‘ড. ইউনুসকে পাঁচ বছরের জন্য ক্ষমতায় চাই’—স্লোগান ছড়ানো হচ্ছে ফেসবুক ফলোয়ার বাড়াতে
ডিসমিস ল্যাবের প্রতিবেদন
- টিডিসি ডেস্ক
- প্রকাশ: ২৯ মে ২০২৫, ১২:০২ AM , আপডেট: ২৮ আগস্ট ২০২৫, ০৯:১২ PM
ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকারের মেয়াদ নিয়ে রাজনৈতিক মহলে চলমান আলোচনার মধ্যেই সামাজিক মাধ্যমে ‘আমরা ড. ইউনূসকে পাঁচ বছরের জন্য চাই’—এই ছড়িয়ে পড়েছে। তবে রাজনৈতিক প্রোপাগান্ডার চেয়েও এর পেছনে ছিল লাইক ও ফলোয়ার বাড়ানোর পুরোনো কৌশল। এর পেছনের রহস্য খুঁজতে অনুসন্ধান চালিয়েছে গবেষণা প্রতিষ্ঠান ডিসমিস ল্যাব। বুধবার (২৮ মে) ডিসমিস ল্যাব তাদের প্রতিবেদন প্রকাশ করে।
ডিসমিস ল্যাবের একটি তদন্তে উঠে এসেছে, অন্তত ৪৭টি ফেসবুক পেজ গত এপ্রিল থেকে মে মাসের মাঝামাঝি পর্যন্ত ৫৫টি পেইড অ্যাড চালিয়েছে এই স্লোগান ব্যবহার করে। এসব বিজ্ঞাপন চালানো পেজগুলোর ৯০ শতাংশের আগের পোস্টে রাজনৈতিক কোনো বিষয়বস্তু ছিল না। খাদ্য, প্রসাধনী, কাপড়, স্বাস্থ্যপণ্য, ফলমূল কিংবা ব্যক্তিগত ভ্লগ—এসব নিয়েই ছিল তাদের কনটেন্ট। কিন্তু হঠাৎ করেই তারা ব্যবহার করেছে ড. ইউনূসের নাম ও ছবি। বিজ্ঞাপনগুলোতে ‘লাইক দিন’, ‘সাথে থাকুন’ এমন আহ্বানের সঙ্গে যুক্ত ছিল জনপ্রিয় স্লোগানটিও।
প্রতিষ্ঠানটি জানায়, ‘The Tasty Apron’ নামের একটি রেস্টুরেন্ট-ভিত্তিক পেজ ১৩ ও ১৪ মে দুটি বিজ্ঞাপন চালায়—যার একটি তে লেখা ছিল “আপনি যদি চান ড. ইউনূস পাঁচ বছর ক্ষমতায় থাকুন, তাহলে ডান পাশে লাইক অপশনে চাপ দিন।”
এ ধরনের বিজ্ঞাপন প্রচার করা ৪৭টি পেজের মধ্যে ৩০টি ছিল পণ্যে বিক্রয় ও বিজ্ঞাপনের সঙ্গে জড়িত। ভ্লগ বা ব্যক্তিগত পেজ ছিল ৮টি। কিছু মিডিয়া পেজ ও ডিজিটাল মার্কেটিং ব্র্যান্ডও ছিল এই তালিকায়। ‘Natural Health BD’, ‘Ambzar’, ‘Mayer Dowa Agro’ এর মতো পেজগুলো আগে কখনো রাজনৈতিক কিছু প্রচার করেনি। কিন্তু হঠাৎ এই ‘ইউনূস স্লোগান’ ব্যবহার করে তারা ফলোয়ার বাড়াতে তৎপর হয়।
সর্বোচ্চ ফলোয়ার পাওয়া পেজটি ‘Khobor24’, যার লাইক ৩ লাখ ৪৩ হাজারের বেশি। অন্যদিকে, ‘Premium BD’ নামের একটি পেজ, যেটি ইউটিউব প্রিমিয়াম সাবস্ক্রিপশন বিক্রি করে, তার লাইক ছিল মাত্র ১১টি।
ডিসমিসল্যাবের গবেষণায় দেখা গেছে, এসব পেইড অ্যাডের মাধ্যমে গড়ে ৩৫ হাজার লাইক এবং ৩৭ হাজার ফলোয়ার ছিল এসব পেজে।
কারা চালাচ্ছে এই বিজ্ঞাপন?
২৬টি পেজের অ্যাডমিন লোকেশন পাওয়া গেছে, যার মধ্যে ২৪টি বাংলাদেশের এবং দুটি পেজ চালানো হচ্ছিল বিদেশ থেকে। গবেষকরা যাদের সঙ্গে কথা বলেছেন, তাদের মধ্যে একজন স্বীকার করেন যে, তারা নিজেরাই বিজ্ঞাপনটি বানিয়েছেন ফলোয়ার বাড়ানোর উদ্দেশ্যে। বাকিরা বলেন, তারা কোনো রাজনৈতিক কনটেন্ট চালানোর নির্দেশ দেননি বরং কিছু ভেন্ডরের মাধ্যমে ‘লাইক বাড়ানো’র দায়িত্ব দিয়েছিলেন।
ইয়াতি ডিজিটাল নামের ব্রান্ড বোস্টিং প্রতিষ্ঠানের সিইও এ. এম. ফারুক বলেন, “পেজ ফলোয়ার বাড়ানো এখন অনেক পেজ মালিকের কাছে বিশাল বিষয়। ক্লায়েন্টরা দ্রুত ফল চায়, কিন্তু এজেন্সির উচিত তাদের সঠিক পরামর্শ দেওয়া—সব পন্থাই ফলপ্রসূ হয় না।”
পুরোনো কৌশল, নতুন চেহারা
ফেসবুকে জনপ্রিয় রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বদের নাম ও ছবি ব্যবহার করে লাইক বাড়ানোর এমন কৌশল একেবারে নতুন নয়। এর আগে ২০২৩ ও ২০২৪ সালেও একইভাবে খালেদা জিয়া, শেখ হাসিনা, এমনকি জামায়াত নেতা দেলোয়ার সাঈদীর নাম ব্যবহার করে লাইক ফার্মিং অ্যাড চালানো হয়। এসব বিজ্ঞাপনেও ছিল না কোনো ‘পেইড ফর বাই’ ডিসক্লোজার, যা মেটার নীতিমালায় বাধ্যতামূলক।
এ বিষয়ে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের গণমাধ্যম ও সাংবাদিকতা বিভাগের সহকারী অধ্যাপক সাইয়েদ আল-জামান বলেন, “ড. ইউনূসের নাম ব্যবহার করে এমন প্রচারণা বর্তমান রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে নিঃসন্দেহে রাজনৈতিক হিসেবেই গণ্য হবে। এমনকি এটি যে পেজ থেকেই প্রচার হোক না কেন।”
মেটার নীতিমালা ও বাস্তব প্রয়োগের দুর্বলতা
মেটার নীতিমতে, কোনো রাজনৈতিক বা সামাজিক ইস্যু-ভিত্তিক বিজ্ঞাপনের জন্য স্পনসরের নামসহ ডিসক্লেইমার থাকা বাধ্যতামূলক। কিন্তু ডিসমিস ল্যাব বিশ্লেষণ বলছে, ৫৫টি বিজ্ঞাপনের একটিতেও এই নিয়ম মানা হয়নি। শুধু ১২টি বিজ্ঞাপন পরে মেটা সরিয়ে দেয়, বাকিগুলো তখনও সক্রিয় ছিল। একই ছবি ব্যবহার করে চালানো দুইটি বিজ্ঞাপনের মধ্যে একটি মুছে ফেলা হলেও অপরটি ছিল সক্রিয়।
২০২৩ সালে ডিজিটাললি রাইট পরিচালিত একটি গবেষণায়ও দেখা গেছে, বাংলা ভাষার কনটেন্ট শনাক্ত করতে মেটার অ্যালগরিদম এখনো অনেক দুর্বল, বিশেষ করে যখন তা অরাজনৈতিক পেজ থেকে ছড়িয়ে পড়ে।
এই ঘটনা আবারও প্রমাণ করে, রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব ও ইস্যু ব্যবহার করে ফেসবুক পেজে জনপ্রিয়তা বাড়ানো বাংলাদেশের ডিজিটাল মিডিয়ায় একটি চালু ‘ট্রিক’। ড. ইউনূসকে ঘিরে নতুন রাজনৈতিক সম্ভাবনার আবহে সেই ট্রিক আবার ফিরে এসেছে। কিন্তু এটি শুধু ডিজিটাল নীতিমালা লঙ্ঘন নয়, বরং দেশের গণতান্ত্রিক পরিসরেও তৈরি করছে বিভ্রান্তি। প্রশ্ন হচ্ছে—এই প্রবণতা কে নিয়ন্ত্রণ করবে? মেটা, নাকি দেশীয় নীতিনির্ধারকরা?