলায় বরাবরই সে প্রথম হয়েছে এবং পুরস্কার পেয়েছে। পাড়ায়ও সে খেলাধুলা করত। আমার বোন থাকত পাশের বাসায়। বোনের ছেলে-মেয়ে ছিল বারো জন। পুতুল ও বিউটি ওদের সঙ্গেই খেলত। কানামাছি, এক্কা দোক্কা, লুডু, কোম সে খেলত। কারো মধ্যে কোনোদিন ঝগড়া হয়নি।
আমার ছেলে সাঈদ ও শামীম জন্ম নেয়ার পর পুতুল সব সময় ওদের যত্ন নিত। সাঈদকে কাপড় পরানো, শামীমকে গোসল করানো এগুলো পুতুলই করত। ওদেরকে গান গেয়ে ও গল্প বলে জমিয়ে রাখত। এছাড়া সব সময় ওদের পোশাক পরিয়ে টিপটপ রাখত। ছোটবেলা থেকেই পুতুলের সঞ্চয়ের প্রতি প্রবল ঝোঁক ছিল। টাকা-পয়সা পেলেই রেখে দিত। প্রয়োজন না হলে খরচ করত না। ওর বাবা ওকে টাকা দিতেন। ও জমা করে রাখত। আমার অন্য মেয়েরা ওকে এ বলে ক্ষ্যাপাত যে, ‘তোর শ্বশুরবাড়ি গেলে তুই কিপটেমি করে ভালো কিছু খাওয়াবি না।’ পুতুল হাসত। ভাল জিনিস খাওয়ার প্রতিও ওর ঝোঁক ছিল। খুব হালকা- পাতলা গড়ন ছিল কৈশোরে। মাছ একেবারেই খেত না। মাংস ছিল তার পছন্দ। তরিতরকারির মধ্যে আলু ও ঢেঁড়স পছন্দ করত। দিলরুবা নামে ওর একজন বান্ধবী ছিল। ওর সঙ্গে পুতুল গল্প করত। সে ফুল কুড়িয়ে এনে বাসায় মালা গেঁথে ছোট ভাইদের দিত। ফুলদানিতে ফুল রাখত, ঘর সাজাত। ওর বাবা বলত— মেয়েদের সব কাজ শিখিয়ে রাখা ভাল। ফলে আমার বড় মেয়ে চকলেট, সেজো মেয়ে বিউটি ও পুতুলকে আমরা সব ধরনের রান্না-বান্না ও অন্যান্য কাজ করতে শিখিয়েছি। পুতুল সব রান্না জানে। কৈশোরে ওদের পালা করে রান্না করতে দিতাম। এভাবেই ওরা রান্না শিখেছে।
খালেদা জিয়ার ছোট ভাই সাঈদ ইস্কান্দরও বর্ণনা করলেন দিনাজপুরের সেই মধুময় দিনের স্মৃতি—
মুড়ি চুরি করতে গিয়ে একদিন আমার থুতনি কেটে গিয়েছিল। ছোট আপা (খালেদা জিয়া) দৌড়ে এসে আমার থুতনি ড্রেসিং করে দেন। এরপরও রক্ত বন্ধ না হওয়ায় তিনি রিকশায় করে আমাকে নিয়ে যান দিনাজপুর পুলিশ হাসপাতালে। সেখান থেকে ব্যান্ডেজ করিয়ে আনেন। আমাকে কাপড়-চোপড় তিনিই পরাতেন। আমি স্কুলে যেতে চাইতাম না। সকাল ন’টা হলেই কান্না শুরু করে দিতাম। ছোট আপা চকলেট কিনে দিয়ে বুঝিয়ে-সুঝিয়ে স্কুলে নিতেন। ছোট আপা পড়তেন দিনাজপুর গার্লস স্কুলে, আমি পড়তাম সেন্ট জোসেফে। বাসার কর্তৃত্ব বলতে গেলে তাঁরই ছিল। ড্রইং রুমে সোফা সাজানো, বিছানা গোছগাছ করা, বাড়ি পরিষ্কার রাখা— সবই তিনি করতেন। অন্য কেউ এগুলো করলে তার পছন্দ হত না। অবশ্য তিনি যেটা সাজাতেন সেটা সবারই ভালো লাগত। আসলে ছোটবেলা থেকেই তার ‘চয়েস' ছিল আলাদা এবং নিখুঁত। একবার চুড়ি ভেঙে ছোট আপার হাত কেটে গিয়েছিল। অনেক রক্ত পড়েছিল। আমরা চিন্তিত হয়ে পড়েছিলাম। কিন্তু উনি হেসে বললেন, ‘ও কিছু না’। আমরা আব্বা-আম্মা ভাইবোন সবাই একত্রে বসে খেতাম। আব্বা ব্রিটিশ আমলের গল্প করতেন। সে সময় কত টাকায় কত দুধ পাওয়া যেত, কত চাল পাওয়া যেত ইত্যাদি। আব্বা খুব সংস্কৃতিমনা ছিলেন। কলকাতায় কাজী নজরুল ইসলাম ও রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সঙ্গে তার কেমন করে দেখা হল, কী আলাপ হল বলতেন। ছোট আপা প্রশ্ন করে করে আব্বার কাছ থেকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে মজার তথ্য বের করতেন। ছোট আপা ও আমাদের সেই ছেলেবেলা খুব মধুর ছিল।
আরও পড়ুন: যে কারণে খালেদা জিয়াকে বলা হয় ‘আপসহীন’ নেত্রী
বড় বোন খুরশীদ জাহানেরও মনে আছে খালেদা জিয়াকে নিয়ে ছেলেবেলার অনেক স্মৃতি—
রান্নাঘরে বসে আম্মা আমাদের নিয়ে গল্প করতেন। নানা-নানীর গল্পই বেশি বলতেন। বিউটি, পুতুল ও আমার সঙ্গে আম্মা-আব্বার সম্পর্ক ছিল অনেকটা বন্ধুর মত। তবে গুরুজনদের মান্য করার ব্যাপারে আব্বা-আম্মা আমাদের আদব-কায়দা শেখাতেন। পুতুলকে স্কুলে ভর্তি করার আনুমানিক দুবছর পর বায়ান্নোর ভাষা আন্দোলন হয়েছিল। বাংলা ভাষার জন্য ঢাকায় অনেক শহীদ হয়েছে, ঢাকার রাজপথ রক্তে রঞ্জিত হয়েছে— এ খবর আমরা দিনাজপুরে শুনেছিলাম। এ সময় পুতুল আম্মা, আব্বা ও আমাদের বার বার জিজ্ঞাসা করত কেন পাঞ্জাবিরা (পাকিস্তানিরা) গুলি চালাল, তারা কেন উর্দু ভাষা চাপিয়ে দিতে চায় ইত্যাদি প্রশ্ন। ছোটবেলা থেকেই পুতুলের স্মরণশক্তি ছিল প্রখর। একবার যেটা পড়ত, মনে রাখতে পারত। খেলাধুলা করত বলে সন্ধ্যা হলেই ঘুমিয়ে পড়ত। আব্বা রাত ন’টার মধ্যে বাসায় ফিরতেন। আব্বার আওয়াজ পেলেই পুতুল বিছানায় থেকেই মুখস্থ পড়া শুরু করে দিত। কোথায় বই, কোথায় খাতা তার ঠিকানা নেই। সে উচ্চস্বরে আওয়াজ করে পড়ছে। আব্বা যাতে বুঝতে পারেন পুতুল পড়ছে। এ নিয়ে আমরা হাসাহাসি করতাম। পুতুল খুব বেশি পড়ত না। তবে পড়াশুনায় ছিল ভাল। স্কুলে সে বরাবরই ভাল রেজাল্ট করেছে। ওর শৈশব-কৈশোরের পনেরোটা বছরই কাটে দিনাজপুরে ।
খালেদা জিয়ার ছেলেবেলার সারাক্ষণের সাথী মেজো বোন সেলিমা ইসলাম বিউটির চোখের সামনে ভেসে ওঠে সেই মধুময় শৈশব-কৈশোর। বললেন—
আমরা এক বিছানায় ঘুমাতাম। শীতের দিনে লেপ নিয়ে টানাটানি করতাম। একটু-আধটু ঝগড়াও হয়েছে।’ বললেন, ‘পুতুল আমাকে ছোটবেলা থেকেই নাম ধরে ডাকত। আম্মা-আব্বা ওকে বলতেন আমাকে আপা ডাকার জন্যে। কিন্তু পুতুল বলত লম্বায় সে আমার চেয়ে কম। ওকে আবার আপা কেন ডাকব। পুতুল আমাকে ভেংচি কাটত আর বলত তোকে আবার আপা ডাকব কেন? আমি তো তোর চেয়ে অনেক বড়। আমরা দুবোন মাঠে খেলতে যেতাম। তবে পুতুলের সঙ্গে দৌড়ে পারতাম না। পুতুল ফার্স্ট হত। একবার রাগারাগি করে আমরা কথাও বন্ধ রেখেছিলাম। পুতুল আমার সঙ্গে আড়ি দিয়েছিল। আব্বা আমাদের দুজনের মধ্যে রাগ ভাঙান।
আব্বা খুব রক্ষণশীল মানুষ ছিলেন। আমাদের চলাফেরার ব্যাপারে খুব নজর রাখতেন। বাইরে আমরা যেকোনোভাবে চলাফেরা করতে পারতাম না। একদিন পুতুল ও আমি বাসার বাইরে খেলছিলাম । হঠাৎ দেখি আব্বা আসছেন। আমরা দেখেই বাসায় পালাই। আব্বা যাতে কিছুই বুঝতে না পারেন সেজন্য পুতুল ছাদে গিয়ে শরীরে পানি ঢেলে গোসল করে ফেলে। আব্বা পুতুলকে জিজ্ঞাসা করেন তোমাকে বাইরে দেখেছি। পুতুল তৎক্ষণাৎ বলে ওঠে, না আব্বা, আমি তো গোসল করছিলাম। অর্থাৎ ছেলেবেলায় সব ধরনের দুষ্টুমিই আমরা করেছি।