মিছিলে যাওয়া শিক্ষার্থীরা শ্রেণিকক্ষে ফিরছে না, দিন কাটছে আন্দোলনে
- আলামিন ইভান
- প্রকাশ: ০১ মে ২০২৫, ০৯:০৪ PM , আপডেট: ২২ জুন ২০২৫, ০৪:৫৬ PM
সংকটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে দেশের বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান । মাধ্যমিক স্কুল থেকে শুরু করে কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়—প্রতিটি স্তরে ছড়িয়ে পড়েছে অনিশ্চয়তা, বিশৃঙ্খলা ও অস্থিরতা। শিক্ষার্থীদের আন্দোলন, শিক্ষক বরখাস্ত, প্রশাসনিক ব্যর্থতা, রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ—সব মিলিয়ে শিক্ষার পরিবেশ চরমভাবে বিঘ্নিত হচ্ছে। এর ফলে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে লাখ লাখ শিক্ষার্থীর শিক্ষা জীবন এবং দেশের সামগ্রিক অগ্রগতি।
শিক্ষা বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অস্থির এই প্রবণতা জাতির ভবিষ্যতের জন্য মারাত্মক হুমকি। তরুণদের মাঝে সহনশীলতা, যুক্তিবাদ ও নিয়মতান্ত্রিকতার পরিবর্তে অহেতুক আন্দোলনের সংস্কৃতি গড়ে উঠছে; যা আগামী দিনে আরও বড় সামাজিক সংকট তৈরি করতে পারে।
জানতে চাইলে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান অনুষদের ডিন অধ্যাপক মো. শামছুল আলম দ্য ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, ‘একটি পরিবর্তিত সময়ের পর মানুষের চাওয়া-পাওয়ার আকাঙ্ক্ষায়ও পরিবর্তন আসে। যখন মানুষ একটি নির্দিষ্ট শাসন কাঠামোর ভেতর দিয়ে শোষিত হয়, আর সেই কাঠামোর পতন জনরোষের মাধ্যমে ঘটে; তখন সাধারণত মানুষের মধ্যে পূর্বের অপূর্ণ চাহিদা ও দাবিগুলো পূরণের আকাঙ্ক্ষা তীব্র হয়ে ওঠে। কিন্তু নতুন শাসন কাঠামো যদি এসব চাহিদা পূরণে ব্যর্থ হয় বা বিলম্ব করে, তখন মানুষের মধ্যে অস্থিরতা দেখা দেয়।’
তিনি বলেন, ‘অস্থিরতা থেকে উত্তরণের উপায় হলো—সবাইকে সহনশীল হতে হবে। যারা নতুন দায়িত্বে আসেন, তাদের শুধু দাপ্তরিক দায়িত্ব পালনের মধ্যে সীমাবদ্ধ না থেকে সরাসরি সমস্যার মূল পর্যন্ত পৌঁছাতে হবে এবং জনগণের কথা মনোযোগ দিয়ে শুনতে হবে। আলোচনার পরিবেশ তৈরি করে সমস্যাগুলোর সমাধানে এগিয়ে গেলে এই অস্থিরতা অনেকটাই কমে আসবে।’
শুধু শিক্ষার্থী নয়, দেশের বিভিন্ন স্কুল, কলেজ ও মাদ্রাসায় শিক্ষকরাও চরম অনিশ্চয়তার মুখোমুখি। রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক চাপে শিক্ষকরা জোর করে পদত্যাগে বাধ্য হচ্ছেন।
খোঁজ-খবরে পাওয়া তথ্যমতে, উচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান তো বটেই, বিভিন্ন পাবলিক পরীক্ষা বাতিল ও পেছানোর দাবিতেও সম্প্রতি দেশের বহু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ধারাবাহিক আন্দোলন শুরু হয়েছে। শিক্ষার্থীদের দাবি আদায়ের জন্য এখন নিয়মিত ক্লাস বর্জন ও অবরোধ যেন স্বাভাবিক ঘটনায় পরিণত হয়েছে। কোথাও পরীক্ষার তারিখ নিয়ে অসন্তোষ, কোথাও প্রশাসনের বিরুদ্ধে ক্ষোভ—পাঠচর্চা যেন এখন দ্বিতীয় প্রাধান্যে চলে গেছে। শিক্ষার্থীরা বুঝে গেছে, চাপ প্রয়োগের মাধ্যমে প্রশাসনিক সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করানো সম্ভব, ফলে যেকোনো বিষয়ে সহজেই তারা আন্দোলনে নেমে পড়ছে।
শুধু শিক্ষার্থী নয়, দেশের বিভিন্ন স্কুল, কলেজ ও মাদ্রাসায় শিক্ষকরাও চরম অনিশ্চয়তার মুখোমুখি। রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক চাপে শিক্ষকরা জোর করে পদত্যাগে বাধ্য হচ্ছেন। সম্প্রতি নোয়াখালীর বেগমগঞ্জে এক প্রধান শিক্ষককে মারধর করে অপদস্থ করার ঘটনা জাতীয়ভাবে তীব্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেছে। জানা গেছে, সারা দেশে এরকম আরও বহু শিক্ষক নানা ধরনের অভিযোগের শিকার হয়ে বিদ্যালয়ের বাইরে রয়েছেন। এই ধারা অব্যাহত থাকলে শিক্ষক সমাজের মর্যাদা ক্ষুন্ন হবে এবং ভবিষ্যতে শিক্ষাক্ষেত্রে অভিজ্ঞ ও গুণী শিক্ষক পাওয়া কঠিন হয়ে পড়বে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন বিশ্লেষকরা।
এদিকে কুয়েটসহ দেশের বিভিন্ন প্রকৌশল ও সাধারণ বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের আন্দোলন এখন নিয়মিত চিত্র হয়ে দাঁড়িয়েছে। কুয়েটে ছাত্র রাজনীতি নিষিদ্ধের দাবিতে সংঘর্ষ, বহিষ্কার, হল বন্ধ, প্রশাসনিক ভবন অবরোধসহ নানা ঘটনায় সেশনজটের ভয়াবহতা বাড়ছে। ৩৭ জন শিক্ষার্থী বহিষ্কারের পরিপ্রেক্ষিতে উপাচার্য ও উপ-উপাচার্য পদত্যাগে বাধ্য হওয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের স্থিতিশীলতা আরও নষ্ট করেছে। অপরদিকে বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরাও প্রশাসনের বিভিন্ন ব্যর্থতা ও অনিয়ম নিয়ে নিয়মিত আন্দোলন করে আসছেন।
‘মানুষের মধ্যে বিশ্বাস বা আস্থা অনেকটাই ভেঙে পড়েছে। এই বাস্তবতায়, প্রশাসনের প্রতি বা সরকারি ও বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের নানা প্রতিষ্ঠান যখন বিভিন্ন প্রতিশ্রুতি বা কর্মপরিকল্পনা দেয়, সেগুলোর ওপর মানুষের আস্থা সংকটে পড়ে। হঠাৎ করে সেই হারিয়ে যাওয়া আস্থা পুনর্গঠন সম্ভব নয়, এটি সময়সাপেক্ষ প্রক্রিয়া। এরকম একটি বড় অভ্যুত্থানের পরে এমন প্রতিক্রিয়া খুবই স্বাভাবিক। আশা করছি, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এই সংকট কেটে যাবে।’— অধ্যাপক সাইফুদ্দীন আহমদ, প্রক্টর, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
এছাড়া বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়েও শিক্ষকদের বিরুদ্ধে আন্দোলন জোরালো হয়েছে। শিক্ষার্থীদের দাবির মুখে উপাচার্যসহ গুরুত্বপূর্ণ প্রশাসনিক ব্যক্তিরা পদত্যাগ করতে বাধ্য হচ্ছেন। একের পর এক বিশ্ববিদ্যালয়ে চলতে থাকা বিশৃঙ্খলা শিক্ষার মান এবং উচ্চশিক্ষার ভবিষ্যৎ নিয়ে নতুন করে প্রশ্ন তুলছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শান্তি ও সংঘর্ষ অধ্যয়ন বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ও বিশ্ববিদ্যালয় প্রক্টর সাইফুদ্দীন আহমদ দ্য ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, ‘দীর্ঘদিন ধরে মানুষ একটি ফ্যাসিবাদের ভেতরে বসবাস করছে। ফলে তাদের মনে গভীর ক্ষোভ জমেছে। মানুষের মধ্যে বিশ্বাস বা আস্থা অনেকটাই ভেঙে পড়েছে। এই বাস্তবতায়, প্রশাসনের প্রতি বা সরকারি ও বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের নানা প্রতিষ্ঠান যখন বিভিন্ন প্রতিশ্রুতি বা কর্মপরিকল্পনা দেয়, সেগুলোর ওপর মানুষের আস্থা সংকটে পড়ে। এটা খুবই স্বাভাবিক—কারণ মানুষ দীর্ঘদিন ধরে দেখে আসছে, মুখে এক কথা বলা হলেও বাস্তবে কার্যক্রম ভিন্ন হয়ে থাকে। তাই হঠাৎ করে সেই হারিয়ে যাওয়া আস্থা পুনর্গঠন সম্ভব নয়, এটি সময়সাপেক্ষ প্রক্রিয়া। এরকম একটি বড় অভ্যুত্থানের পরে এমন প্রতিক্রিয়া খুবই স্বাভাবিক। তবে আশা করছি, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এই সংকট কেটে যাবে।’
‘সারা দেশে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে অস্থিরতার বিষয়ে আমরা যথেষ্ট উদ্বিগ্ন। এটা যাতে না ঘটে, এজন্য আমাদের পরিকল্পনা রয়েছে। আগে একটি অস্থিরতার পরিবেশ ছিল, এটি যে রাতারাতি ঠিক হয়ে যাবে, এটা ভাবা ঠিক না।’— ড. সি আর আবরার, শিক্ষা উপদেষ্টা
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্রিমিনোলজি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক এ বি এম নাজমুস সাকিব মনে করেন, ‘সম্প্রতি আমরা একটি দুঃখজনক ঘটনার মধ্য দিয়ে গিয়েছি। অনেক শিশু নিহত হয়েছে, অনেকে আহত হয়েছে। সমাজে হঠাৎ করে পরিবর্তন আসলে আমরা প্রায়ই দেখি যে, একটি ধরনের বিশৃঙ্খলা দেখা দেয়। সম্প্রতি দেখেছি শিক্ষার্থীরা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার দাবিতে আন্দোলন করছেন। তারা চান ২৪ ঘণ্টার মধ্যে একটি কলেজকে বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপান্তরিত করতে। কিন্তু প্রশ্ন হলো, মাত্র ২৪ ঘণ্টায় কি একটি কলেজকে বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপান্তর করা সম্ভব? এছাড়া, অনেকের মাঝে এখন এমন একটি মানসিকতা তৈরি হয়েছে যে, দাবি আদায়ের একমাত্র পথ হলো আন্দোলন। কারণ আমরা দীর্ঘদিন ধরে এই সংস্কৃতিই দেখে আসছি—যখনই কেউ শান্তিপূর্ণভাবে কোনো দাবি জানিয়েছে, তা উপেক্ষিত হয়েছে। দুর্ভাগ্যজনকভাবে বাংলাদেশে এমন একটি সংস্কৃতি গড়ে উঠেছে যে, আপনি যদি সহিংসতার পথে না যান, তাহলে আপনার কথা শোনা হবে না ’
আরো পড়ুন: ইন্টারন্যাশনাল ইয়্যুথ প্রজেক্ট সাবমিশনে সেরা দশে শাবিপ্রবির মোফাজ্জল
তিনি বলেন, ‘ক্রিমিনোলজির ভাষায় আমরা বলি, ছোট ছোট বিশৃঙ্খলাগুলো যদি সময়মতো সমাধান না করা হয়, তাহলে সেগুলো বড় ধরনের সংকট তৈরি করতে সহায়তা করে। এই প্রেক্ষাপটে, যেসব জায়গায় আন্দোলন চলছে, সেখানে সংশ্লিষ্ট স্টেকহোল্ডারদের যত দ্রুত সম্ভব আলোচনার টেবিলে আনা প্রয়োজন এবং তাদের কথা মনোযোগ দিয়ে শোনা উচিত। এতে তারা অনুভব করবেন যে, তারা মূল্যায়িত হচ্ছেন। এই বিষয়গুলোকে গুরুত্ব না দিলে, ছোট ছোট সমস্যাগুলো একসময় বড় সংকটে পরিণত হতে পারে।’
এসব বিষয়ে সম্প্রতি এক সভায় শিক্ষা উপদেষ্টা ড. সি আর আবরার বলেন, ‘সারা দেশে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে অস্থিরতার বিষয়ে আমরা যথেষ্ট উদ্বিগ্ন। এটা যাতে না ঘটে, এজন্য আমাদের পরিকল্পনা রয়েছে। আগে একটি অস্থিরতার পরিবেশ ছিল, এটি যে রাতারাতি ঠিক হয়ে যাবে, এটা ভাবা ঠিক না।’